প্রেসক্রিপশন লেখার জন্য কলমটা তুলে নিতেই টেবিলের ওদিকে বসা রোগী প্রায় দমবন্ধভাবে বলে উঠল, “স্যার, ওষুধ কি আবার বাড়াবেন?”
আমি করুণ চোখে তার দিকে চেয়ে বললাম, “তা না করলে সিমটম তো থেকে যাবে! অসুখটা তো সারতে হবে, না কী?”
করুণ চোখে তাকানোর কারণ আছে। বহু বছর ডাক্তারি করছি। রোগীর কাছে — বিশেষত আমার কাছে যাঁরা আসেন, তাঁদের কাছে ওষুধ খাওয়াটা কেমন যেন হেরে যাওয়ার লক্ষণ। মনের রোগ আর শরীরের রোগের একটা বড়ো পার্থক্য এই, যে মানুষ নিজের শরীরের ওপর নিজের কর্তৃত্বের অভাবটা যত সহজে মেনে নিতে পারে, মনটা আর নিজের আয়ত্ত্বাধীন নেই, সেটা অত সহজে মানতে পারে না। এদিকে ক্রনিক অসুখ তো আর সে সেন্টিমেন্ট মানবে না… আর অসুখের সঙ্গে দরাদরি করতে না পেরে রোগী ডাক্তারের সঙ্গেই বোঝাপড়া করতে চান — ‘ওষুধ কি খেতেই হবে? ডাক্তারবাবু, কম ওষুধ দেবেন…’ নিদেন, ‘বেশি কড়া ওষুধ দেবেন না’, বা, ‘ডোজ-টা কম রাখবেন…’ এ অনুরোধ শুনে শুনে জেরবার। রোগীর কথা শুনলে মনে হবে না যে রোগের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ডাক্তার রোগীর পক্ষে, রোগের পক্ষে নয়।
মনের অসুখের আরও একটা সমস্যা। হাত-পা-মাথা-মুখ অটুট রয়েছে, শরীরে কোথাও ব্যথা-বেদনা-জ্বর-সর্দি-পেট খারাপের মতো কাহিল করা কষ্ট নেই, নেই ঘা, নেই টিউমার, এমনকি রক্তপরীক্ষা, এক্স-রে, স্ক্যান করেও কিছু ধরার উপায় নেই। ফলে অসুখের একমাত্র দৃশ্যমান লক্ষণ হয়ে দাঁড়ায় ওষুধ, এবং যেহেতু ডাক্তারবাবু সেটা লিখে দিচ্ছেন, ওষুধ আর ডাক্তার হয়ে দাঁড়ায় ভিলেন। এই ছেলেটির অসুখ তো সারতে চাইছিল না, সেরকম পরিস্থিতিতে তো বটেই, সারলেও এই দশা-ই হয়।
প্রায় তিরিশ বছর আগে চেম্বারে আসা সেই সত্তর বছর পার করা বৃদ্ধের কথা ভুলতে পারি না, ভুলতে পারি না তাঁর স্ত্রী-কেও। পঁয়তাল্লিশ বছর আগে বিয়ে করা বউকে তখনও অবধি কোনও সাইকিয়াট্রিস্ট দেখাতে পারেননি। কিন্তু চেষ্টাও ছাড়েননি। তাই পাড়ার পলিক্লিনিকে নতুন সাইকিয়াট্রিস্টের নাম দেখে এসেছিলেন খোঁজ নিতে।
কী ভাবে মহিলাকে আমার সামনে আনতে পেরেছিলাম সেটাও এক কাহিনি, কিন্তু গর্ব করে বলার মতো নয়। সেজন্য বলছি না, তা নয়। এমনিতেই কাহিনির গতিমুখ একবার বদলেছে, আবার বদল করার দরকার দেখছি না। এতটুকু বলা-ই যথেষ্ট, যে শেষ পর্যন্ত ভদ্রমহিলা এসেছিলেন আমার কাছে। বুঝেছিলাম, উনসত্তর বছর বয়স্ক মহিলার প্রথম অবসেশনের সিমটম সম্ভবত আট, বা নয় বছর বয়সে দেখা গেছিল। নিয়মিত মা-বাবার চড়-থাপ্পড়-কানমলায় সেরে-ও গেছিল — অর্থাৎ মা-বাবাকে নিজের কষ্টের কথা বলাই বন্ধ করে দিয়েছিল মেয়েটা। বিয়ের পরে আবার প্রকাশ করতে পারেন, কিন্তু ওগুলো যে অসুখ, ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা যে হতে পারে, সেটা ভাবতেই পারতেন না। তাই স্বামী হাজার চেষ্টা করা সত্বেও চিকিৎসা হয়নি।
