আশীষদা আমাকে দল্লী-রাজহরায় নিয়ে গিয়েছিলো, ১৯৮৬-র ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে আমি পৌঁছলাম, আশীষদাকে পারিবারিক কিছু কারণের বরাবরের জন্য শহীদ হাসপাতাল ছেড়ে আসতে হল সপ্তাহ দুয়েক পরে। আশীষদা যে কাজগুলো করত স্বাভাবিকভাবেই সে কাজগুলোর দায়িত্ব এসে পড়ল আমার ওপর।
আশীষদা ন্যাশানাল মেডিক্যাল কলেজের, হাউসস্টাফশিপ করা সার্জারী আর অর্থোপেডিক্সে। আমি মেডিক্যাল কলেজে মোট প্রায় দু’বছর করেছি জেনেরাল সার্জারী, পেডিয়াট্রিস সার্জারী আর ইউরোলজিতে। শহীদ হাসপাতালের আউটডোরে পুরুষ রোগী দেখতাম আর ছোটখাট অপারেশন করতাম—হাইড্রোসিল, ঠিকাদারী ড্রাইভাররা সে সময় বিএসপি-তে রেগুলার হবেন, হাইড্রোসিল থাকলে অপারেশন করিয়ে নিচ্ছিলেন, প্রথম বছরে হাইড্রোসিল অপারেশন করি ৪৯ জনের, আর মাঝেমধ্যে অ্যাপেন্ডিসেক্টমি, হার্নিয়া, পাইলস, ফিশার, ফিশ্চুলা, ছোটখাট টিউমার। চঞ্চলাদি মাঝেমধ্যে সিজারিয়ান সেকশন করে।
১৮ফুট X ১১ফুট একটা ঘরে আমাদের ওটি-কাম-লেবার রুম। একপাশে হাত ধোওয়ার কল। নির্দিষ্ট উচ্চতার একটা অপারেশন টেবিল, ইচ্ছামতো টেবিল উঁচুনীচু করা যায় না। টেবিলের ওপর ২০০ ওয়াটের ল্যাম্প। একটা স্পটলাইট। পাশে ছোট্ট এক চিলতে ঘর ৮.৫ফুট X ৬ফুট, সেখানে অপারেশনের যন্ত্রপাতি থাকে, থাকে জীবাণুমুক্ত কটন-গজ-ব্যান্ডেজ, গাউন-গ্লাভস-অপারেশনের শিটস। অপারেশনের ড্রাম জীবাণুমুক্ত করা হয় একটা ড্রাম ঢোকে এমন অটোক্লেভে, ছোটখাট জিনিস-পত্র জীবাণুমুক্ত করা হয় প্রেসারকুকারে। অটোক্লেভ আর প্রেসারকুকার—দুয়ের কাজের নিয়ম একই, কেবল অটোক্লেভে তাপমাত্রা ও বাষ্পের চাপ দেখা যায়, নিয়ন্ত্রণ করা যায়। অপারেশনের আগের রাতে ওটি গন্ধক পুড়িয়ে জীবাণুমুক্ত করা হত। পরে অবশ্য ফর্মালিন বাষ্প দিয়ে ওটি জীবাণুমুক্ত করার এক যন্ত্র কেনা হয়েছিল।
যতোটা পারা যায় অপারেশন করতাম লোকাল অ্যানাস্থেশিয়ায়, অর্থাৎ স্থানীয়ভাবে অবশ করে। জেনেরাল অ্যানাস্থেশিয়া বা পুরো অজ্ঞান করে অপারেশন করতে হল ব্যবহার করা হতো ওপেন ইথার অ্যানাস্থেশিয়া পদ্ধতি। অজ্ঞান করার বয়েলস অ্যাপারেটাস ছিল না। রোগীর চোখ তুলোর প্যাডে ঢেকে নাক-মুখের ওপর চাপা দেওয়া হত একটা মুখোশ। স্টীলের ফ্রেমে কয়েক স্তর গজ লাগানো, তার ওপর বোতল থেকে ফোঁটাফোঁটা ইথার ঢালা হতো। ইথার বাষ্পীভূত হতো, রোগী হাওয়ার সঙ্গে সেই বাষ্প টেনে অজ্ঞান হতেন। কলেজে পড়তে বা কাজ করতে এই পদ্ধতির প্রয়োগ দেখিনি কখনও, কেবল বইতে পড়েছি। ঐতিহাসিক এই পদ্ধতিতে সরঞ্জাম লাগে খুব কম, কম দক্ষ মানুষই প্রয়োগ করতে পারেন ঠিকঠাক শেখালে, আর নিরাপদ পদ্ধতিও বটে।
