আজ তিনি আবার এলেন। চেম্বারে ঢুকলেন। আমার ঘরের চড়া আলোগুলো আদিখ্যেতা করে একটু ঝিমিয়ে পড়ল। চেয়ার টেবিলগুলোও একটু গা ঝাড়া দিয়ে নিল, যাতে একটুও ধুলোর গন্ধ না থাকে। প্রতিবারের মতো এবারেও ঘরটা দামী বিদেশী পারফিউমের গন্ধে ভরে উঠল। খুব হাল্কা মিষ্টি গন্ধ। ওনার বয়েজ কাট পাকা চুল। রাস্ট কালার মেটাল ফ্রেমের চশমা–হাফ রিম। কনুই পর্যন্ত হাতা, সাদা আর ইনডিগো হ্যান্ডলুম প্রিন্টের ব্লাউজ, সাদা কালো টেম্পল পাড় হ্যান্ডলুমের শাড়ি। কানে কুচি হীরের দুল। গলায় ফিনফিনে একটা চেন। সফট শেড লিপস্টিক। ভদ্রমহিলা বেশ লম্বা। বয়স আশি ছুঁই ছুঁই। নীচে রাবার ক্যাপ দেওয়া হাতের লাঠিটাও মনে হয় অলঙ্কার। উনি কালো না ফর্সা বলতে পারব না, এ বিষয়ে আমি রঙকানা –অন্তরের দ্যুতি ছাড়া গায়ের রঙ কিছু দেখতে পাই না। উনি ঢুকলে আমি বেশ কিছুক্ষণ ওনার দিকে তাকিয়ে থাকি। ভালো লাগে। এরপর উনি আরম্ভ করেন –ডক্টর, ওয়ান মোর স্লিপলেস নাইট অ্যান্ড রেস্টলেস ডে। মেডিসিন কিছু কাজ করছে না। কি অসহ্য ইচিং।
উনি কষ্টের বিবরণ দিয়ে যাবেন। আমি ধৈর্য্য ধরে শুনে যাব। তারপর ওনাকে পরীক্ষা করব। যদি বলি –আপনার স্কিনে অসুখ নেই কিছু, উনি বড় অসুখী হবেন। সুতরাং গম্ভীরমুখে ভাবব–তারপর হয়তো সামান্য কিছু ওষুধ লিখে বলব –আর আসার দরকার নেই। এই এই নিয়ম মেনে চলবেন। বয়স হলে চামড়া একটু শুকনো হয় –এই তেল, সাবান, ময়শ্চারাইজার মাখবেন। এই ওষুধ খাবেন । আর দেখাতে আসার প্রয়োজন নেই। প্রেসক্রিপশন হাতে দিয়ে বলব — জীবনের এক একটা সময় এক একরকম সুন্দর। ভালো কিছু একটা নিয়ে সময় কাটান। ক্রিয়েটিভ কিছু কাজ শুরু করুন। উনি ছোট্ট একটা মিষ্টি শ্রাগ করে বলবেন –মার্গারেট মিচেল হলে লোনলিলেস কাটাতে একটা ‘গন উইথ দ্য উইন্ড’ লিখে ফেলতাম। তা যখন নই– ।
আমি জানি ওনার ছেলে বিদেশে। স্বামী দশ বছর আগে মারা গেছেন। আর্থিক অবস্থা বেশ ভালো। আয়া সম্বল করে একা থাকেন। দুটো হাঁটু রিপ্লেসমেন্ট হয়েছে। ওনার ডিপ্রেশনের ওষুধ চলে। এক সময়ে ক্লাব, পার্টি, বন্ধু, ট্রাভেলিং সবই ছিল– বেশ প্রবল ভাবে। এখন কোনো সঙ্গী নেই। এটাও জানি — পাড়ায় ছেলের বৌয়ের নিন্দে করা আর নাতিনাতনির রেজাল্টের বড়াই করা কাকিমা মাসিমাদের সঙ্গে উনি মিশতে পারেন না। স্বঘোষিত নাস্তিক বলে কোন ধর্মীয় সংগঠন বা পুজো আচ্চার বালাই নেই। সমবয়সী আত্মীয় বন্ধু কেউ ওপারে, কেউ উদ্বাস্তু হয়ে ছেলেমেয়ের কাছে। কমবয়সীদের ঘড়িতে আজকাল ফুরসতের কাঁটা বলে কিছু নেই। পড়ানোর চাকরি থেকে অবসরের পরে কিছু সোশ্যাল ওয়ার্ক করতেন, এখন মোটেই শারীরিক সামর্থ্য নেই। আমি জানি – ওনার দুচোখে গ্লকোমা, এক চোখে রেটিনাল ডিটাচমেন্ট। পড়তে ভালোবাসেন কিন্তু বেশি পড়া নিষেধ। আগে ছেলের কাছে যেতেন মাঝে মাঝে, এখন একটানা অতটা জার্নি, আমেরিকা যাবার ধকল নিতে পারেন না।
সুতরাং —সামনে পিছনে ডাইনে বাঁয়ে কোনো ছোট স্বপ্নপূরণের টার্গেটও নেই –এমন মানুষকে খুশি রাখতে কি আর বলতে পারি! যাবার সময় প্রতিবারের মতো বলি –আপনি এখনো কি গ্রেসফুল দেখতে। উনি মৃদু হেসে ঘুরে দাঁড়াবেন –ইউ আর জোকিং। আমি বলব –মোটেই না। আপনি কলেজ লাইফে দিনে কটা লাভ লেটার পেতেন বলুন তো? উনি বলবেন–ওহ, ইউ নটি গার্ল। আমার মিরান্ডা হাউসের সেই দিনগুলোর কথা মনে করিয়ে দিলে —
এর পর ওনার আয়া তাড়া দেবেন–চলুন মাসিমা, দেরি হয়ে যাচ্ছে। আমার চেম্বারের দিদিমণিও রাগ চাপা স্বরে হাঁক পাড়বেন –বারো নম্বর বারো নম্বর, ঢুকে যান ঢুকে যান।
আমি পরের রোগীর দিকে মন দেব। জানি উনি আবার আসবেন কিছুদিন পর। ওনার যে গা চুলকানির অনুভূতি –তার উৎস তো চামড়ায় নয়, মস্তিষ্কে। Psychosomatic Pruritus বা Functional Itch Disorder. অনেকেরই হয় এমন।
ওনার আয়া একদিন চুপি চুপি আমাকে বলেছে –আপনার কাছ থেকে ঘুরে যাবার পর উনি বেশ কদিন খুব ভালো থাকেন ওষুধ ছাড়াই। তারপরেই আবার মাথা খারাপ করে দেন। সেবারও বলেছিলাম ওই একই কথা –ইউ আর সো গ্রেসফুল টিল নাউ। তারপর পুনশ্চ – স্টুডেন্টদের কাছে নিশ্চই আপনি খুব পপুলার ছিলেন? বাড়ি ফিরে নাকি কদিন ধরে আয়া, কাজের লোক সবাইকে বলেছিলেন –তোরা আমার সঙ্গে এত খ্যাচখ্যাচ করিস, আমার কথা শুনিস না — দ্যাখ, ওই ডাক্তার ম্যাডাম আমাকে ঠিক চিনেছেন। আমাকে সেই সময়ে যদি দেখতিস। করিডোরে হাঁটলে কোনো ক্লাস থেকে কোন শব্দ আসত না — পুরোটা সোলো অ্যাক্টিং করে পড়াতাম জুলিয়াস সিজার। দিনের আয়া অমনি বলে উঠবে –আমারো সিজার হয়েছিল গো বৌদি, সেই জন্য তো ভারী জিনিষ তোলা বারণ। শুনে উনি এক্কেবারে চুপ মেরে যাবেন আবার।
আবার আসবেন কিছুদিন পর — সেই অনুযোগ -নিদ্রাহীন রাত্রি আর বিশ্রামবিহীন দিন, ওষুধে কাজ হচ্ছে না। ওনার আয়া আমাকে এক ফাঁকে বলেছে –ডাক্তার দেখাতে আসার কদিন আগে থেকেই উনি শাড়ি ব্লাউজ, গোছান। বেশ খুশি থাকেন। সকাল থেকে বার বার কানের দুল এটা পরেন, ওটা পরেন– আয়নায় দেখেন। বেড়ানোর জায়গা তো ওই একটাই –ডাক্তারখানা। আমার কাছে আসার দিন আরো বেশি সময় দিয়ে নিজেকে পরিপাটি করেন। আমাকেও ভেবে ভেবে প্রতিবার নতুন নতুন কমপ্লিমেন্ট খুঁজতে হয়। সাজানো কথা হলেও অন্তঃনির্যাসটুকু মিথ্যে বলি না। শুধু ওইটুকু তো কথা —তা যদি ওষুধের কাজ করে মন্দ কি!
এই উনি কিন্তু একজন নন –প্রকৃতপক্ষে ওনারা। বয়স্ক একা মানুষের সংখ্যা ক্রমশঃ বাড়ছে। ততোধিক গুণিতকে বাড়ছে সমস্যা। কেউ আজীবন ডাঙায় নেচেকুঁদে হেসেখেলে শেষ বয়সে জলে পড়েছেন, কেউবা সারা জীবন ধরে জল সাঁতরে চলেছেন—ডাঙার খোঁজ এজন্মে অধরাই থেকে গেল।
ছবি –ভ্যান গখ