আমি তখন মুর্শিদাবাদের একটা ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পোস্টেড। মাত্র কুড়ি বেডের হাসপাতাল (পরে তিরিশ বেড হয়েছিল), এদিকে রোগীর চাপ সাঙ্ঘাতিক।
এক রমজান মাসের কথা বলছি। প্রখর গ্রীষ্মকাল। সেদিন আমার ‘অন-কল’ চলছে, অর্থাৎ একটানা চব্বিশ ঘন্টার ডিউটি। দিনের বেলা চাপ একটু কম ছিল, কিন্তু সন্ধ্যার পর থেকে আর নিঃশ্বাস ফেলার সময় নেই।
তো এইরকম একটা সময়ে, যখন আমি রুগীর চাপে ইমারজেন্সিতে হিমশিম খাচ্ছি, তখন এক মহিলা হাজির হলেন। মহিলা না বলে মেয়ে বলাই ভালো। বয়স বড়জোর আঠারো-উনিশ, চোখেমুখে দিশেহারা ভাব, বিধ্বস্ত চেহারা, কোলে একটা বাচ্চা। মেয়েটা সবাইকে ঠেলেঠুলে এসে কাঁদতে কাঁদতে বললো – “ডাক্তারবাবু আপনি আমার ছেলেডারে বাঁচান !”
বাচ্চাটার অবস্থা সত্যিই খুব খারাপ দেখলাম ! বছর দেড়েক বয়স, চোখ আধবোজা, ঠোঁটের চারপাশে কালচে নীল ছোপ। বেচারার এমনই অবস্থা যে কাঁদার ক্ষমতাটুকু পর্যন্ত নেই ! শরীর পুরো ঠান্ডা। বহুকষ্টে টেনে টেনে শ্বাস নিচ্ছে, কিন্তু বুঝতেই পারছি আর বেশিক্ষণ নিতে পারবে না। নাড়ীর গতি অত্যন্ত ক্ষীণ, হৃদপিন্ড এবং ফুসফুসের আওয়াজও তথৈবচ।
মেয়েটাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানলাম যে বাচ্চাটা নাকি প্রায় দু’সপ্তাহ ধরে অসুস্থ। প্রথমে জ্বর, কাশি, ইত্যাদি….তারপর পরশু থেকে প্রস্রাব বন্ধ। এই কদিন গ্রামের কোয়াক ডাক্তারের কাছে চিকিৎসা করিয়েছে, কিন্তু বাচ্চাটার প্রস্রাব বন্ধ হওয়ার পর তিনি আর কেসটা হাতে রাখেননি। বলেছেন – “আমার আর কিছু করার নেই, এবার পাশ করা ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাও।”
সব শুনেটুনে আমার মনটাই খারাপ হয়ে গেল। বাচ্চাটাকে আনতে অনেক দেরি করে ফেলেছে। অ্যাডভানসড্ সেপটিসেমিয়া…….এক্ষেত্রে এই ব্লক লেভেলের হাসপাতালে আমার কিচ্ছু করার নেই। এভাবে স্রেফ শিক্ষা আর সচেতনতার অভাবে কত প্রাণ যে অকালে ঝরে যাচ্ছে ! এইসব পেশেন্ট দেখলে একদিকে যেমন মন খারাপ হয়, অন্যদিকে রাগ লাগে। হুহু করে জনসংখ্যা বাড়ছে, এদিকে মানুষ পড়ে আছে সেই তিমিরেই। মেয়েটার যেখানে বাড়ি সেখান থেকে আমার হাসপাতাল বড়জোর সাত-আট কিলোমিটার হবে, অথচ দু’সপ্তাহ ধরে এখানে আসার কথা মাথায় এল না ! এখন বাচ্চাটা মরার সময়ে মনে পড়েছে। ধ্যুৎ !
আমি রেগে যেতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম – “এত দেরি করে আনলে কেন ? দু’দিন আগে আনলেও বাচ্চাটাকে বাঁচানোর একটা চেষ্টা নেওয়া যেত। এখন আর আমার কাছে এনে লাভ কি বলো ? আমি তো আর আল্লা নই যে মরা ছেলেকে বাঁচিয়ে দেবো !”
