আমরা একটা দমবন্ধ করা পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। চারদিকে কোভিডের আতঙ্কের মাঝেই যুক্ত হয়েছে রক্ত না পাওয়ার আতঙ্ক। থ্যালাসেমিকদের একটা বড়ো অংশের রক্তের যোগান আসে বেসরকারি ব্লাড ব্যাংকগুলি থেকে। পশ্চিমবঙ্গের সরকারি হাসপাতালে থ্যালাসেমিয়া ম্যানেজম্যান্ট জাতীয় কিংবা আন্তর্জাতিক গাইডলাইন মেনে হয় না। এখন ‘কেন হয় না?’, ‘হওয়া উচিৎ!’ জাতীয় বিতর্কের পাশাপাশি আসল পরিস্থিতি এবং তার থেকে সার্ভাইভ করার অপটিম্যাল স্ট্র্যাটেজি আমাদেরই খুঁজতে হবে।
আমরা যারা অ্যাডাল্ট থ্যালাসেমিক রয়েছি, আমরা আমাদের সমস্যা নিয়ে কতোটা সরব? যাঁরা প্রায় স্বাভাবিক শারীরিক বহির্গঠন পেয়েছেন তাঁরা নিজেদের থ্যালাসেমিক হিসেবে কতোটা পরিচিতি গড়ে তুলেছেন মানুষের সাথে? আবার যাঁরা ছোটো থেকেই সুচিকিৎসার অভাবে শরীরে আমারই মতো মঙ্গলোয়েড ছাপ ধরে রেখেছেন তাঁরাই বা কতোটা মানুষকে বোঝাতে পেরেছেন নিজেদের সমস্যার কথা?
তাই বছরের পর বছর যুগের পর যুগ ধরে থ্যালাসেমিয়া শুধুমাত্র একটা শিশুদের সমস্যা এবং পাড়ার রাজনৈতিক দাদাদের সমাজসেবার উপাদান হিসেবে থেকে গেছে।
আমি একজন থ্যালাসেমিক, বেঁচে থাকার জন্য আমার রক্ত লাগে, ওষুধপত্র লাগে, পরিকাঠামো লাগে। আমি ভোট দিই, সেই ভোটে সরকার আসে, আমারও শ্রমের মূল্য আছে দেশের জিডিপি-তে। আমার বাঁচার অধিকার আছে, সুচিকিৎসা পাওয়ার অধিকার আছে। এই অধিকার পেতে গেলে সবার আগে নিজের অবস্থান স্পষ্ট করতে হবে সমাজের কাছে।
“আমি একজন থ্যালাসেমিক। আমার রক্ত লাগে বেঁচে থাকার জন্য। আমার জন্য রক্তদান শিবির করুন।” এই কথাগুলি সোচ্চারে বলতে কেন ভয়? কেন এতো কুণ্ঠা? অন্য কেউ আপনাকে দয়ার পাত্র হিসেবে প্রজেক্ট করার আগে নিজেই নিজের কথা বলে ফেলুন। দেখবেন ভেতর থেকে জিতে যাওয়ার অনুমতি আসবে। আমাদের সামাজিক সম্মান প্রতিষ্ঠা এভাবেই গড়ে নিতে হবে।
আজ পশ্চিমবঙ্গে যতো রক্তদান শিবির হয় তার সিংহভাগের ওপরেই লেখা থাকে “থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত শিশুদের সাহায্যার্থে”। অথচ উদ্যোক্তারা থ্যালাসেমিকদের জন্য ঠিক কী ধরনের রক্ত লাগে সেই তথ্যই জানেন না। ন্যাশনাল ব্লাড ট্রান্সফিউশন কাউন্সিল (NBTC) এবং ন্যাশনাল হেল্থ মিশন (NHM)-এর নির্দেশিকায় স্পষ্ট বলা রয়েছে থ্যালাসেমিকদের জন্য ফেনোটাইপ ম্যাচড কনসেনট্রেটেড আর বি সি প্রয়োজন। অথচ বেশিরভাগ ব্লাড ব্যাংকে কম্পোনেন্ট সেপারেটরই নেই। সামান্য একটা ১৫/ ২০ লক্ষ টাকার সেন্ট্রিফিইউজ মেশিন কেনার সামর্থ্য নেই সরকারের?
রাজ্যের ৩০ হাজার থ্যালাসেমিকের জীবনের মূল্য নেই? তাঁদের জন্য দায়বদ্ধতা নেই?
এই সব প্রশ্ন, দাবী, আন্দোলন তোমাকে আমাকেই করতে হবে। একজন থ্যালাসেমিক হয়ে অন্যের সমস্যা বুঝে ওঠার চেষ্টা করতে হবে, মানবিক হতে হবে। সমাজসেবা করবো, খ্যাতির জন্য কাজ করবো এই মানসিকতা পরিত্যাগ করে দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের কথা ভাবতে হবে।
যেদিন জীবনে প্রথম রক্তদান শিবির করেছিলাম সেদিন বাধ্য হয়ে করেছিলাম। বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে ভিক্ষের মতো মানুষের কাছে রক্ত ছেয়েছিলাম। কিছু মানুষ দরজা বন্ধ করে দিয়েছিলেন, কিছু মানুষ থ্যালাসেমিয়ায় কী খাওয়া উচিৎ কী খাওয়া উচিৎ নয় বুঝিয়েছিলেন, কিছু মানুষ রক্তের বদলে অমুক তমুক ওষুধের নাম বলেছিলেন, কিছু মানুষ চায়ে চুমুক দিতে দিতে তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছিলেন আমার আবেদন আর বলেছিলেন বেসরকারি ব্লাড ব্যাংক রক্ত নিয়ে ব্যবসা করে। এই সমস্ত কিছুই ধৈর্য্য ধরে শুনেছিলাম, দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করেছিলাম সব। হাসিমুখে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলাম। ক্যাম্পের দিন এসেছিলেন মানুষ। ওই মানুষদের মধ্যে থেকেই এসেছিলেন। এভাবেই মানুষ থেকে মানুষ আসেন। আমাদের চেষ্টাটুকু করতে হবে।
থ্যালাসেমিকদের কাছে অনুরোধ অন্ততঃ নিজের সমস্যার কথা, নিজের প্রয়োজনের কথা বলুন, লিখুন, সোশ্যাল মিডিয়া একটি খুব বড়ো প্ল্যাটফর্ম, এটিকে ব্যবহার করুন।
কিছু cancer রোগীর কথা শুনেছি, যাঁরা নিজেদের ও অন্যান্য ভুক্তভোগীদের সমস্যার কথা প্রকাশ্যে বলেন, সমবেত প্রচেষ্টার কথা বলেন। থ্যালাসেমিকদের বড় অংশই শিশু বা teenager. তাঁদের সমস্যার কথা এতো বলিষ্ঠ ভাবে আগে কাউকে বলতে শুনিনি। অত্যন্ত প্রতিকূল পরিবেশে বেড়ে উঠা এই শিশুদের লড়াই করতে হয় অকল্পনীয় এক মানসিক প্রতিকূলতার বিরুদ্ধেও, যা বোধহয় কল্পনাও করতে পারি না আমরা। সেই প্রতিকূলতার মধ্যে দাঁড়িয়ে পুষ্পেন্দুবিকাশের এই নিবন্ধ পড়ে আমি অভিভূত। শাবাশ পুষ্পেন্দু, শাবাশ। আপনি দৃষ্টান্ত। আপনার কাছ থেকে অনেক প্রত্যাশা রইল।