বিষক্রিয়ায় মৃত্যু হয়েছে রাজার। সংবাদটা ছড়িয়ে পড়া মাত্রই রাজ্য জুড়ে শুরু হয়ে যায় চাপা গুঞ্জন- রানিই বিষ প্রয়োগ করে হত্যা করেছেন রাজাকে। কারণ, অন্য কোথাও তো নয়, নিজের বিলাস বহুল ভোজন কক্ষেই মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে রাজাকে। রানি ছাড়া আর অন্য কারও পক্ষেই সেই ভোজন কক্ষে ঢোকা সম্ভব নয়। এমনই তর্ক বিতর্ক চলছে রাজ্যে জুড়ে। তবে রাজ্যের সবাই যে রানিকে খলনায়িকা ভাবছেন তা অবশ্য নয়। অনেকেই মনে করছেন জ্ঞাতি গোষ্ঠীর কেউ অথবা কোনো অজ্ঞাত আততায়ীর কাজও হতে পারে এটা।
কৃষ্ণ সাগরের দক্ষিণ তীর জুড়ে গড়ে উঠা পন্টাস রাজ্যের রাজা পঞ্চম মিথ্রিডাটিসের মৃত্যু রহস্যকে কেন্দ্র করে দেশ তখন সরগরম। কে হত্যা করলেন রাজা কে- সেই প্রশ্নে বিভক্ত রাজ্যবাসী। সেই রহস্য উদঘাটন না হওয়ায়, তখন থেকেই দ্বিধাবিভক্ত ইতিহাসও। আজও ঝানু ইতিহাসবিদদের কেউ কেউ বলে থাকেন, রাজা পঞ্চম মিথ্রিডাটিস্কে বিষ প্রয়োগ করে হত্যা করেছিলেন রানি লেয়ডাইস। অনেকেই আবার এই কর্মকান্ডের সাথে রানিকে জড়াতে নারাজ।
খৃস্টপূর্ব ১২০ অব্দে বিষক্রিয়ায় যখন মৃত্যু ঘটে রাজা পঞ্চম মিথ্রিডাটিসের, তাঁর দুই পুত্র তখন নিতান্তই নাবালক ছিলেন। জ্যেষ্ঠ পুত্র মিথ্রিডাটিস্ ইউপাটরের বয়স তখন ১২ বছরের[1] মতো হবে, আর কনিষ্ট পুত্র মিথ্রিডাটিস্ ক্রেস্টাস্ তখন আরো ছোটো। রাজার মৃত্যুর পর, জ্যেষ্ঠ পুত্র মিথ্রিডাটিস ইউপাটরকে সামনে রেখে রানি লেয়ডাইসই হয়ে উঠলেন সাম্রাজ্যের সর্বময় কর্ত্রী। রানি লেয়ডাইস ছিলেন অত্যন্ত চতুর ও উচ্চাকাঙ্ক্ষী মহিলা। রাজ্যের শাসন ভার হাতে পাওয়ার পর রানি বুঝতে পারেন, কয়েক বছর বাদে বড় ছেলে মিথ্রিডাটিস্ ইউপাটরই এই সিংহাসনের প্রকৃত দাবিদার হয়ে উঠে আসবে। রীতি মেনে, তাঁকে তখন ছাড়তে হবে এই গদি। এ তো বড় সুখবর নয়, প্রমাদ গুনলেন রানি। ক্ষমতায় টিকে থাকতে গেলে কত কিছুই না করতে হয় মানুষকে, এমনকি নিজের ছেলেকে হত্যাও। হ্যাঁ, জ্যেষ্ঠ পুত্র মিথ্রিডাটিস ইউপাটরকে হত্যার নক্সা তৈরি করলেন রানি লেয়ডাইস। একদিন, কিশোর রাজকুমারের অজান্তে, পিছন থেকে বর্শা নিক্ষেপ করেন কেউ। বর্শা লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ায় সে যাত্রায় বেঁচে যান কুমার। কিছু দিন পর, এক প্রকার জোর করেই, একটা পাগলা ঘোড়ার পিঠে চাপিয়ে দেওয়া হয় তাঁকে, যাতে ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে মৃত্যু হয় তাঁর। সে যাত্রায়ও বেঁচে যান তিনি[8]*। ঘোড়ার পিঠে থেকে তাঁকে পড়ে যেতে দেখেন নি কেউই। তবে ঘোড়ার পিঠে চেপে সেই যে লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে গেলেন কুমার, তারপর থেকে আর কোনো খোঁজই পাওয়া গেল না তাঁর। এক্কেবারে উধাও। বেপাত্তা।