মেয়েটা তীব্র স্বরে বললো – “মরা ছেলে বলছেন ক্যানে ? আমার বাচ্চা তো এখনও বেঁচে আছে !”
আমায় বেজায় অপ্রস্তুত হয়ে বললাম – “আহা, ওটা কথার কথা। বেঁচে তো অবশ্যই আছে, কিন্তু কতক্ষণ আর থাকবে বলো তো ? নিজেই তো দেখতে পাচ্ছো বাচ্চাটার কি অবস্থা ! সেই আনলেই যখন দুদিন আগে আনতে পারলে না ?”
মেয়েটা কাঁদতে কাঁদতে যা বললো তাতে বুঝলাম যে ওর স্বামী বোম্বেতে রাজমিস্ত্রির কাজ করে। এখন সেখানেই আছে, ঈদের দু-তিনদিন আগে ফিরবে। শ্বশুর মারা গেছে, শাশুড়ি অসুস্থ, বাড়িতে অন্য কেউ নেই। এমতাবস্থায় নেহাত নিরুপায় হয়ে গ্রামেই বাচ্চাটার চিকিৎসা করিয়েছে, নাহলে আরো আগে হাসপাতালে নিয়ে আসতো।
আমি আর কি করবো ? বাচ্চাটার একটা আই.ভি. চ্যানেল করতে পারলো ভালো হতো, কিন্তু ফেইলিওরে চলে গেছে বলে হাতে বা পায়ে কোনো যুৎসই শিরা খুঁজে পেলাম না। তাও আন্দাজে একটা চ্যানেল পরিয়ে দিলাম। কে জানে শিরার মধ্যে ঠিকঠাক ঢুকলো কি না ! কয়েকটা বাঁধাধরা ইঞ্জেকশন দিয়ে বাকি পেশেন্টদের দেখে কোয়ার্টারে এলাম। এই মুহূর্তে আর কোনও পেন্ডিং কেস নেই, সুতরাং এই সুযোগে রাতের খাওয়াটা সেরে ফেলা যাক। কে জানে আবার কখন রুগীর ঢল শুরু হয়ে যাবে !
সবে একটা রুটি খেয়েছি কি খাইনি, তখনি কলিং বেল বেজে উঠলো। কর্তব্যরত জি.ডি.এ ডাকতে এসেছে। বাচ্চাটার নাকি আর পালস্ পাওয়া যাচ্ছে না, সিস্টার বলেছে কল-বুক দিতে।
খাবারটা ঢাকা দিয়ে উঠে গেলাম। গিয়ে দেখলাম বাচ্চাটা ‘গ্যাস্প’ করছে, অর্থাৎ সোজা বাংলায় খাবি খাচ্ছে। পালস্ নেই, হার্টের আওয়াজ বোঝা যাচ্ছে না, অনেকক্ষণ পরপর একটা করে শ্বাস নিচ্ছে। চোখের মণিতে টর্চের আলো ফেলে দেখলাম, রি-অ্যাকশন প্রায় নেই বললেই চলে।
কিচ্ছু করার নেই ! আর কয়েক মিনিটের মাত্র মামলা, তারপরই সব শেষ হয়ে যাবে। সিস্টারকে বললাম – “ওয়ান সি.সি. করে ডেরিফাইলিন আর ডেকাড্রন দিয়ে দিন।” জানি কোনো লাভ হবে না, তবু নাম-কা-ওয়াস্তে যেটুকু করা আর কি !
বাচ্চাটার মা একটু দূরে বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। ওয়ার্ডের অন্যান্য পেশেন্টরা তাকে স্বান্তনা দিচ্ছে – “কাইন্দো না গো, কানতে হয় না ! সবই আল্লার হুকুম।”
আমি আর সিস্টার বাচ্চাটার পাশে দাঁড়িয়ে আছি, হঠাৎ দেখি মেয়েটা ছুটে এসে তার সন্তানকে চিলের মতো ছোঁ মেরে কোলে তুলে নিল।
আমি রে-রে করে উঠলাম – “আরে কি করছো, কি করছো, স্যালাইন খুলে যাবে তো !”
