(গর্ভপাত নিয়ে একটি কাল্পনিক কথোপকথন)
ডাক্তারবাবু, গর্ভ-উপনিষদ পড়েছেন?
না, অত সময় নেই। প্রয়োজনে গুগল করে নি।
সনাতন ভারতীয় শিক্ষা বলছে ভ্রূণের সংস্কার (Garbhsamskar) শুরু হয়ে যায় গর্ভাবস্থার আদিকাল থেকেই। অভিমন্যু চক্রব্যূহ প্রবেশ করতে শিখেছিলেন যখন তিনি সুভদ্রার গর্ভে। আর আপনার বক্তব্যে এ পর্যন্ত ভ্রূণের কোনো নিজস্ব কোনো ব্যক্তিস্বত্তা (personhood) পেলাম না।
সত্যি বলতে কি, ভ্রূণের অধিকার নিয়ে আলোচনায় ঢুকে আমারও হাল এখন অভিমন্যুর মতোই। বেরোনোর রাস্তা খুঁজে পাচ্ছি না। জয়ন্ত দাস, সুভাষ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ প্রাজ্ঞ অগ্রজেরা সাবধান করেছিলেন বটে! দেখুন, এথিক্যাল দৃষ্টিভঙ্গিতে যদি দেখেন তাহলে ভ্রূণের বাহ্যিক অস্তিত্ব না থাকলেও হয়তো ব্যক্তিস্বত্তা আছে। কিন্তু শুধু আমাদের দেশে কেন, ইংল্যান্ড আমেরিকা সব দেশেই সেই স্বীকৃতি কেমন যেন ভাসাভাসা, আবছা।
কিন্তু Personhood না থাকলে তো একজন আগত মানবশিশুর কোনো অধিকারই থাকে না!
নৈতিকতার চোখে হয়তো আছে কিন্তু আইনের চোখে নয়। নৈতিকভাবে দেখতে গেলে একটি ভ্রূণের জীবিত অবস্থায় জন্মানোর অধিকার আছে। সুস্থ অবস্থায় জন্মানোর অধিকারও থাকা উচিত। আবার না-জন্মানোর অধিকারও থাকবে নাই বা কেন?
“না-জন্মানোর অধিকার!”..এ আবার কোন দেশী কথা?
কেন? এই তো মাত্র তিনমাস হলো ইংলন্ডে এক তরুণী তার মায়ের চিকিৎসকের বিরুদ্ধে কেস জিতেছেন এই মর্মে। মেয়েটির মেরুদন্ডে রয়েছে ভয়ানক জন্মগত ত্রুটি। ২০ বছর বয়সে তিনি দাবি করেছেন তাঁকে এই অবস্থায় পৃথিবীতে আনাটাই নাকি ঠিক হয় নি! (তথ্যসূত্র Times of India, 3 Dec 2021)
তার মানে ভ্রূণের অধিকার যদি বা কিছু থাকে, সব বিমূর্ত (notional)। আইনসম্মত কোনো অধিকার নাই?
আইনানুগ অধিকার থাকতে গেলে তো সেই ব্যক্তির আইনি মর্যাদা (legal status) থাকতে হয়। আর সেটা তারই থাকে আইন যাকে ব্যক্তি বা person এর স্বীকৃতি দেয়।
ডাক্তারবাবু, সংবিধানের Article 21 সম্পর্কে জানেন নিশ্চয়। প্রতিটি মানুষের বাঁচার অধিকার আছে। আগত মানবশিশুরই বা থাকবে না কেন? তাকে রক্ষা করার দায়িত্ব কার?
জানি না। প্রাথমিক দায়িত্ব গর্ভধারিণীর ওপর বর্তালেও সেটা কতখানি ন্যায্য তা বলতে পারব না। রাষ্ট্র যে বিশেষ দায় নেবে না সে তো চেরনোবিল বা ভোপাল গ্যাস ট্র্যাজেডি থেকেই পরিষ্কার। অসংখ্য বিকলাঙ্গ শিশুর দায়িত্ব কি সরকার নিয়েছে? তাছাড়া Article 21 তো Right to dignified existence এরও কথা বলে। কোনো সম্ভাব্য মাতাকে কি জেনেশুনে ভয়ানক অসুস্থ শিশুর জন্ম দিতে বাধ্য করা যায়? তাতে কার Dignity সুরক্ষিত হয়? তাছাড়া নিরাপদ গর্ভপাতও তো স্বীকৃত মানবাধিকারের অন্তর্ভুক্ত। এক কথায় Article 21 গর্ভস্থ ভ্রূণকে কোনো বিশেষ অধিকার দেয় না। (তথ্যসূত্র: Rights of an Unborn Child with reference to Article 21 of the Indian Constitution, LexForti Legal News Network, July 3, 2020)
তার মানে আইনের চোখে ভ্রূণের কোনো অধিকার নেই বললেই চলে। কিন্তু তার তো একটা মরাল স্টেটাস থাকবে? আর আইন যাই বলুক না কেন, মানবপ্রজাতির এক আগত সদস্যের প্রতি আমাদের কি আরো হিউম্যান হওয়া উচিত নয়? বিশেষত: ছ’ মাস মাতৃগর্ভে কাটানোর পর সে যখন ‘Viable’ বা বাধ্যতামূলকভাবে আর মা-নির্ভর নয়।
আমার প্রশ্ন হল দাঁড়িটা টানবেন কোথায়? মানুষের জেনেটিক কোড আছে এমন কোনো সত্তাকেই তো মানুষ বলা উচিত। আর সেই জেনেটিক কোড আরোপিত হয় ডিম্বাণুর নিষেকের সাথে সাথে। আর সে জন্যই তো ক্যাথলিকরা কোনো অবস্থাতেই গর্ভপাত সমর্থন করেন না। তাছাড়া প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে তো Viability এর সংজ্ঞাও বদলে যাচ্ছে। আগে ছিল ২৮ সপ্তাহ। এখন ২৪, এমনকী কোথাও কোথাও ২২ ! কিন্তু Viability stage পেরিয়ে গেলেই সত্যিই কি সে স্বাধীন? অপরিণত শিশুকে কি Ventilator এ দিতে হয় না? অনেক পরিপুষ্ট সদ্যোজাতেরও তো সহায়তা লাগে। আর Viability দিয়ে দেখতে গেলে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন এসে যায়। আমাদের মানবিকতা কি তাহলে কারো নির্ভরশীলতার সাথে লিঙ্কড্?