অপারেশনের যন্ত্রপাতি বলতে ছুরি, কাঁচি, সেলাই করার জন্য সূঁচ, সূঁচ ধরার নিডল-হোল্ডার, চিমটে, রক্তনালী ধরার জন্য আর্টারি ফরসেপ্স ছোট ও মাঝারি ৬টা করে, দুধরনের টিস্যু ফরসেপ্স খান ছয়েক।
একরাতে সাড়ে-তিন বছরের এক ছেলেকে নিয়ে এলেন তাঁর বাবা-মা। দু’দিন ধরে পেটে ব্যথা, পেট ফুলছে, বমি হচ্ছে, পায়খানা বন্ধ, বাত-কর্মও হচ্ছে না। পরীক্ষা করে দেখে মনে হল intestinal obstruction অর্থাৎ অন্ত্রে কোথাও অবরোধ হচ্ছে। দ্রুত পেট খুলে দেখা দেখা দরকার। কিন্তু মুশকিল হলো—পেট খুলে দেখা যেতে পারে যে অন্ত্রের একটা অংশ রক্তাভাবে পচে গেছে, তখন সে অংশ কেটে বাদ দিয়ে অন্ত্রের সুস্থ প্রান্তদুটো সেলাই করে জুড়তে হবে। এমন অপারেশন মেডিক্যাল কলেজে কম করিনি, পোষাকী নাম এই অপারেশনের—রিসেকশন-অ্যানাস্টোমোসিস। কিন্তু এখানে অপারেশনের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতিই বেশ কিছু নেই। এতো বড় অপারেশন এর আগে শহীদ হাসপাতালে হয়ওনি। কিন্তু কোথায় পাঠাবো বাচ্চাটিকে? জেলা হাসপাতাল জেলা সদর দুর্গে, দূরত্ব ৮৪ কিলোমিটার। দুর্গ জেলাতে ছত্তিশগড়ের সবচেয়ে আধুনিক চিকিৎসা-প্রতিষ্ঠান ভিলাই স্টীল প্ল্যান্টের মেন হাসপাতাল, দল্লীরাজহরা থেকে ভিলাই-এর দূরত্ব ৯১ কিলোমিটার। পাশের জেলা সদর রাজনাদগাঁও-এর দূরত্ব ৬২ কিলোমিটার। আর তারচেয়েও বড় ব্যাপার এই হাসপাতালগুলোর কোনটাতেই শিশুশল্যচিকিৎসক নেই।
অপারেশনের সময় কাটা প্রান্ত টেনে রাখার জন্য রিট্রাক্টর (retractor) লাগে। ছোট রিট্রাক্টর নেই। জিভ চেপে গলা দেখা হয় টাংগ ডিপ্রেসর (tongue depressor) দিয়ে। L-আকৃতির এই যন্ত্র দিয়ে রিট্রাক্টরের অভাব পূরণ করলাম। অন্ত্র কেটে বাদ দিয়ে নতুন করে জোড়ার জন্য দু’ধরনের ক্ল্যাম্প লাগে—ক্রাশিং ক্ল্যাম্প (crushing clamp) আর অক্লুশন ক্ল্যাম্প (occlusion clamp)। অন্ত্রের যে অংশ কেটে বাদ দেওয়া হবে, তার দুদিকে লাগানো হয় ক্রাশিং ক্ল্যাম্প—যাতে অন্ত্রের তরল পেরিটোনিয়াল গহ্বরকে দূষিত না করে। আর যে দু’প্রান্ত জোড়া হবে সেই দু’দিকে লাগানো হয় অক্লুশন ক্ল্যাম্প, তাতে মল বাইরে বেরোয় না, আর হাল্কা চাপে রক্তনালী থেকে রক্তও বেরোয় না, কিন্তু রক্তনালীগুলো বেশী চাপে থেঁতোও হয়ে যায় না। আমাদের কোনোটাই নেই। ক্রাশিং ক্ল্যাম্পের কাজ চালালাম আর্টারি ফরসেপ্স দিয়ে। অক্লুশন ক্ল্যাম্পের বিকল্প হলেন অতিরিক্ত একজন সহায়ক। তিনি তাঁর দু’হাতের তর্জনী আর বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে সুস্থ দুই প্রান্তের ভেতরের নালী-পথ ও রক্ত-নালীগুলোকে চেপে ধরে রাখলেন। আমি পচে যাওয়া অংশটা কেটে বাদ দিয়ে সুস্থ প্রান্তদুটো সেলাই করে জুড়ে দিলাম। শিশুটি বেঁচে গেল।
নমস্কার করি আপনাদের…. আপনারা সত্যিই ভগবান
সাধে কি মানুষ ডাক্তার দের ভগবান ভাবে।