তখন চলছে এক অশিক্ষার, অন্ধকারের যুগ। মোগল আমলের অবসান ঘটেছে, কিন্তু ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়নি তখনও। শিক্ষাব্যবস্থায় চলছে চূড়ান্ত অরাজকতা। সহস্র বছরের অবহেলা, বিজ্ঞানবিমুখতা, কুসংস্কারের ফলে দেশ ক্রমাগত পশ্চাদপথযাত্রী। শিক্ষার মানের অবনমনের সাথেই নেমেছে জনসাধারণের জীবনযাত্রার মানও। সমাজও হয়েছে আরো রক্ষণশীল। সেই রকম সময়েরই ঘটনা এটা।
সাল ১৮৩৬। ১০ই জানুয়ারি। স্থান মেডিকেল কলেজের ডিসেকশন হল। সেখানেই, সেদিনই রচিত হলো ইতিহাস। রচনা করলেন বৈদ্যবাটির এক রক্ষণশীল বৈদ্য পরিবারের সন্তান, পণ্ডিত মধুসূদন গুপ্ত। সমস্ত কুসংস্কারকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে করলেন শবব্যবচ্ছেদ। আধুনিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে। উপমহাদেশের বুকে প্রথম ভারতীয় হিসেবে।
আজ শবব্যবচ্ছেদ আমরা সব ডাক্তারি পড়ুয়ারাই করি, একদম শিক্ষার প্রাথমিক ধাপ হিসেবে। মধুসূদন গুপ্ত যখন করেছিলেন, তখন কিন্তু পরিস্থিতি ঠিক এতটা সহজ ছিল না। মেডিকেল কলেজ কলকাতা স্থাপিত হয়েছিল মূলত ব্রিটিশদের স্বার্থ রক্ষার জন্যই। ভারতীয়দের চিকিৎসা-শিক্ষা ছিল afterthought। আবার রক্ষণশীল সমাজের তরফে ছিল শিক্ষা-বিমুখতা। তবুও, সব বাঁধা টপকে জেদ ধরে শুরু হয় ভারতীয় ছাত্রদের চিকিৎসা-শিক্ষা। মধুসূদন গুপ্তও ছিলেন এমনই এক ছাত্র। বৈদ্যবাটির বিখ্যাত বৈদ্য পরিবারের বংশধর, গুপ্তদের পারিবারিক পেশা ছিল আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা। আয়ুর্বেদ চিকিৎসক হিসেবেই মধুসূদন যোগ দেন ফোর্ট উইলিয়ামের আয়ুর্বেদ কলেজে। সেখান থেকে আয়ুর্বেদের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন কলকাতা মেডিকেল কলেজে। কিন্তু স্রেফ আদ্যিকালের আয়ুর্বেদে নয়, মধুসূদনের আগ্রহ ছিল আধুনিক বিজ্ঞানে। এর আগেও তিনি সংস্কৃতে অনুবাদ করেছেন আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের বই Ved-mecum। এবার সুযোগ পেয়েই ভর্তি হলেন কলকাতা মেডিকেল কলেজের আধুনিক চিকিৎসাবিদ্যার কোর্সে। আর তারপর, হাজার বছরের বাঁধা ভেঙে আজকের দিনে, ঠিক ১৮৬ বছর আগে, করলেন প্রথম শব ব্যবচ্ছেদ, ভারতীয় হিসেবে। তাঁর গাইড হিসেবে থাকলেন অধ্যাপক গুডিভ। সাহায্য করলেন উমাচরণ শেঠ, রাজকৃষ্ণ দে, দ্বারকানাথ গুপ্ত ও নবীনচন্দ্র মিত্র। কলেজের বন্ধ দরজার বাইরে তখন হিংসাত্মক জনতা, ধর্মদ্রোহের বদলা নিতে রক্তলোলুপ। তবুও, টলানো গেল না তাঁদের। এক ধাক্কায় ভারতে বিজ্ঞানসাধনার পথে একটা বড় কাঁটা উপড়ে ফেললেন কজন জেদি বাঙালি – যাঁদের নেতৃত্ব দিলেন পণ্ডিত মধুসূদন গুপ্ত।
পণ্ডিত গুপ্ত এরপরে সরকারি চিকিৎসক হয়েছেন, উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন জনস্বাস্থ্যের বিস্তার ঘটাতে। তাঁর ডিসেকশনের পর খুলে গেছিল অগ্রগতির পথ। ১৮৩৬ এ প্রবল বাঁধা অতিক্রমের কিছু বছরের মধ্যেই মেডিকেল কলেজে শব ব্যবচ্ছেদের সংখ্যা হয়ে দাঁড়ায় পাঁচশো।
আজকের দিনে যেন ইতিহাসের চাকাকে পিছনের দিকে ঘুরতে দেখছি আমরা। প্রত্যেক মুহূর্তে বিজ্ঞানের নামে অপবিজ্ঞান, ওষুধের নামে গোমূত্রের প্রচার চলছে। সেই সময়ই অনেক বেশি প্রয়োজন পণ্ডিত মধুসূদন গুপ্তকে, তাঁর সংগ্রামকে স্মরণ করা। মেডিকেল এডুকেশন ডে-তে তাঁর লড়াইই প্রেরণা দিক আমাদের।