খেলায় জেতার আনন্দে ছেলেপিলেদের ডিগবাজি বা Somersault দিতে দেখা যায়। সে তো তাৎক্ষণিক ব্যপার- প্রবল আনন্দ ও উত্তেজনায় খেলোয়াড় বা সমর্থকরা যেটা হঠাৎ করে ফেলে। এছাড়া সার্কাসের ক্লাউনরা কারণে-অকারণে ডিগবাজি দিয়ে দর্শকের মনোরঞ্জন করে। এতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই।
মনোরঞ্জন করতে চাইলে আলাদা কথা, কিন্তু একজন প্রাপ্তবয়স্ক দায়িত্বশীল ব্যক্তি বা দেশের বা রাজ্যের কোনো উচ্চতম প্রতিষ্ঠান যদি ঘনঘন ডিগবাজি খায় (রূপকার্থে) অর্থাৎ নিজেদের কথা বা নিজেদের জারি করা উপদেশ বা নিয়ম বা আদেশ দু-চার দিন পরে নিজেরাই সবশুদ্ধ বাতিলের খাতায় ফেলে দেয় তাকে নিখাদ ডিগবাজি ছাড়া আর কি-ই বা বলা যাবে!
এনএমসি-র কথা বলছিলাম এঁজ্ঞে। ভারতবর্ষের চিকিৎসাবিদ্যার নতুন মহানিয়ামক সংস্থা গণতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচিত নয়- তার পদাধিকারীরা মূলতঃ কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক মনোনীত। আর কে না জানে, সরকারের মনোনীত ব্যক্তিরা সরকারেরই আজ্ঞাবহ হবে।
তা এহেন অগণতান্ত্রিক নিয়ামক সংস্থা গত দু-মাসে দু-দুটি মেদিনী কাঁপানো নির্দেশিকা জারি করেও সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই ডিগবাজি খেয়ে আবার আগের জায়গায়। প্রথমটার ক্ষেত্রে নেক্সট (NeXT) পরীক্ষা নিয়ে নির্দেশিকা তো চুড়ান্ত অবাস্তব! ভারতবর্ষে ইউ জি সি স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করে এমবিবিএস পাশ করার পরে আবার কেন বিদেশ থেকে পাশ করা ছাত্রছাত্রীদের মত আরো একটা পরীক্ষা দিতে হবে- সেই প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই। কোনো যুক্তিও নেই। আর যুক্তি নেই বলেই এই তুঘলকি সিদ্ধান্ত প্রকাশ্যে আসার কয়েক দিনের মধ্যেই সব পক্ষের প্রচন্ড প্রতিবাদে এবং প্রতিরোধে আবার সেই অর্ডার সবশুদ্ধ গিলে ফেলা হয়।
তার কয়েক সপ্তাহ পরেই আরেক আদেশনামা। ২০০২ সালে মেডিক্যাল কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়ার কিছু উপদেশ ঝেড়ে ঝুড়ে ‘আদেশ’ নামক কড়া আরক মিশিয়ে নতুন বোতলে ভরে বিতরণ হল রীতিমতো হুকুমের ঢঙে। এমবিবিএস পাশ সব চিকিৎসককে একমাত্র জেনেরিক ওষুধই লিখতে হবে। অন্যথায় কড়া শাস্তির মুখে পড়তে হবে – ইত্যাদি। আরো অনেক কিছু সেই অর্ডারে ছিল- যা এই আলোচনার বিষয় নয়। তবে তার প্রত্যেকটা বিষয়ই সেই ২০০২ সালের মেডিক্যাল কাউন্সিলের উপদেশনামাতে ছিল। জাতীয় স্বাস্থ্য কমিশনের সরকার মনোনীত কর্তারা নতুন কিছু তো করেনই নি, বিষয়গুলি বাস্তবসম্মত কিনা- কেন গত একুশ বছরে সেগুলো প্রচলন করা গেল না- সেসবও তলিয়ে দেখেন নি।
তাই মাত্র দু-সপ্তাহের মধ্যে একেবারে গেজেট নোটিফিকেশন জারি করে সব অর্ডার বাতিল করতে হয়েছে। মানে যাকে বলে একেবারে ‘পর্বতের মূষিক প্রসব’। শুধু তাই নয়, বলা হয়েছে- এই অর্ডার প্রত্যাহার করা হল এবং মেডিক্যাল কাউন্সিল (MCI) -এর ২০০২ সালের পুরনো উপদেশনামা আবার জারি হল। এখন কথা হল, একটা কাউন্সিল যাকে ২০১৯ সালে ভেঙে দেওয়া হয়েছে- তার উপদেশনামা আবার নতুন করে চালু করা যায় কিনা- সেটা আইন বিশেষজ্ঞরা বলতে পারবেন।
এমনিতে আমি ব্যক্তিগত এবং নীতিগতভাবে জেনেরিক ওষুধ লেখার পক্ষে। বড় বড় সূক্ষ্ম নীতি গর্ভকথায় না হয় পরে আসব, প্রথমে ব্র্যান্ডেড ওষুধ লেখার গোদা গোদা অসুবিধাগুলো বলি।
ভারতে তিন হাজারেরও বেশী ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানী। এক একটা ড্রাগ মলিকিউলের চার-পাঁচশো করে ব্রান্ড নাম। এক-একটা কোম্পানী তো উদ্ভট সব নাম রাখে তাদের প্রোডাক্টের। সেসব মনে রাখতে গেলে আসল ডাক্তারী ভুলে যেতে হবে।
ওষুধের উদ্ভট নামের দুটো উদাহরণ দিই।
১
তখন সবে প্র্যাকটিস শুরু করেছি। একদিন এক গ্রাম্য মহিলা এসে এক পাতা ট্যাবলেট দেখিয়ে বলল, ‘আপনার ওষুধ খেয়ে আমি অজ্ঞান হয়ে গেছিলাম। আমাকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছিল।’
অবাক হয়ে গেলাম। ভেবে পেলাম না। কি এমন ওষুধ লিখলাম যেটা খেয়ে রোগী অজ্ঞান হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হল! প্রেসক্রিপশন-টা উল্টে পাল্টে দেখলাম। দেখলাম লিখেছি ‘Tab GLUCART’। এটা একটা নির্দোষ বাতের ওষুধ। এ খেয়ে অজ্ঞান হওয়া খুব মুশকিল।
হঠাৎ কি একটা সন্দেহ হতে জিজ্ঞেস করলাম, ‘যে ওষুধটা কিনেছিলেন, সেই ট্যাবলেটের পাতাটা আছে ?’
‘হ্যাঁ, আছে’ বলে পাতাটা আমার হাতে ধরিয়ে দিল। পড়ে দেখি সেটা ‘Tablet GLUCORED’ । এটা ডায়াবেটিসের ওষুধ। অথচ রোগীর ডায়াবেটিস নেই! বুঝলাম এই ওষুধ খেয়ে ব্লাড সুগার কমে গিয়ে রোগী অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। সে মারাও যেতে পারত।
আমার হাতের লেখা মুক্তোর মত না হলেও মোটেই দুর্বোধ্য নয়।
‘আপনাকে তো ভুল ওষুধ দেওয়া হয়েছে। এই ওষুধ আমি লিখি নি।এই দেখুন।’
রোগীকে ওষুধের দোকানে পাঠালাম। দোকানদার পত্রপাঠ অস্বীকার করল যে, সে এই ওষুধ বেচেছে। রোগী ওষুধ কেনার সময় বিল নেয় নি! ওষুধের ব্যাচ নম্বর দিয়ে অভিযোগ করা যেত। কিন্তু একা গ্রাম্য মহিলা। পেরে ওঠে নি।
২
সালটা ২০০২। তখন Rofecoxib নামে একটা ব্যথার ওষুধ এসেছে বাজারে- যাতে অম্বল, কিডনী, ফুসফুসের উপর সাইড এফেক্ট খুব কম। সেটা আন্তর্জাতিক বাজারে VIOXX নামে পাওয়া যেত।
ভারতবর্ষে বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানী তখন বিভিন্ন আকর্ষণীয় নামে সে ওষুধ বাজারে ছাড়ছে। সেই বছর ওয়ার্ল্ড কাপ ফুটবল। ব্রাজিল ওয়ার্ল্ড কাপ জিতেছিল। রিভাল্ডো আর রোনাল্ডো তখন ভীষণ জনপ্রিয়। একটা ওষুধ কোম্পানী Rofecoxib নিয়ে এল ‘RIVALDO’ ব্র্যান্ড নামে (কি করে অনুমতি পেল কে জানে!) । আমার তখনই ব্যপারটা ভালো লাগেনি। আমি কোনোদিন ওই ব্র্যান্ড লিখিওনি।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত যা ঘটল- তার জন্য কেউই প্রস্তুত ছিলাম না। একদিন আর জি করে এক রোগী একজন পিজিটি-কে এসে আউটডোর টিকিট দেখিয়ে বলল, ‘আপনারা স্যার কি যে ওষুধ লেখেন, কোনো দোকানে পাওয়া যায় না!’