মেয়েটা দৃঢ়স্বরে বললো – “আপনারা যা চিকিৎসা করার করেন, এরে আমি কোলে নিয়া বসে থাকবো। মায়ের কোলে থাকা অবস্থায় বাচ্চার মরণ হয় না।”
“তাই নাকি ?” আমি একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম।
“জি। মার কোল থিক্যা বাচ্চার জান নেওয়ার নিয়ম নাই। আজরাইল জান কবচ করার লেগে ঘুরাঘুরি করে, কিন্তু মা যখন বাচ্চা কোলে নিয়া পাহারা দেয় তখন জান কবচ করতে পারে না। মা যেই বেখেয়ালে বাচ্চাকে কোল থিক্যা নামায়ে দেয় কি ঘুমায়ে পড়ে তখনই আজরাইল জান নিয়া পালায়। আমার ছেলেরে আমি পাহারা দিবো।”
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। আহা রে ! এত বাচ্চা একটা মেয়ে, সে এই বয়সেই এতখানি শোক পাবে। বেচারা কিভাবে বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে বসে আছে দ্যাখো ! দেখলেও মায়া লাগে। আর কিছুক্ষণ পরেই তাকে তার সন্তানের মৃত্যুসংবাদ দিতে হবে, আর সেই চরম নিষ্ঠুর কাজটা করতে হবে এই আমাকেই ! উফ, কেন যে মরতে ডাক্তার হতে গেলাম !
এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে পাঁচ মিনিট কাটলো, দশ মিনিট কাটলো, পনেরো মিনিট কাটলো…..বাচ্চাটা তখনও একই ভাবে শ্বাস নিচ্ছে। আধঘন্টা পর আমি আর সিস্টার একে অপরের দিকে তাকালাম। এরকমটা তো হওয়ার কথা নয় ! অহরহ মানুষের মৃত্যু দেখছি, অতএব এই বিষয়ে অভিজ্ঞতা নেহাত কম নেই। আমার সেই অভিজ্ঞতা অনুযায়ী হিসাব মিলছে না। ব্যাপারটা কি ?
ঘন্টাখানেক পর মনে হলো যেন বাচ্চাটার পালস্ পাচ্ছি। আমি হতবাক হয়ে অন্য হাতে নিজের নাড়ি টিপে ধরলাম, কারণ অনেক সময়ে নিজের আঙুলের ডগার পালসেশন পেশেন্টের পালস্-এর সাথে গুলিয়ে যায়। নাহ, গোলায় নি ! এটা ওই বাচ্চাটারই পালস্। আমার শরীরের সব রোম খাড়া হয়ে গেল। এসব কি হচ্ছে ? কিভাবে হচ্ছে ? কে করাচ্ছে ? আমার চেয়ে ভালো কেউ জানে না যে এটা ওই ডেরিফাইলিন ডেকাড্রনের কম্ম নয়। বাচ্চাটার যা অবস্থা ছিল তাতে কোনও ওষুধেই কাজ হওয়ার কথা না। তাহলে কিভাবে হচ্ছে এসব ?
আমি অবিশ্বাস ভরা চোখে মেয়েটার দিকে তাকালাম। দেখলাম তার কোনও বিকার নেই, এমনকি একবার জিজ্ঞেস পর্যন্ত করলো না তার ছেলে কেমন আছে……শুধু চোয়াল শক্ত করে বাচ্চা কোলে নিয়ে বসে থাকলো।
সারারাত আমি সেখানেই বসে রইলাম। একের পর এক পেশেন্ট আসছে, তাদের দেখছি, আবার গিয়ে বসে পড়ছি। না, আমি বিরাট কোনও দরদী ডাক্তার বলে বসে থাকিনি…..স্রেফ হতভম্ব হয়ে বসে ছিলাম।
ভোরের দিকে বাচ্চাটা অনেকখানি সুস্থ হলো। ভাইটাল সাইনগুলো স্টেবল হয়েছে, প্রস্রাব করেছে, মায়ের দুধ টেনে খাচ্ছে। মেয়েটা তখনও সেই খাড়া হয়েই বসে আছে। আমি একটা ঘোরের মধ্যে কোয়ার্টারে ফিরলাম।
বাচ্চাটা সুস্থ হয়ে গিয়েছিল। আজরাইল সেবার বাধ্য হয়েছিল বিফল মনোরথ হয়ে ফিরে যেতে। একটি প্রত্যন্ত গ্রামের হতদরিদ্র নারীর কাছে তাকে পরাজয় স্বীকার করতে হয়েছিল, কারণ ‘নিয়ম নাই !’ নিয়মের বাইরে যাওয়ার অধিকার তাকে দেওয়া হয়নি।
না, এমনটা আমি কখনই বলছি না যে কোনও মা তার মৃতপ্রায় সন্তানকে কোলে নিয়ে বসে থাকলেই সেই সন্তান বেঁচে যাবে। ডাক্তার হয়ে অতটা গাড়লের মতো কথা আমি বলবো না। আমি শুধু নিজের দেখা একটা ঘটনার কথা বললাম।
আমরা অনেকেই নিজেদের নানারকম বিশ্বাসের কথা বলি, কিন্তু সেই বিশ্বাসগুলোয় সন্দেহের ভেজাল মেশানো থাকে। মনে দ্বিধা থাকে, আমার বিশ্বাসটা হানড্রেড পারসেন্ট সঠিক তো ?
