মামুলি ভাঙাচোরা একটা বাড়ির গল্প। গ্রামের মধ্যে একটা ভাড়া বাড়িতে চলা উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র। আগে ঐটা একটা প্রাথমিক স্কুল বাড়ি ছিল। এখন সরকারের দয়ায় স্কুল একটা নতুন বাড়ি পেয়ে যাওয়াতে ওটা আমরা পেয়েছি। ঘরটা বড়। টালির ছাদ। আমফান ঝড়ের পরে বেশ কয়েকটা টালি উড়ে গেছে। কারেন্ট নেই। কোনোদিন লাইনটাই ছিল না।
ওই ঘরেই ভিড় জমে। মায়েরা নিজেরা আসে, বাচ্চাদের নিয়ে আসে দিদিমনিদের কাছে। ভিড় জমায়। প্লাস্টিকের সস্তা চেয়ারে বসে। কোভিডের কথা ভেবে দিদিমনিরা একটু বকুনি দেয়, ফাঁকা ফাঁকা করে বসতে বলে। ওরা হাসে। একটু সরে বসে। বসে থাকতে থাকতে ভাঙা ছাদ দিয়ে ওরা আকাশ দেখে, বাতাস মাখে।
লাইন দিয়ে ওরা পরিষেবা নেয়, টিকা নেয়, মালা বড়ি নেয়, আয়রন বড়ি নেয়, বাচ্ছাগুলো টিকা নেয়। ভাঙা ছাদ দিয়ে জল পরলে একটু সরে বসে। আঁচল দিয়ে বাচ্চার মাথা ঢাকে।
ওই ঘরে বসে আমাদের স্বাস্থ্যকর্মীরা মানে প্রথম এএনএম দিদিমনি, দ্বিতীয় এএনএম দিদিমনি, আশা দিদিমনিরা কাজ করে দিনের পর দিন। ওরা বাচ্চাদের টিকা দেয়, মায়েদের টিকা দেয়, কপার টি পরায়, মায়েদের প্রেসার মাপে, হিমোগ্লোবিন মাপে, সুগার মাপে, উপদেশ দেয় আরো হাজার গন্ডা কাজ। ভাঙা ছাদ দিয়ে জল পরলে একটু সরে বসে।
দিনের শেষে কাজের শেষে দিদিমনিরা অকাজের কাজ করে মানে হাজার গন্ডা রেজিস্টার লেখে, রিপোর্ট লেখে। অন্ধকার নেমে এলে মোমবাতির আলোয় লেখে। গরমে ঘামের ফোঁটা কখনো কখনো সেই রেজিষ্টারের লেখাটা বেখাপ্পা ঝাপসা করে দেয়। ওরা আবার লেখে। তারপরে বাড়ি ফেরে।
সেই রিপোর্ট দেখে আমি রেগে যাই। বিজ্ঞের মতো নিদান দিই। মাসিক মিটিং এ দিদিদের ধমকাই। “কেন আপনার ফুল ইমিউনাইজেশন ৯৫%? কেন ওটা ১০০% হল না? উত্তর শুরু হলে মাঝ পথে থামিয়ে দিয়ে বলি, কোনো কথা শুনতে চাই না। আগামী মাসে ১০০% দেখতে চাই।”
দিনের শেষে অফিস ঘরে ফিরি। সেই ঘরে বসে রিপোর্ট বানাই। রিপোর্ট লিখতে লিখতে যদি কারেন্ট চলে যায় রেগে যাই। আমাদের অফিসে “চেঞ্জওভার সুইচ'” বলে একটা বস্তু আছে। কারেন্ট চলে গেলে জেনারেটর চালু হয়। কিন্তু ওই চেঞ্জ ওভার সুইচটা যতক্ষণ না কেউ ঠেলে ওপরে তুলে দিচ্ছে ততক্ষণ পাওয়ার আসে না লাইনে। গরমে ছটফট করি। রেগে যাই। সুইচ তুলে দিলে শান্তি। এসিটা না চলুক, আলোটা জ্বলে, পাখাটা অন্ততঃ ঘোরে।
