২০১২ সাল নাগাত প্রবীরদার সঙ্গে হঠাৎ-আলাপ। চেঙ্গাইল শ্রমিক-কৃষক মৈত্রী স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিজেকে দেখাতে এসেছিলেন। তখন অনেকগুলো ওষুধ খাচ্ছিলেন, আর খুব দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন। পুণ্যদা, ডা. পুণ্যব্রত গুণ, প্রবীরদার চিকিৎসা করছিল। তাতে প্রবীরদা বেশ ভাল হয়ে উঠলেন। প্রবীরদার ভাষায়, নতুন জীবন পেলেন। তারপরে যুক্ত হয়ে গেলেন স্বাস্থ্যকেন্দ্রের কাজে। বললেন, আমি এমনিতে তো বাঁচতাম না, বেঁচে যখন গিয়েছি সপ্তাহে একদিন এখানে কাজ করব। কাজ করতেন পারিশ্রমিক ছাড়াই। সেখানকার রোগীদের বোঝানো, নানারকম পরিকল্পনা, তার মধ্যে রইলেন। আমাদের স্বাস্থ্য=সংক্রান্ত বাংলা পত্রিকা ‘স্বাস্থ্যের বৃত্তে’, তার আসল দপ্তর ছিল চেঙ্গাইলেই। পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়লেন দ্রুতই। অন্যতম সম্পাদক ছিলেন একটা সময়, তবে চুপচাপ পত্রিকার কাজ করেছেন তার চাইতে ঢের বেশিদিন। বানানবিধি, হরফ, পত্রিকার ভেতরের নানা অংশ সাজানো, এসবের একটা বেশ জম্পেশ গাইডলাইন তৈরি করে ফেলেছিলেন প্রবীরদা। শুরু করেছিলেন পত্রিকার নতুন লেখক তৈরি করা। এক সময়ে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আমাদের জুনিয়ার ডাক্তারেরা প্রবীরদাকে দেখলে ঘাবড়ে যেত। কবে কোন লেখা দেবার কথা আদায় করে নিয়েছেন তিনি, আর সেই লেখাটা না দেওয়া তিনি স্রেফ মিটমিট করে হেসে যেতেন। লেখা না দিয়ে উপায় থাকত না।
আমাদের মতো সুখী মধ্যবিত্ত নিজেদের জীবনে যে সমস্ত অসুবিধা থাকলে দিনরাত মুখ গোমড়া করে অন্যদের সহানুভূতি কুড়ানো নিজের বার্থরাইট বলে মনে করি, তার অনেকগুলোই তাঁর ছিল। নিজের শরীর ভালো যাচ্ছিল না বহুদিন। অনেকগুলো ওষুধ খেতেন। হার্টের অপারেশন হয়েছিল। বাড়িতে প্রিয়জনের অসুস্থতা ছিল। কিন্তু সাদা দাড়ির মাঝখানে প্রসন্ন হাসি আর চশমার আড়ালে কৌতুকময় ঝকঝকে দুই চোখে কোনোদিন তার ছাপ দেখিনি। বছর দুয়েক আগে বৌদি প্রবল অসুস্থতা নিয়ে বাড়িতে পড়ে আছেন, আমরা দেখতে গেছি। প্রবীরদা ঐ হাসিমুখেই বললেন, ভাববেন না, আমিই আগে যাব। বিশ্বাস করিনি।
হঠাৎ ২৮ জুন সকালে ফেসবুকে শ্রী মানব চক্রবর্তীর লেখা চোখে পড়ল। তিনি লিখেছেন– “এইমাত্র খবর এল আমাদের অত্যন্ত প্রিয় মানুষ প্রবীর গঙ্গোপাধ্যায়ের জীবনাবসান হয়েছে সাড়ে দশটায়, মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের কারণে। লেখালিখি করতেন। ‘মার্কসবাদের ভিত্তি’ নামে চমৎকার একটা পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন গত শতকের আশির দশকে। প্রাঞ্জল ভাষায় ও নির্ভুল ছাপায় প্রকাশিত সে-পত্রিকা পড়া ঋদ্ধিলাভের একটা উপায় বলে মনে হয়েছিল সেসময়। তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতানির্ভর কিছু বিশ্লেষণী গদ্যের একটা সংকলনের কথা মনে পড়ছে, যার নাম ‘দর্পণে রেখেছি মুখ’। ‘জলার্ক’ আর ‘বাহা’ পত্রিকায় তাঁর গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ পড়েছি। আর-একটা বড় কাজ তিনি করেছিলেন, সাহিত্য সংসদ থেকে প্রকাশ করেছিলেন ‘ড. হৈমবতী সেনের উপাখ্যান’ নামের আয়তনবান একটি অনুবাদগ্রন্থ, যাতে উনিশ শতকের এক সংগ্রামী স্বাধীনচেতা নারীর সহস্র প্রতিকূলতার মধ্যে ডাক্তার হয়ে ওঠার কাহিনি বিধৃত হয়ে আছে। এ-সবের পরে যা বলার তা হল এই যে প্রবীর গাঙ্গুলির মতো সৎ উদার চিন্তাশীল এক বন্ধুকে হারিয়ে আমার ব্যক্তিগত রিক্ততার ভার আরও দুঃসহ হয়ে উঠল।”
‘স্বাস্থ্যের বৃত্তে’ পত্রিকায় ‘ডা হৈমবতী সেনের জীবনকথা’ নিয়মিত প্রকাশিত হয়েছিল। ২০১৭ তে কে পি বাগচী অ্যান্ড কোম্পানি তাঁর ‘দর্পণে রেখেছি মুখ’ আর ‘জনসংখ্যার রাজনীতি’ এই দুটি বই প্রকাশ করে। প্রথমটি নিয়ে মানব চক্রবর্তী বলেছেন। আর দ্বিতীয়টি ছিল “মুসলমানেরা গণ্ডায় গণ্ডায় বাচ্চা পয়দা করে হিন্দুদের সংখ্যালঘু করে দিচ্ছে”—প্রায় ডান-বাম নির্বিশেষে এই ‘হিন্দু বিশ্বাস’-টিকে যুক্তি আর তথ্য দিয়ে একেবারে পথে বসিয়ে দেওয়া একটি অসাধারণ গ্রন্থ। এর ওপরে প্রবীরদা বাংলা মান্থলি রিভিয়ু সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য ছিলেন শেষদিন অবধি।
এই সমস্ত বড় মাপের কাজ ছাড়াও প্রবীরদা আমাদের দিয়ে লিখিয়ে নিতেন, আবার সেগুলো বই করে প্রকাশের দায় নিজের কাঁধেই চাপিয়ে নিতেন। আমাদের মনঃচিকিৎসক ডা. সুমিত দাশ আর মনোবিদ রুমঝুম ভট্টাচার্যের খুব কাজের কয়েকটা লেখা একত্র করে কলেজ স্ট্রিটের প্রকাশককে দিয়ে একটা বই করেছিলেন, তার নাম ছিল ‘রোগ যখন মনে’। ডা. পুণ্যব্রত গুণের লেখা ‘ওষুধবিষুধ কিছু দরকারি কথা’, ‘পা মিলিয়ে পথচলা’–এগুলোও প্রবীরদা নিজেই উদ্যোগ নিয়ে প্রকাশ করেছিলেন। প্রবীরদার তাড়াতেই আমার আর ডা. শর্মিষ্ঠা দাসের লেখা চর্মরোগের ওপর একটা বই ‘কিছু সাধারণ চর্মরোগ ও তার চিকিৎসা’ প্রকাশ হয়েছিল। আশ্চর্যের ব্যাপার হল, বইয়ের দ্বিতীয় সংস্করণ বেরনোর পরে সম্মান-দক্ষিণাও পেয়েছিলাম আমরা! নিজের ব্যাপারে ভোলেভালা ছিলেন প্রবীরদা, কিন্তু অন্যদের জন্য যা করতেন তাতে ষোল আনা পেশাগত দক্ষতা প্রয়োগ করতেন।
মানব চক্রবর্তী প্রবীরদাকে যতটা দেখেছেন, আমি ততটা দেখিনি। শুনেছিও কমই, কারণ নিজের কথা বলার অভ্যাসটাই প্রবীরদার কোনোদিন ছিল না। কথায় কথায় একদিন জানা গেছিল, তাঁর বাড়ির মেঝেতে বইয়ের গাদা। কেন সেগুলো আলমারিতে সুশোভিত হয়ে ওঠেনি, সে প্রশ্ন বাহুল্যবোধে কেউই করেনি।
আমরা জানতাম কেউ কেউ পারে। তুচ্ছ করতে পারে সমস্ত বহিরঙ্গের আতিশয্য। হাসিমুখে উড়িয়ে দিতে পারে শরীরের সব কষ্ট, এমনকি মৃত্যুভয়। কেউ কেউ ভালবেসে যেতে পারে মানুষকে। আমৃত্যু।
প্রবীরদাকে হারানো অনেকটা একজন অভিভাবক হারানো। প্রবীরদার মত মানুষকে এইটুকু পরিসরে ধরা কঠীন। কিন্তু জয়ন্তদার লেখায় অনেকটাই উঠে এসেছে তার নানা দিক।
জয়ন্তদার স্মৃতিচারণ আবেগের আতিশয্য বর্জিত ও যথার্থ। আমি প্রবীরবাবু কে আরও কম দেখেছি তবে ওনার সৌম্যকান্তি চেহারা, মুখের মৃদু হাসি ও মৃদুভাষ ভোলার নয়। কিছু মানুষ থাকেন যাঁরা বৃহত্তর সমাজের স্বার্থে কাজ করেন ও খুব নি:শব্দে করেন। প্রবীর গাঙ্গুলি মহাশয় তেমনই একজন ব্যক্তিত্ব।
জয়ন্ত দা কে ধন্যবাদ । প্রবীর গঙ্গোপাধ্যায় এর মত অসাধারণ অথচ নীরব সম্পাদকের কথা স্বল্প পরিসরে লিখেছেন , যাতে তাঁর সব চারিত্রিক বৈশিষ্টাগুলি ধরা পড়ে
। ভীষণ মৃদুভাষ এবং ঐ মিটিমিটি করে হাসি ওনার USP ছিল । দুঃখের বিষয় এই ধরণের মানুষদের প্রকৃত মূল্যায়ন আত্ম প্রচার মত্ত বর্তমান সময়ে ও সমাজে হয় না ।
আমাদের কাছে উনি দীর্ঘ দীর্ঘ দিন বেঁচে থাকবেন ।
A man of integrity with a capital I. To borrow a phrase from the late Hiren Mukherjee, Prabir, in his own way, was a gentle colossus.
মানুষটি যেমন ছিলেন ,ঠিক সেভাবে পাঠকের সামনে তুলে ধরা সহজ কাজ নয় ,ধন্যবাদ লেখক ডঃ জয়ন্ত দাস
হৈমন্তী সেনের বইটি অনুবাদ গ্রন্হ নয় । তপন রায়চৌধুরী সম্পাদিত ইংরেজি বইটি পড়েছি , প্রবীরবাবুর বাড়িতে দীর্ঘ আলোচনা হয়েছে বইটিতে তাঁর মৌলিক ভাবনা ধরা আছে ।
প্রবীরবাবুর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা এবং পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাই।
প্রবীরবাবুর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা এবং তাঁর পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করছি।