রাজকুমার মিথ্রিডাটিস্ ইউপাটরের অন্তর্ধান রহস্য সম্পর্কে দুটো মত পাওয়া যায়। প্রথম মতানুসারে, নিজের বিপদ বুঝে কুমার নিজেই রাজপ্রসাদ ত্যাগ করেন এবং আত্মগোপন করে থাকেন। দ্বিতীয় মতটা তাঁরাই পোষণ করেন, যাঁরা মনে করেন রানি লেয়ডাইস কখনই তাঁর স্বামী তথা রাজা পঞ্চম মিথ্রিডাটিস্কে বিষ প্রয়োগে হত্যা করেন নি। তাঁরা বলেন, জ্ঞাতি শত্রুদের হাত থেকে রক্ষা করতে, কুমারকে অজ্ঞাতবাসে পাঠান স্বয়ং রানি।
ষষ্ঠ মিথ্রিডাটিসের মুখ সম্বলিত মুদ্রা। |
রাজকুমার মিথ্রিডাটিস্ ইউপাটর বেপাত্তা তখন। অগত্যাই ছোটো ছেলে মিথ্রিডাটিস্ ক্রেস্টাস্কে সামনে রেখে রাজকার্য পরিচালনার যাবতীয় দায়ভার নিজ হাতে তুলে নেন রানি লেয়ডাইস। এদিকে সময়ের সাথে সাথে, অজ্ঞাত কোনো এক স্থানে বেড়ে উঠতে থাকেন কিশোর মিথ্রিডাটিস্ ইউপাটর। ক্রমেই তাঁর কাছে পরিষ্কার হতে থাকে তাঁর অতীত, তাঁর বর্তমান, তাঁর ভবিষ্যৎ। তিনি বুঝতে পারেন ‘তিনি কে’ আর কি তাঁর ‘ভবিষ্যৎ’। তিনি বুঝতে পারেন তিনিই দেশের রাজা। রাজসিংহাসনের প্রকৃত দাবিদার। সেই দাবির জন্য এবার নিজেকে প্রস্তুত করতে থাকেন তিনি। তাঁর বিপদ সঙ্কুল ভবিষ্যতের কথা বিলক্ষণ বুঝতে পারছেন তিনি। তিনি জানেন, কে বা কারা খাদ্যে বিষ মিশিয়ে হত্যা করেছেন তাঁর বাবাকে। বিষক্রিয়ায় বাবার মৃত্যু ভাবিয়ে তোলে কুমারকে। অস্ত্র নিয়ে সামনা সামনি মোকাবিলায় ভীত নন তিনি। কারণ, এখন তিনি একজন বীর যোদ্ধা হিসেবেই পরিচিত। তিনি চিন্তিত গুপ্ত হত্যায়। কিশোর কুমারের মনে সবচেয়ে আতঙ্ক তৈরি করেছে- গুপ্তহত্যা তথা বিষক্রিয়ায় মৃত্যু। সাম্ভাব্য বিষক্রিয়া থেকে মুক্তির উপায় নিয়ে সারাক্ষণই ভাবতে থাকেন তিনি। বিষ প্রতিরোধ করতে পারে এমন কিছুর খোঁজ করতে শুরু করলেন তিনি। এই অজ্ঞাতবাসের দিনগুলোতেই বিভিন্ন ভেষজবিদের সাহায্য নিয়ে বিষ প্রতিষেধক (অ্যান্টিডোটস্) প্রস্তুত করতে সচেষ্ট হলেন কুমার। বিভিন্ন গাছের ছাল, মূল, পাতা, ফল, ফুল প্রভৃতি সংগ্রহ করতে থাকেন তিনি। সেই সমস্ত ভেষজকে কখনও বেটে, কখনও শুকিয়ে, কখনও গরম জলে ফুটিয়ে নানান মিশ্রন প্রস্তুত করতে শুরু করলেন। এই ধরণের নানান পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে এক সময়ে প্রস্তুত করেই ফেললেন এক বিষ প্রতিষেধক। এবার নিয়মিত সেই বিষ প্রতিষেধক ব্যবহার করতে শুরু করলেন তিনি। এই সমস্ত বিষ গ্রহণের ফলে প্রথম প্রথম ভীষণ রকমের অসুস্থ হয়ে পড়তেন তিনি। কিন্তু স্বল্পমাত্রায় নিয়মিত বিষ প্রতিষেধক নিতে নিতে ক্রমেই বিষ প্রতিরোধী (ইমিউনড) হয়ে উঠেতে থাকেন কুমার। তিনি জানতে পারেন, তাঁর রাজ্যে ‘পন্টিক ডাক’ নামে এক ধরণের হাঁস আছে, যারা বুনো ও বিষাক্ত গাছাপালা খেয়ে বেঁচে থাকে। বিষ প্রতিরোধের আশায় বিষাক্ত গাছপালার সাথে পন্টিক ডাকের রক্ত মিশিয়ে নিয়মিত গ্রহণ করতে শুরু করেন মিথ্রিডাটিস্ ইউপাটর। এছাড়াও এক জাতের বিষাক্ত মৌমাছির মধুও সেবন করতেন তিনি[4]। এই সমস্ত বিষ গ্রহণ করে সর্ব অর্থেই বিষ প্রতিরোধী হয়ে উঠলেন তিনি।
খৃস্টপূর্ব ১১৩ অব্দ। ৭ বছরের অজ্ঞাতবাস কাটিয়ে অবশেষে প্রকাশ্যে আসেন মিথ্রিডাটিস্ ইউপাটর। সোজা হাজির হলেন রাজধানী সিনোপ শহরে। দখল করলেন সিংহাসন। গ্রহণ করেলেন রাজ্যের শাসন ভার। সিংহাসনে বসলেন রাজা ষষ্ঠ মিথ্রিডাটিস্ হিসেবে। সিংহাসনে বসেই প্রতিশোধ নেন মায়ের উপর। বন্দি করেন রাজমাতা লেয়ডাইসকে। নিক্ষেপ করেন তাঁকে কারাগারে। সিংহাসন কন্টকমুক্ত করতে বন্দি করেন ভাই মিথ্রিডাটিস্ ক্রেস্টাস্কে। তাঁকেও দেওয়া হয় কারাদন্ড। হত্যা করতে থাকেন সিংহাসনের সাম্ভাব্য সমস্ত দাবিদারদের। ১১৩ খৃস্টপূর্বাব্দেই কারাগারে মৃত্যু ঘটে রাজমাতা লেয়ডাইসের ও রাজভ্রাতা মিথ্রিডাটিস্ ক্রেস্টাসের। এতো অল্প বয়সে, কি ভাবে মৃত্যু হলো মিথ্রিডাটিস্ ক্রেস্টাসের তা সম্পূর্ণ অজানাই থেকে গেছে আজও। কথিত, রাজার নির্দেশেই হত্যা করা হয় তাঁর মা ও ভাইকে। নিজের বংশে সিংহাসনের আর কোনো দাবিদার না রাখার লক্ষ্যে, নিজের বোন লেয়ডাইসকে[2] (মায়ের মতো একই নাম) বিবাহ করেন তিনি।
এত কান্ডের পরও কিন্তু বিষ প্রয়োগে গুপ্ত হত্যার ভয় থেকে নিষ্কৃতি পান নি রাজা ষষ্ঠ মিথ্রিডাটিস্। নিজের রান্নাঘরে কড়া প্রহরার ব্যবস্থা করেন তিনি। নিয়োগ করেন রাজ চাকনদার (রয়্যাল টেস্টার)। তাছাড়া আগের মতোই এখনও নিয়মিত সেবন করে চলেছেন বিষ প্রতিষেধক। কিন্তু তাতেও যেন নিজেকে বিপন্মুক্ত ভাবতে পারছেন না তিনি। নিজের নিরাপত্তা নিয়ে অনেক চিন্তা ভাবনা করার পর, অবশেষে এক সর্ব বিষ প্রতিষেধক (ইউনিভার্সাল অ্যান্টিডোটস্) প্রস্তুত করার কথা ভাবলেন তিনি। এই সর্ব বিষ প্রতিষধক হবে এমন এক মিশ্র ভেষজ, যা সমস্ত ধরণের বিষক্রিয়াকে প্রশম করতে সক্ষম হবে। সেই সর্ব বিষ প্রতিষধক প্রস্তুত করার জন্য তলব করলেন রাজবৈদ্য ক্রেটুয়াসকে। ক্রেটুয়াসকে জানালেন, সর্ব বিষ প্রতিষধক তৈরি করতে চান তিনি। আর এই বিষ প্রস্তুতির দায়িত্ব নিতে হবে তাঁকে। রাজার ইচ্ছায়, সর্ব বিষ প্রতিষধক তৈরিতে ব্রতী হলেন ক্রেটুয়াস। রাজবৈদ্য ক্রেটুয়াসের বিস্তারিত পরিচয় পাওয়া যায় না। অনেকেই বলেন, চিকিৎসক না বলে উনাকে উদ্ভিদবিদ বলাই