আমি একজন অরাজনৈতিক মানুষ। প্রথমেই মাপ চেয়ে নিয়ে নিজেকেও প্রবঞ্চনা করা কিছু কথা বলি।
সুদূর অতীতে আমার একটা অরাজনৈতিক ছেলেবেলা ছিল। কিছু পরের ছাত্রজীবনে বাম ছাত্র রাজনীতির কবলে পড়েছিলাম। সরকারি ডাক্তার সংগঠন যেটির সদস্য ছিলাম ও আছি, সেটির অপ্রকাশ্য রাজনৈতিক ইনক্লিনেশনেও সন্দেহ নেই।
এতদসত্ত্বেও আমি নিজেকে একজন কনফিউজড অরাজনৈতিক ব্যক্তি বলে ভাবি যে কিনা কোনও রাজনৈতিক ম্যান্ডেট না মেনে, হয় তো বা ভুলভাল তবু নিজের পছন্দ আর স্বাধীনতা নিয়ে থাকতে চায়। অরাজনৈতিক মানুষের আরও অনেক স্তর বিন্যাস রয়েছে বলে আমার মনে হয়।
এক গুচ্ছ মানুষ আছেন আগমার্কা অরাজনৈতিক। তাঁরা গতকাল কিম্বা গতবছরের কোনও অন্যায়ের কথা আলোচিত হলেই, ‘চৌত্রিশ বছর’এর, কেউ বা ‘সত্তর বছর’এর ঘটে যাওয়া অন্যায়ের শোক-বিহ্বলতায় উথলে ওঠেন। এবং তখন প্রতিকার হয়নি বলেই এখন আর কেন প্রতিকার চাওয়া, ইত্যাদি বলে যথোচিত খোঁচা মারেন।সদ্য অন্যায়ের আলোচনাটা ভোঁতা হয়ে যায়।
আর একদল (এই রে দল বলে ফেললাম, দল মানেই তো রাজনীতি!) আবার শুদ্ধাচারী সন্ন্যাসী বা অতীতের হিন্দু বিধবাদের মত। তীব্র তাঁদের ছোঁয়াছুঁয়ি’র সংস্কার। এককালে যদি কেউ এঁটো হয়েছে রাজনীতি ছুঁয়ে, তার আর গতি নেই এঁদের বিচারে।
আর বহু মধ্যবিত্ত অরাজনৈতিক আছে যারা অরাজনীতির জামাটি গায়ে চড়িয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক পকেটে ঘুরে বেড়ায়। খুচরো পয়সা বা অন্য লোভে। ঢোকে বেরোয়। এদের অরাজনীতির সেই বাহারী জামায় কখনও থাকে মানবাধিকারের এমব্রয়ডারি কাজ, কখনও বা পরিবেশরক্ষার ক্যামোফ্লাজ।
এহ বাহ্য, আমরা… মানে আমি সমেত এই যে হরেক কিসিমের স্বঘোষিত ‘অরাজনৈতিক’ লোকজন, আমাদের কিন্তু এক জায়গায় বেজায় মিল। আমাদেরকে নিপীড়ন করে অথবা করে না, সুযোগ-সুবিধা দেয় অথবা দেয় না যে রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনা তা কিন্তু পরিচালনা করে পিওর রাজনীতিরই লোকেরা। এবং তাদের দেওয়া হুকুম তামিল করতেই হয় আমাদের।
এই জন্যেই কনফিউজড লাগে নিজেকে। তবে কি ‘অরাজনৈতিক’ কিছু পুতুল নিয়ে খেলছে রাজনৈতিক বালক-বালিকা-ব্যবসায়ী-চোর-ডাকাতেরা?
নানা স্তরের অরাজনৈতিক মানুষেরা চাক অথবা না চাক, রাজনীতিই তাদের জীবনযাপন সুখদুঃখ কন্ট্রোল করে চলেছে। চলবেও। কেন না রাষ্ট্র ব্যবস্থাটাই সেই রকম। এর মধ্যে ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ আমরা কজন একটাও মাছ ধরতে পারব তো?