প্রথম তিনমাস পরে ফিরে এসে আমাকে প্রণাম করতে চেয়েছিলেন। এমনিতেই প্রণাম-টণামে চিরকালের অ্যালার্জি, তার ওপর তাঁর বয়স আমার ডবলেরও বেশি! আমি আঁতকে ওঠায় বলেছিলেন, “মানুষ বাবাকে প্রণাম করতেই পারে। তুমি আমার বাবা — এই বয়সে আমাকে নতুন জীবন দিয়েছ। এতদিন যেটা ছিল, তাকে জীবন বলে? ছ্যাঃ।”
বলেছিলেন বটে, কিন্তু তারপর থেকে যে বছর দশেক আমার কাছে অনিয়মিতভাবে এসেছিলেন, তা থেকে সেদিনের সেই অনুভূতির কোনও প্রকাশ পাইনি। ছয়, আট, দশ মাস পরে পরে, কখনও বছরখানেক বা দেড় বছর পরেও চেম্বারে ঢুকে বলতেন, “বাবা, তোমার ওষুধগুলো খেয়ে কী ভালো, কী ভালো ছিলাম! বন্ধ করে দিলাম, এখন কী খারাপ-ই না আছি!”
আমি অবাক হতাম, বলতাম, “ওষুধ খেয়ে ভালো থাকেন, তো বন্ধ করে দেন কেন?”
উনি জবাব দিতেন, “ব্লাডপ্রেশার, ডায়াবেটিস, লাংস, হার্ট, কিডনি, আর্থ্রাইটিস… ব্যামোর তো অভাব নেই। সারা দিনে বাইশটা-পঁচিশটা ওষুধ খেতে হয়। বিরক্ত হয়ে যাই, শেষে রাগ করে বন্ধ করে দিই।”
একবার কৌতুক করে বলেছিলাম, “আমার তো মাত্র একটা ওষুধ। সেটার ওপরই কেবল রাগ করেন, না বাকি বাইশটাও রেগে বন্ধ করে দেন?”
চোখ কপালে তুলে বলেছিলেন, “পাগল হয়েছ বাবা! ওগুলোর একটা-ও বন্ধ করলে তো মরেই যাব!
আমার চিকিৎসার আগে যিনি নাকি বেঁচেই ছিলেন না, তাঁর এই মনোভাবের হদিশ আমি অনেক ভেবেও পাইনি।
দেখো, কী বলতে গিয়ে কী সব বলে ফেললাম। যা হোক, ফিরে আসি প্রথম রোগীর কথায়। তাকে বললাম, “ওহে, তোমার সিমটম তো কমতে হবে। ডোজ কম থাকলে তো কনট্রোল হচ্ছে না!
সে বলল, “ইয়ে সব সাইকিয়াট্রিক বিমারি ঔর ইলাজ সব বকোয়াস হ্যায়। অর্থাৎ, মানসিক রোগ এবং তার চিকিৎসা — সবই ফালতু।”
সে-ও একটা মতবাদ বইকি, কিন্তু সেটা সাধারণত যারা অসুস্থ নন এবং অন্যের কষ্টের মূল্য দেন না, তাঁদের মনোভাবে প্রকাশ পায়। ভুক্তভোগীর এ চিন্তা কেন? অবাক হয়ে বললাম, “সে কী রকম? তুমি নিজেই তো ভুগছ হে!”
সে বলল, “ভুগছি তো আমি গরিব বলে। আমার পয়সা থাকলে থোড়াই কষ্ট পেতাম। আপনার কাছে এসে ওষুধও খেতে হত না। ”
আমি আরও অবাক। ব্যাটা তোর চশমা নোংরা হয়ে গেছে বলে দিনরাত চশমা মুছিস, আর কোনও কাজ করে উঠতে পারিস না। জানতে চাইলাম, “অনেক পয়সা থাকলে এর কোনটা হত না?”
সে অম্লানবদনে বলল, “অনেক পয়সা থাকলে আমি একশোটা লোক রাখতাম আমার চশমা মোছার জন্য। আর আমার চশমা থাকত একশো একটা। যেমনই মনে হত এই চশমাটা নোংরা, তেমনই দিয়ে দিতাম একশো নম্বর পোছনেওয়ালাকে, আর এক নম্বর পোছনেওয়ালার হাত থেকে পরিষ্কার চশমাটা নিয়ে পরে নিতাম। এক নম্বর পোছনেওয়ালা দু নম্বরের হাত থেকে, দুনম্বর নম্বর তিন নম্বরের হাত থেকে, তিন নম্বর চারের হাত থেকে চশমা নিয়ে নিয়ে মুছতে থাকত — অ্যাসেমব্লি লাইনের মতো। বলুন ডাক্তারবাবু, তাহলে আমাকে আসতে হত সাইকিয়াট্রিক চিকিৎসার জন্য? এইজন্যই বলছিলাম, সাইকিয়াট্রি কা বিমারি সির্ফ পয়সা কা কমি হ্যায়। পয়সা রহনে সে ইয়ে সব বিমারি কুছ হোতা নেহি হ্যায়।”
কথাটা মোটেই সত্যি নয়, বরং আমার অভিজ্ঞতায় অতি বড়োলোক আর অতি গরিবের মনোরোগ হলে ভয়াবহ বেশি কষ্ট মধ্যবিত্তের তুলনায়, কিন্তু ওকে সে কথা বোঝানোর উপায় ছিল না — একটা অন্য কথা মনে পড়ে গেছিল।
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর-ই সম্ভবত কোনও এক জীবনীগ্রন্থে বলেছিলেন যে তাঁদের এক আত্মীয় ছিলেন, যাঁর মহলে সর্বদাই একটি কাজের ছেলে থাকত, যার দায়িত্ব থাকত সারা মহলের সব টেবিলের চারপাশের চেয়ার, দেওয়ালের ছবি — সব চুলচেরা হিসেবে ‘সোজা’ করে রাখা। সবসময়, প্রতিনিয়ত। একবারও যদি তাঁর চোখে পড়ত যে টেবিলের পাশের ব্যবহার-না-হওয়া চেয়ার, বা দেওয়ালে ঝোলা ছবি ঠিক সোজা নেই, সঙ্গে সঙ্গে চাকরি যেত সেই ছেলেটির। বাড়ির অন্যান্য বাবুরা এই খামখেয়ালিপনার বিষয়ে ওয়াকিবহাল ছিলেন, তাই সেই ছেলেটি, বা তার বাড়ির কেউ গিয়ে কেঁদে পড়লে তাঁরাও ‘আহা রে’, বলে হুকুম দিতেন ছেলেটিকে অন্য কোথাও বহাল করে নিতে। হয়ত সহিসের সহকারী, বা কোচওয়ানের অ্যাসিসট্যান্ট কিংবা নিদেন অ্যাপ্রেন্টিস পাঙ্খা পুলার। ওদিকে আর একটি ছেলের খোঁজ পড়ত, চেয়ার-টেবিল-ছবি সোজা রাখার জন্য। বাড়ির কর্মচারীরা খুব উৎসাহভরে এই কাজের জন্য নিজের, ভাইয়ের, বা বোনের ছেলেদের সাপ্লাই দিত — জানত, কিছুদিনের মধ্যেই ছবি বা চেয়ার টেবিল এক-সুতো সরে রয়েছে বলে চাকরি যাবে, আর তখন একটা ভালো, পার্মানেন্ট কাজ পাওয়া যাবে অতি সহজে।
টাকা থাকলে কিছু কিছু রোগের চিকিৎসা করতে হয় না বইকি!
প্রেসক্রিপশনটা লিখতে লিখতে বললাম, “বেশ, তবে এমন চিকিৎসা করার চেষ্টা করি, যাতে তুমি সেরে উঠে অনেক টাকা রোজগার করতে পার, আর তারপর একশো একটা চশমা মোছার জন্য একশোটা মুছনেওয়ালা বহাল করতে পার।”