ডাক্তারবাবু আপনি Personhood এর প্রশ্নে ফিরে আসুন। বাহ্যিক বা সামাজিক উপস্থিতি নেই বলে কি একটি ফিটাসের কোনো moral status থাকবে না? সে কি morally হিউম্যান কমিউনিটির সদস্য নয়?
মানুষের Moral কমিউনিটি শুধু মানুষ দিয়ে নয়, তৈরী হয় Persons দিয়ে। আর অধিকার রক্ষার প্রশ্নে হয়তো Humanity র চেয়ে Personhood বেশি গুরুত্বপূর্ণ কারণ moral community পুরোটাই persons দিয়ে ঘেরা। তাহলে এখন দেখতে হয় কাকে আমরা ‘person’ বলবো। সম্পূর্ণ লিস্ট দেওয়া সম্ভব নয় তবে একজনকে person বলে গণ্য করতে গেলে তার আত্মসচেতনতা (self consciousness) থাকতে হয়, বিচারশক্তি (rationality) থাকতে হয়, তার যোগাযোগ করার ক্ষমতা (ability to communicate) থাকতে হয়। গর্ভস্থ ভ্রূণ কি এই সমস্ত মানদন্ড পেরোয়?
হয়তো পেরোয় না তবে Viability র আশেপাশ একটি ভ্রূণ যথেষ্ট সংবেদী (sentient) হয়ে ওঠে। এর সমর্থনে প্রয়োজনীয় তথ্যপ্রমাণ রয়েছে। সে বেশি আওয়াজে নড়ে ওঠে, ব্যাথা অনুভব করতে পারে। আর আপনি তার আত্মসচেতনতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন?
আমি আপনার “anti cruelty principle” এর সাথে একমত। আর সেজন্যই viability র পর একজন নারী একান্ত বিশেষ কারণ ছাড়া গর্ভপাত চাইতে পারেন না। কিন্তু Sentience এসে গেলেই যদি অধিকার অর্জন হয়ে যায় তাহলে যে অন্য সমস্যা হতে পারে।
কি সমস্যা?
মানবসমাজের এক দুর্বল সদস্যের অধিকার রক্ষার দাবিতে যে অধিকারপন্থীরা বাজারে নেমে পড়বেন! তাঁদের আমি শ্রদ্ধা করি। কিন্তু এক দুর্বলের অধিকার রক্ষা করতে যে তার আশ্রয়দাতার শারীরিক অখন্ডতা (bodily integrity) অবমাননা করতে হয়। যেমন ধরুন, ভ্রূণের অসুস্থতার কারণে সিজার প্রয়োজন কিন্তু মা রাজি নন। সেই অবস্থায় তো তাঁকে অপারেশনে বাধ্য করা যায় না। ঠিক যেমনটি যায় নি আমেরিকার সেই “Born Again Christian” ভদ্রমহিলাকে। তাঁর মতে শরীরে কোনো অস্ত্রাপচার যে নরকযাত্রার নামান্তর!
এবার শেষ প্রশ্ন। আগত সন্তানের জন্য হবু মায়েরা জীবন পর্যন্ত বাজি রাখেন। আর ডাক্তার হয়ে আপনি বলছেন “মায়ে ভ্রূণে দ্বন্দ্ব”! কোনো মধ্যপন্থা কি হয় না?
মানছি “মায়ে ভ্রূণে দ্বন্দ্ব” একটি বেমানান শব্দবন্ধ। প্রায় সব ক্ষেত্রেই হবু মা এবং ভ্রূণের স্বার্থ কোথাও না কোথাও এক বিন্দুতে মেলে (Convergent) কিন্তু কখনও কখনও সেটা বিপরীতমুখী (divergent) হয়ে যায় এবং বিরল সেই পরিস্থিতিগুলোতেই লেগে যায় অত্যন্ত স্পর্শকাতর, নৈতিক সংঘাত। এ এক অত্যন্ত জটিল আলোচনা। হয়তো একটা Gradualist Approach নেওয়া যেতে পারে। ভ্রূণ যত পরিণত হয় তার নৈতিক মর্যাদাও তত প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে শারীরিক সংযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হবার আগে পর্যন্ত মায়ের অধিকারই শেষ কথা।
ঋণ স্বীকার: Rights, Duties and the Body: Law and Ethics of the Maternal–Fetal Conflict ROSAMUND SCOTT King’s College London
সমাপ্ত
Excellent elaboration Sir ?