আবার বলি, আমি কিন্তু কনফিউজড। এই ব্যাপারে তর্ক আমার সাধ্যাতীত। বোধাতীতও বটে।
শুরুতেই অনেক ভারি ভারি কথা বলা হয়ে গেল।
সেই সত্তরের দশকে, কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ঢাকুরিয়ার বাড়িতে গেছিলাম। ফার্স্ট ইয়ারে তখন। আমরা পাঁচজন। কী বিষয়? না একখানা লিটল ম্যাগাজিন বার করব আমরা। তার জন্য কবির একটা লেখা যদি পাওয়া যায়। আর সেই সঙ্গে, তাঁর সঙ্গে আলোচনা। আধুনিক পরিভাষায় বিপ্লব নিয়ে খানিক খেজুর করা।
সেই পরিকল্পিত ম্যাগাজিনের নাম রেখেছিলাম মাস্তুল। কোনওদিনই তা বেরোয়নি। তাই কল্পিত ম্যাগাজিনও বলা যায়। ম্যাগাজিনের জন্য আট আনা একটাকা করে চাঁদা বা মুষ্ঠিভিক্ষা করে প্রায় শত খানেক টাকা জোগাড় করেছিলাম। পুরো ফান্ড থাকত দেবদাসের কাছে। সে আবার মেডিক্যাল ছাত্র না। পরে কানপুর আইআইটিতে চান্স পেয়ে সেই কষ্ট সংগৃহীত তহবিল সমেত সে চলে যায়। নিজেদের টিফিন খরচা বাঁচিয়ে আমরা চাঁদার বহুলাংশ জনে জনে ফেরত দিয়েছিলাম, বহুদিন ধরে।
যাক্, কবিসাক্ষাতের কথায় ফিরি। তিনি কিন্তু বয়সে ছোট বলে আমাদের তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করেননি। যথেষ্টই গুরুত্ব দিয়ে অনেক কথা বলেছিলেন। কবিতাও দেবেন বলেছিলেন। অনেক কথা হয়েছিল বামপন্থা ও সমকাল নিয়ে। সবই ভুলে গেছি। শুধু মনে আছে, সে নিজে ডাক্তারি ছাত্র নয়, তবু দেবদাস মাতব্বরি করে বেশ গম্ভীর ভাবে জানতে চাইল, – আচ্ছা বীরেনদা (আমরা অন্যরা স্যার বা বিনা সম্বোধনে কাজ চালাচ্ছিলাম), এই যে ইতিহাসের সন্ধিক্ষণ, এই আসন্ন বিপ্লবে ডাক্তার হিসেবে আমার কী ভূমিকা হবে?
বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তার চোখে চোখ রেখে মৃদু হেসে তাকে বলেছিলেন, – তুমি কুষ্ঠরোগের একটা খুব ভালো ওষুধ বার কর। সেটাই হবে তোমার বিপ্লবী কর্তব্য, বিপ্লবকে তোমার তরফে দেওয়া সেরা উপহার। সেই রুগ্ন মানুষটা যেন সেরে উঠে বলতে পারে বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক।
এর বছর দশেক পর নতুন চাকরিতে জয়েন করার আগে কর্মরত এক সিনিয়র দাদাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, চাকরি ক্ষেত্রে ডাক্তারের রাজনৈতিক ভূমিকা কী হওয়া উচিত। সেই দাদা বলেছিল, – সব মানুষকে প্রাণ ঢেলে চিকিৎসা করবি। সার্ভিসটুকু দিবি। যেন কোনওদিন যদি সে জানতে পারে তোর রাজনৈতিক অনুরক্তির কথা, সে যেন তোর আদর্শটাকে শ্রদ্ধা করতে পারে।
বহুকাল বাদে কুয়াশাচ্ছন্ন স্মৃতি ভেদ করে এই সব কথাগুলো মনে পড়ে গেল।
আমার এক সিনিয়র ডাক্তার দাদা, প্রথম কলেজ জীবনে তিনি অতি বাম রাজনীতি করতে গিয়ে জেলও খেটেছেন, বর্তমানে অরাজনৈতিক, তিনি ফোন করেছিলেন।
সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক ফোন বলাই বাহুল্য। একটি আটমাসের বাচ্চার বাড়িতে স্পুটাম পজিটিভ টিবি রোগ ধরা পড়েছে এক জনের। বাচ্চাটার জন্য কী ব্যবস্থা, মানে প্রোটোকল কী?
সত্যি বললে আমিও বহুদিন টাচে নেই। টিউবারকিউলোসিস প্রোগ্রামের সঙ্গে যুক্ত এক ভাইকে ফোন করে শেষতম গাইডলাইন জেনে নিয়ে ওই দাদাকে আবার ফোন করলাম।
জানালাম সদ্য লব্ধ জ্ঞান। খুঁটিয়ে জেনে নিলেন সব। দাদা আমার ফোনটা পেয়ে খুব খুশি। বলা যায় আপ্লুত।
বললেনও সে’ কথা। – অরুণাচল এই যে তুই উদ্যোগ নিয়ে জেনে আমাকে জানালি, এ’টা খুব ভালো লাগল। এত আন্তরিক তুই… ইত্যাদি ইত্যাদি।
আমি লজ্জাই পেয়ে গেলাম। এমন কিছুই করিনি বলার মত। কী প্রোটোকল সেটাই জানিয়েছি মাত্র।
ফোনে সেটা জানাতে দাদা বললেন,.- তোর এই কাজটায় তুই বলিসনি কিন্তু আমি স্পষ্ট শুনতে পেলাম, ফিসফিস করে তুই বলছিস, বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক…