নিজের জন্যই পেটপুরে খাই। এ যেন মেয়েদের জন্য বড় লজ্জার ব্যাপার। ছোটো থেকেই শেখানো হয়, হাঁড়ির তলার ভাত আর মাছের ল্যাজার ছোট্ট টুকরোই তার জন্য বরাদ্দ থাকবে। এর থেকে বেশি কিছু চাওয়া হ্যাংলাপনা। যদিও গর্ভবতী হওয়ার পরে সে ছবি বদলে যায়।
সন্তান সম্ভবা হলে পরিবারের সকলের নজর থাকে তাঁর উপর। স্বাভাবিকভাবে গর্ভবতীর খাওয়া দাওয়ার অতিরিক্ত খেয়াল রাখা হয়। ইন্টারনেট ঘেঁটে কিংবা চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে ডায়েট চার্ট বানানো হয়। ব্রেকফাস্টে দুধ-ডিম কখনও বাদ যায় না। চার বেলা খাবারের পাতে বসলে তাঁকে জানানো হয়, নিজের জন্য নয়, সন্তানের জন্যই ভালো করে খেতে হবে। মায়ের স্বাস্থ্যের জন্য নয়, সন্তানের জন্যই তাঁর পুষ্টির প্রয়োজন।
প্রসবের পর তাই তাঁর খাওয়া নিয়ে আর বিশেষ নজর থাকে না। অন্যান্য বিষয়ের মতো সদ্যপ্রসূতি মায়ের খাওয়ার খেয়াল গুরুত্বের তালিকা থেকে বাদ পড়ে যায়। যার জেরে মা পরবর্তী জীবনে নানা সমস্যায় ভোগে। অধিকাংশ সময় দেখা যায়, অসচেতনতার জেরেই এই অবহেলা। তাছাড়া এই অবহেলার পিছনের সামাজিক কারণ কখনোই অস্বীকার করা যায় না।
এ দেশে মেয়েদের বড় হয়ে উঠার সামাজিক প্রক্রিয়া বেশ গোলমেলে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের নিয়ম অনুযায়ী, ‘ভালো’ মেয়েরা নিজেদের জন্য কিছু চান না। ভালো মায়ের তো কোনো চাহিদা ভাবতেও নেই। বিশেষত, মায়ের ক্ষিদে পাওয়া অনুভূতিটাই নির্লজ্জ হওয়ার প্রমাণ। কিন্তু তারপরেও মায়েদের একটু নির্লজ্জ হওয়া দরকার। কারণ, সুস্থ ভাবে বেঁচে থাকার অধিকার সব মায়ের রয়েছে।
নতুন মা ও তাঁর পরিবার কয়েকটি দিকে একটু নজর দিলেই প্রসব পরবর্তী দুর্বলতা দ্রুত কাটিয়ে সুস্থ হয়ে ওঠা সম্ভব। খাবারের তালিকায় কয়েকটি জিনিস নিয়মিত রাখলেই পুষ্টির ঘাটতি মেটানো যাবে।
প্রসবের সময় মায়ের রক্তপাত হয়। সিজারের মাধ্যমে প্রসব হলে রক্তপাত আরও বেশি হয়। সাধারণত, স্বাভাবিক প্রসবে ২৫০ মিলিলিটার রক্তপাত হলে সিজারে হয় ১০০০ মিলিলিটার। এদেশের অধিকাংশ মেয়ে রক্তাল্পতায় ভোগেন। প্রসবের পর সেই সমস্যা আরও বেড়ে যায়। এই ঘাটতি দ্রুত পূরণ হওয়া জরুরি। তাই দুবেলা পাতে মাছ থাকা জরুরি। মোচা, ডুমুরের মতো সব্জি, বেদানা, আখ কিংবা তরমুজের মতো আয়রনের উপাদান যুক্ত ফল নিয়মিত খাওয়া দরকার।
মা হওয়ার পরে দায়িত্ব বেড়ে যায়। ফলে শারীরিক পরিশ্রমও বাড়ে। তাছাড়া, প্রসব যন্ত্রণা ভোগের জেরে শরীর দুর্বল হয়ে থাকে। তার উপরে অনিয়মিত ঘুম ক্লান্তি আরও বাড়িয়ে দেয়। প্রয়োজন হয় বাড়তি এনার্জির। তাই এনার্জি বাড়ানোর মতো খাবার মেনুতে রাখা দরকার। দুধ, দই, কলা, আলু নিয়মিত খাওয়া উচিত। কার্বোহাইড্রেট শরীরে এনার্জি জোগান দেয়। তাই পেটভরে ভাত-রুটি ও খেতে হবে। গর্ভবতী থাকাকালীন ওজন বৃদ্ধি পায়। পুরনো শারীরিক গঠন দ্রুত ফিরে পেতে অনেকেই ভাত-রুটি খাওয়া একদম কমিয়ে ফেলেন। কিন্তু সেটা শরীরকে আরও দুর্বল করে দেয়।