দ্বিধাহীন বিশ্বাসের যে কি প্রচন্ড ক্ষমতা তার কিছু নমুনা আমি নানারকম সময়ে পেয়েছি। হয়তো পুরোটাই কাকতালীয়, কিন্তু সবকিছু কাকতালীয় বলে ভাবতে ইচ্ছে করে না। থাক না কিছু রহস্যময়তা ! সব রহস্য জেনে ফেললে বড় স্বাদহীন লাগবে এই পৃথিবীটাকে ….. ঠিক গতে বাঁধা নিরস দাম্পত্যজীবনের মতন।
ও হ্যাঁ, কি যেন বলছিলাম ! বিশ্বাস। হ্যাঁ, বিশ্বাস! বলছিলাম যে দয়া করে সবাই নিজের বিশ্বাসটা নিজের কাছেই রাখুন। আপনি আস্তিক হোন, নাস্তিক হোন, হিন্দু হোন, মুসলমান হোন, যাই হোন না কেন……অপরের বিশ্বাসে আঘাত দেবেন না প্লীজ।
দেওয়ার নিয়ম নাই !!!
আপনাদের অভিজ্ঞতার কথা পড়তে বেশ লাগে। বুঝতে পারি সময়কে, মানুষকে। লেখার হাত চমৎকার। আর আপনাদের উদ্যোগও। শুভেচ্ছা।
অনেক বার পড়েছি। আবারও পড়লাম।
আমি ‘বিশ্বাসেই’ বাঁচি — ভালো লাগে বিশ্বাস করতে…
বড় মনপ্রাণ ঢেলে লেখা… বড্ড ভালোবাসার লেখা।?❤বিশ্বাসের খুব জোর জানো? এই বিশ্বাস টুকু মনকে খুব প্রশান্তি দেয়…. সামনে যাই থাকনা কেন বিশ্বাস না থাকলে বেঁচে থাকাটা বড় দুঃখের বড় কষ্টের…. তোমার সোনার কলম অক্ষয় হোক?❤??
আপনার এই অসাধারণ লেখা টা যে কতবার পড়েছি ডাক্তার বাবু। এই লেখা টা পড়লে বড্ড যে “বিশ্বাস ” জিনিসটার প্রতি বিশ্বাস জন্মে যায়। আসলে ঐ সব যুক্তি তর্কের বেড়াজালে পড়ে আমরা যে বিশ্বাস করতেই ভুলে গিয়েছি ডাক্তার বাবু। তাই ঐ ইংরেজি প্রবাদ টা খুব মনে হচ্ছিল এই লেখা টা পড়তে পড়তে।
“Where ignorance is bliss
It is folly to be wise “♥♥♥♥?????
আগেও এই ঘটনাটা পড়েছিলাম আপনার ওয়ালে। খুব ভালো লাগলো। সত্যিই বিশ্বাস থাকলে অনেক অবিশ্বাস্য কাজ হয়ে যার যুক্তিপূর্ণ ব্যাখা পাওয়া যায় না। বিশ্বাস যদি কারও মনোবল বাড়ায় ক্ষতি কি! অন্যের বিশ্বাসে আঘাত না দিলেই হলো। খুব ভালো লেখা। নিজের উপর আত্মবিশ্বাস বাড়ে। ??