প্রেসক্রিপশনটা হাতে নিয়ে পিজিটি হাসতে শুরু করল। তারপর হাসতেই থাকল।
আমি বললাম, ‘কি হল রে?’
পিজিটি কোনো কথা না বলে হাসতে হাসতে আউটডোর টিকিটটা আমার হাতে এগিয়ে দিল। দেখি, তাতে লেখা-‘ট্যাবলেট RONALDO – একটা করে দিনে দু’বার খাবার পরে।’
আবার আমাদের আসল আলোচনায় আসি। জাতীয় স্বাস্থ্য কমিশনের পরপর দুটো ডিগবাজির পরে তার বিশ্বাসযোগ্যতা কতটা বজায় থাকল জানি না। তবে ডিগবাজির ইংরেজি প্রতিশব্দ সামারসল্ট-এ একটা অংশ আছে সল্ট। যদিও বানানটা একটু আলাদা, তাও বলি, এই pharmaceutical salt বা ওষধি লবণের মধ্যে লুকিয়ে আছে আমাদের দেশে জেনেরিক ওষুধ লেখার বড় সমস্যাগুলোর একটা।
অর্ধেকেরও বেশী প্রচলিত ওষুধ আসলে মূল রাসায়নিকের salt বা লবণ রূপে থাকে। কারণ, ওষুধের মূল রাসায়নিক অণু-র নিজস্ব রূপে (active form) তাকে ক্যাপসুল, ট্যাবলেট, পাউডার বা ইঞ্জেকশনের তরলে পরিণত স্থিতিশীল (stable) করে রাখা যায় না।
ক্যাপসুল, ট্যাবলেট, পাউডার বা তরল ইঞ্জেকশনকে স্থিতিশীল রাখতে ওষুধে preservative ও দিতে হয়।
এখন সব জেনেরিক ওষুধের মূল রাসায়নিক অণু (molecule) এক হলেও তার বিভিন্ন ব্র্যান্ডের লবণ (salt) ও সংরক্ষণকারী রাসায়নিক (preservative) সামান্য আলাদা হয়। এই দুটো কারণ ছাড়াও, পেটেন্ট আইন এড়ানোর জন্য ব্র্যান্ডেড ও জেনেরিক ওষুধের আইনসম্মত তারতম্য বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন রকমের। আগর লেখাতেই লিখেছি, আমাদের দেশে এই আইনসম্মত পার্থক্য খুবই বেশী।
তাই এক এক কোম্পানীর ওষুধে এক এক রকমের কাজ হয়। কোনোটায় বেশী ভাল, আবার কোনোটায় কম। দামেরও তারতম্য- একই ওষুধের কোনো ব্র্যান্ডের দাম আশি টাকা, আবার কোনো ব্র্যান্ডের দাম বারো টাকা।
আর তাছাড়া, এত অসংখ্য কোম্পানীর অসংখ্য উদ্ভট ওষুধের নাম সত্যিই মনে রাখতে পারছি না।
তাই জাতীয় স্বাস্থ্য কমিশন তার অর্ডার ঠান্ডা ঘরে পাঠিয়ে দিলেও আমার মনে হয় জেনেরিক ওষুধই লেখা উচিত। কিন্তু কতগুলো শর্ত আছে-
১. সব ওষুধ কোম্পানিকে শুধুমাত্র জেনেরিক ওষুধ তৈরি করতে হবে। এখনকার মত একই মলিকিউলের ব্র্যান্ডেড ওষুধের পাশাপাশি জেনেরিক নয়।