সদ্যপ্রসূতি মায়ের সবচেয়ে গুরুত্ব দেওয়া দরকার জলপানের উপর। অসচেতনতার জেরে যা অধিকাংশ সময় অবহেলিত হয়।
প্রসবের পরবর্তী ৬ মাস স্তন্যপান জরুরি। যার জেরে মা ও সন্তান দুজনের স্বাস্থ্যই ভালো থাকে। প্রথম ৬ মাস শুধু স্তন্যপান করালে সন্তানের ভালো শারীরিক ও মানসিক বিকাশ হয়। আবার মায়ের দেহেও হরমোনের কাজ ঠিকমতো হয়। এ নিয়ে সরকারি-বেসরকারি একাধিক প্রতিষ্ঠান প্রচার চালালেও স্তন্যপান করানোর সময় মায়ের খাদ্যতালিকায় কী কী আবশ্যক সেটা উপেক্ষিত থেকে যায়।
প্রসব পরবর্তী প্রথম ৬ মাস শুধুমাত্র স্তন্যপান চলাকালীন মায়ের প্রতিদিন ৬-৭ লিটার জল খাওয়া দরকার। কারণ, স্তন্যপান করালে যেমন শক্তি ক্ষয় হয়, তেমন দেহের জলীয় অংশ কমে যায়। জল সেই ঘাটতি পূরণ করে। কিন্তু এ সম্পর্কে ধারণা না থাকায় অনেকেই প্রয়োজনীয় জল খায় না। যার জেরে মাথা ঘোরা কিংবা ডিহাইড্রেশনের মতো সমস্যায় ভোগেন। পর্যাপ্ত দুধ ও জল খেলে মায়ের স্তন্যপান করাতে কোনো শারীরিক সমস্যাই হবে না। তাছাড়া বাঁধাকপি, পালং শাক, গাজর, কুমড়োর মতো সব্জি স্তন্যপান চলাকালীন সময়ে খেলে শরীরে বাড়তি এনার্জি জোগানোর কাজ আরো ভালো হয়।
মহিলাদের বিশেষত পূর্ব ভারতের মহিলাদের মধ্যে ভিটামিন ডি ও ক্যালসিয়ামের অভাব প্রবল। বাইরের কাজের পাশাপাশি বাড়িতে তাদের বাড়তি দায়িত্ব নিতে হয়। মা হওয়ার পরে সেই চাপ আরও বাড়ে। ক্যালসিয়ায়ের অভাব থাকলে হাড়ের জোর কমে যায়। অধিকাংশ সময় হাতে-পায়ের যন্ত্রণা অনুভব করেন। এই যন্ত্রণা এড়াতে প্রথম থেকেই সতর্ক হওয়া জরুরি। তাই নিয়ম করে ডিম খেতে হবে। ডিম হল সুষম আহার। ডিমে একাধিক ভিটামিন, ক্যালসিয়াম সহ এমন সব উপাদান রয়েছে যা সুস্বাস্থ্যের জন্য মূল্যবান।
অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায়, প্রসব পরবর্তী সময়ে ঘুম অনিয়মিত হওয়ার জেরে মায়ের হজমের গোলমাল হয়। এই সমস্যা এড়াতে মায়ের ডিম-মাছ-মাংস সহ প্রোটিন জাতীয় খাবারে রাশ টানা হয়। এতে ক্ষতি আরও বেশি হয়। হজমের গোলমাল কমাতে চিকিৎসকের পরামর্শ মতো ওষুধ খেতে হবে। মায়ের পুষ্টিতে কোপ পড়লে সমস্যা আরও বাড়বে।
খাবারের পাশাপাশি ওষুধ ও আয়রন, ক্যালসিয়ামের বড়ি নিয়মিত খেতে হবে। হাসপাতাল থেকে ফেরার পথে অনেকেই ওষুধ অনিয়মিত ব্যবহার করেন। আয়রন, ভিটামিনের ওষুধ বাদ পড়ে যায়। এতে পরবর্তী জীবনে রক্তাল্পতা, হাড় ক্ষয়ে যাওয়া, দৃষ্টিশক্তি কমে যাওয়ায় মতো দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা তৈরি হওয়ায় ঝুঁকি আরও বেড়ে যায়। তাই চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে ওষুধ চালিয়ে যাওয়া জরুরি।
সদ্যোজাতের পাশাপাশি মায়েরও বিশেষ দেখভাল দরকার। সে বিষয়ে পরিবারকেই সবচেয়ে সচেতন হতে হবে।
Khub real jinis likhechis. Amader sokoler aro beshi kore sodyo prosuti maa r dike nojor deoya uchit…