শো-কজ লেটারের ড্রাফট ভাবি। মাত্র ৯৫%! যুৎসই একটা চিঠি ধরাতেই হবে দিদিমনিদের। ভাবতে ভাবতে কারেন্ট চলে আসে। পরম শান্তি। রাগটা কমে আসে। উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রের নামটা কি-বোর্ডে টাইপ করতে করতে একটু অন্যমনস্ক হয়ে পরি। চোখে ভেসে ওঠে সেই টালির ছাদের বাড়িটা। কেন কে জানে, কিসের টানে বারান্দায় এসে দাঁড়াই। আকাশের দিকে চোখ চলে যায়। ঘন কালো অন্ধকার হয়ে আসছে পড়ন্ত বিকেল। ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টির শব্দ শুনতে পাই।
সেই দূরে সাব সেন্টারের ঘরে তখন জলে আধভেজা হয়ে দিদিমনিরা ব্যস্ত টেবিল সরাতে, চেয়ার সরাতে, ফুটো ছাদ বেয়ে আসা বৃষ্টির জল থেকে যতটা বাঁচা যায়। বৃষ্টির জলে নিজেরা পুরো ভিজে গেলেও পরোয়া নেই, খাতাপত্রগুলোকে বাঁচাতে হবে, সময় মতো রিপোর্ট না পাঠাতে পারলেই আবার কপালে ওপরওয়ালার বকুনি।
সেই টেবিল চেয়ার সরানোর শব্দ কানে আসে না। দূরে আছি তো। বহুদূরে। কেন আসে না, আবার রেগে যাই। ফিরে আসি নিজের ঘরে। শো কজের চিঠির ড্রাফট ডিলিট করে আবার নতুন করে লিখতে শুরু করি-
“রেসপেক্টেড স্যার, আপনার অবগতির জন্য জানাচ্ছি যে একজন সহৃদয় ব্যক্তি আমাদের জেলার … নামক উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রের বাড়ি বানানোর জন্য এক টুকরো জমি দান করেছেন। বিনীত অনুরোধ এই যে উক্ত জমিতে একটি পাকাবাড়ি তৈরি করার জন্য আদেশনামা … তাং .. অনুযায়ী যা বরাদ্দ তার চেয়ে কিছুটা বেশি টাকা প্রয়োজন। কারণ দানের জমিটা পুকুর পাড়ে। একটি অতিরিক্ত গার্ড ওয়াল বানাতে হবে। তাই মহাশয় উক্ত নির্মাণ কল্পে … পরিমাণ টাকা মঞ্জুর করলে এলাকাবাসী অশেষ উপকৃত হবে। বিষয়টি অবিলম্বে সহানুভূতির সাথে বিবেচনার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি। ইতি …”
ই মেইলের সেন্ড বাটন টিপে দিয়ে বসে আছি। ইচ্ছেপাখী ডানা মেলে উড়ে যাচ্ছে ইথার তরঙ্গ বেয়ে। বেলা শেষ হয়ে যায় আমার জেলা ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় হয়ে ঘনিয়ে আসে। উত্তর কবে আসবে অপেক্ষায় থাকি।
হঠাৎ একদিন এক অলৌকিক জলযান বেয়ে ঈশ্বরের বাগান থেকে এসে পৌঁছায় সেই বহু প্রতীক্ষিত উত্তর। “এডমিনিসট্রেটিভ এপ্রুভাল এন্ড ফিনানসিয়াল স্যাংশন : নিম্ন স্বাক্ষরকারী জানাচ্ছেন যে আপনাদের ওই প্রজেক্টটির জন্য …. এত টাকা বরাদ্দ হয়েছে। অবিলম্বে নির্মাণ কাজ শুরু করার নির্দেশ দেয়া হচ্ছে।”
ভাঙা ঘরে নয়, এবার চাঁদের হাট বসবে পাকা ঘরে, পাকা ছাদের তলায় – যাওয়ার আগে একবার দেখে যাবো দু চোখ ভরে।