২. সমস্ত ব্র্যান্ডেড ওষুধ বন্ধ করে দিতে হবে। তা না হলে ডাক্তার প্রেসক্রিপশনে জেনেরিক ওষুধ লিখলেও ওষুধের দোকানদার তার পছন্দমতো ব্র্যান্ডেড ওষুধ (যেটায় তার লাভ সবচেয়ে বেশী) বিক্রি করবে। কিন্তু সেই খারাপ মানের ব্র্যান্ডেড ওষুধে কাজ না হলে বা কোনো জটিলতা হলে ডাক্তারই দায়ী হবে- ওষুধের দোকানদার নয়।
৩. পাড়ায় পাড়ায় সমস্ত বেসরকারি ওষুধের দোকান বন্ধ করতে হবে।
৪. একমাত্র প্যারাসিটামল ইত্যাদি ওটিসি (OTC – Over the counter) ওষুধ ছাড়া আর আর কোনো ওষুধ ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন ছাড়া কিছুতেই বিক্রি করা যাবে না।
এইসব শর্ত দিলেও আমার ধারণা, অদূর ভবিষ্যতে আইন করে সমস্ত ব্র্যান্ডেড ওষুধ বন্ধ করে জেনেরিক ওষুধ চালু হওয়ার সম্ভাবনা কম। তাই নিজেই ব্র্যান্ডেড নামের পাশাপাশি জেনেরিক নাম লিখতে চেষ্টা করছি।
আমাদের দেশের কর্তা-কর্ত্রীরা গাছের গোড়া কেটে তার আগায় জল ঢালায় পটু। অথবা বলা ভালো – তাঁরা ‘চোরকে বলেন চুরি করতে, গৃহস্থকে বলেন সজাগ থাকতে’। সেটা তামাকজাত দ্রব্য বর্জন বা প্লাষ্টিক বর্জনের ক্ষেত্রে যেমন সত্যি – জেনেরিক আর ব্র্যান্ডেড ওষুধের ক্ষেত্রেও তেমনই।
তামাকের মত ক্ষতিকর দ্রব্য ব্যবহার বন্ধ করার সহজ ও নিশ্চিত উপায় হল তামাক চাষ ও তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবসা আইন করে বন্ধ করা। তা না করে বলা হয় ‘ধূমপান স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর’, ‘তামাক ক্যান্সারের কারণ’ ইত্যাদি। এইসব অক্ষম বিজ্ঞাপন করে হাজার হাজার কোটি টাকা জলে দেওয়া হয়। অথচ খুব কম লোকেই যে সে বিষয়ে সচেতন, তা ক্যান্সার হাসপাতালগুলোর আউটডোরে গেলেই বোঝা যায়।
প্লাষ্টিক তৈরী করা আইন করে বন্ধ করলেই তার ব্যবহারও স্বাভাবিক ভাবে বন্ধ হয়ে যেত। তা না করে জনসচেতনতা বৃদ্ধি ইত্যাদি হাস্যকর পন্থা নেওয়া হয়ে থাকে।
তেমনি, ব্র্যান্ডেড ওষুধ তৈরী ও বিক্রি আইন করে বন্ধ করলেই তো সব ডাক্তার জেনেরিক ওষুধ লিখতে বাধ্য হবে। তা না করে ‘ডাক্তাররা জেনেরিক ওষুধ কেন লেখে না’ বলে জনসাধারণেকে ডাক্তারদের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে রাজনৈতিক নেতারা ফয়দা তোলে।
এরই নাম দ্বিচারিতা। আর এই দ্বিচারিতার জন্যেই সরকার নিয়ন্ত্রিত সংস্থাগুলোকে বারে বারে ডিগবাজি খেতে হয়।
তথ্যসূত্র