ভালো। প্রচুর পরিমাণে গাছের ছাল, মূল, পাতা, ফল, ফুল সংগ্রহ করতেন তিনি। সেই সমস্ত পাতা, মূলকে কাটাছেঁড়া করতেন এবং নানান ভেষজের মিশ্রণে প্রস্তুত করতেন নানা ধরণের ওষুধ[3]। তাঁর সেই দুর্লভ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে ভেষজবিদ্যার উপর ৩ খন্ডের এক গ্রন্থ রচনা করেন ক্রেটুয়াস। সেই গ্রন্থে একাধিক উদ্ভিদের পাতা, মূল, কান্ডের সচিত্র বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছিলেন তিনি। ভেষজ বিজ্ঞানের ইতিহাসে এক অমূল্য সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হতো সেই বই। আজ অবশ্য সেই বইয়ের কোনো হদিশ পাওয়া যায় না। পরবর্তীকালের বিশিষ্ট ভেষজবিদ বা চিকিৎসকের লেখায় ক্রেটুয়াস লিখিত সেই বইয়ের ভূয়সী প্রশংসা শোনা যায়। এহেন দক্ষ ও অভিজ্ঞ রাজবৈদ্য ক্রেটুয়াস নিমগ্ন হলেন সর্ব বিষহরার প্রস্তুতিতে। নিরবিচ্ছিন্ন গবেষণা চালিয়ে অবশেষে তিনি সক্ষমও হলেন এক সর্ব বিষহরা প্রস্তুত করতে। অচিরেই সেই সর্ব বিষ প্রতিষেধক তুলে দিলেন তিনি রাজার হাতে। ক্রেটুয়াসের প্রস্তুত করা সেই সর্ব বিষ প্রতিষেধক বা ইউনিভার্সাল অ্যান্টিডোটস্ নিয়মিত গ্রহণ করতে শুরু করলেন রাজা ষষ্ঠ মিথ্রিডাটিস্।
(চলবে)
গ্রন্থপঞ্জী –
1) Adrienne Mayor, ‘The Poison King: The Life and Legend of Mithridates, Rome’s Deadliest Enemy’
2) Appian (of Alexandria), ‘Roman History’.
3) Aulus Cornelius Celsus, ‘De Medicina’
4) Aulus Gellius, ‘Attic Nights’
5) Cassius Dio, ‘Roman History’.
6) Florus, ‘Epitome of Roman History’
7) Laurenve M. V. Totelin, ‘Mithradates antidote-a pharmacological ghost’
8) Marcus Junianus Justinus, ‘Epitome of the Philippic History of Pompeius Trogus’.
9) Pliny (the Elder), ‘Natural History’
10) Various online sites (for herbal names).
[1] ষষ্ঠ মিথ্রিডাটিসের জন্মসাল নির্দিষ্ট ভাবে জানা যায় না। কেউ কেউ বলেন খৃস্টপূর্ব ১৩১ অব্দে জন্মগ্রহণ করেছিলেন তিনি। অনেকেই মনে করেন খৃস্টপূর্ব ১৩২ অব্দে অথবা খৃস্টপূর্ব ১৩৪ অব্দে জন্মগ্রহণ করেছিলেন তিনি।
* তৃতীয় বন্ধনীর ভিতর উল্লিখত সংখ্যা গ্রন্থপঞ্জীর গ্রন্থক্রম নির্দেশ করছে। উক্ত গ্রন্থে এই ঘটনা উল্লেখ করা আছে।
[2] ৬ পত্নি ও একাধিক উপপত্নি ছিল রাজা ষষ্ঠ মিথ্রিডাটিসের। তাছাড়া, দাসি গর্ভেও তাঁর একাধিক সন্তানের কথা জানা যায়। তাঁর ২৪-২৫টা সন্তানের নাম তো ইতিহাস বইতেই লেখা রয়েছে।
[3] আধুনিক ভাষ্যে এই দুই পেশাকে যথাক্রমে রাইজোটমিস্ট এবং ফার্মাকোলজিস্ট নামে অভিহিত করা হয়।