ঘটনাটি কালকের…
মূল ধর্ণাটা যেখানে চলছে, তার থেকে খানিকটা দূরে একটা ছাউনির তলায় বসে আছি। কানে ছোট বাচ্চা গুলোর স্লোগান ভেসে আসছে।
ভাবছিলাম, আমি তো না হয় রাতে ফিরে গিয়েছিলাম এখান থেকে বাড়িতে। এই বাচ্চা গুলো কাল সারা রাত এখানে বসে ছিল। তুমুল বৃষ্টি মাথায় করে। এখনও বসে আছে, ঠায়। স্লোগান দিচ্ছে। গান করছে। অনড়। অভয়। ডাক্তার, প্রতি মূহুর্তে মনে প্রাণে হাসপাতালে ফিরতে চাইছে। অথচ বাধ্য হচ্ছে রাস্তায় বসে থাকতে।
মনে মনে প্রণাম করলাম।
কাল রাতে যখন ফিরেছিলাম, তখন দেখেছিলাম মাটিতে বসার মতো কিছু প্লাস্টিকের ব্যবস্থা হয়েছে। খাবার দাবারের ব্যবস্থা হয়েছে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সল্টলেক শাখার ক্যান্টিনে খাবার হয়েছে। এসেছে আমাদের জন্য। ঘোষণা হয়েছে, ওখানকার হোস্টেলে আমরা যখন তখন যেতে পারি। খেতে পারি। টয়লেট ব্যবহার করতে পারি। চারটে বায়ো টয়লেটের ব্যবস্থা হয়েছে। রাতে বাড়ি ফিরে ফোনাফুনি করে আরো কিছু ব্যবস্থা করা হয়েছিলো। পরিমানে বাড়ানো হয়েছিল। তারপর… তারপর সব কিছুই করেছে সহনাগরিকরা। আমাদের অজান্তেই। স্বেচ্ছায়। আজ সকালে পৌঁছে দেখছি তেরোটা বায়ো টয়লেট, মাটিতে বসার যথেষ্ট প্লাস্টিক, বেশ কিছু স্ট্যান্ড ফ্যান, জেনারেটর, প্রচুর খাবার দাবার, জল…
কাল রাতে দেখে ফিরেছিলাম, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সল্টলেক শাখার ক্যান্টিনে খাবার হয়েছে। আজ দেখলাম, টেকনো ইন্ডিয়ার অফিস থেকে এসেছে খিচুড়ি আর ডিম ভাজা। সেখানকার টয়লেট ব্যবহার করার অনুমতি দিয়েছে, কতৃপক্ষ।
বাচ্চাগুলোর কাছে যেতেই পরিচিত ছেলে গুলো বললো, “দাদা বারণ করো আর জল, খাবার দাবার নিয়ে আসতে। নষ্ট হবে এবার। আমরা খেতে পারবো না, এতো। বরং এই বেঁচে যাওয়া খাবার কোন সংস্থার মাধ্যমে ছোট বাচ্চাদের বা বৃদ্ধাশ্রমে পাঠানোর ব্যবস্থা করো।”
কথা বলে এসে বসলাম। মূল ধর্ণাটা যেখানে চলছে, তার থেকে খানিকটা দূরে। পাশে এক অপরিচিত ভদ্রলোক বসে আছেন। মোবাইলে গান চালিয়ে রেখেছেন, “আর কবে…” ভাবলাম কোন ডাক্তার হবেন। নজর ঘুরিয়ে দেখতে পেলাম, স্রোতের মতো মানুষ আসছে। একাকী বা দলবদ্ধ ভাবে। স্বেছায়। আসছে ওই ধর্ণা মঞ্চের কাছে। খালি হাতে নয়। হাতে ব্যাগ ভর্তি খাবার। ক্রেট ক্রেট জলের বোতল। ফলমূল। কিছু না কিছু নিয়ে। কারো কারো মুখে স্লোগান, “জাস্টিস ফর অভয়া”, “জাস্টিস ফর আর.জি.কর”। কেউ বা একদম নিরব। আমরা আমাদের আত্মীয়দের বাড়ি গেলে যেমন হাতে করে কিছু নিয়ে যাই, ঠিক তেমন। আত্মীয়! মনের মনের মানুষ। প্রাণের টানে নিয়ে আসছে।
জানতে পারছিলাম, এই এনজিও বায়ো টয়লেট দিয়েছে, ওই অর্গানাইজেশন স্ট্যান্ড ফ্যান এনেছে, ইঞ্জিনিয়াররা চার্জিং স্টেশন বানিয়ে দিয়ে যাচ্ছে, কোন এক লজেন্স বিক্রেতা নিজের এক দিনের উপার্জন হাতে করে নিয়ে এসেছেন, এক সোসাইটি ত্রিপল দিয়ে গেছে, সুইগি, জোমাটো থেকে খাবার আসছে – বলছে যিনি বুক করেছেন, বলে দিয়েছেন, এখানে খাবার দিতে! মনের মধ্যে অদ্ভুতরকম স্পন্দন হচ্ছিল। সেই মূহুর্তে স্লোগান গুলোকে মনে হলো যেন, মহালয়া শুনছি।
“দেবী সজ্জিতা হলেন অপরূপা রণচন্ডী মূর্তিতে।
হিমাচল দিলেন সিংহ বাহন।
বিষ্ণু দিলেন চক্র।
পিনাকপাণি শঙ্কর দিলেন শূল।
যম দিলেন তাঁর দন্ড।
কালদেব সুতীক্ষ্ণ খড়্গ, চন্দ্র অষ্টচন্দ্রশোভা চর্ম দিলেন। ধনুর্বাণ দিলেন সূর্য্য, বিশ্বকর্মা অভেদ বর্ম।”
এই যে সহনাগরিকরা আসছেন, স্বেচ্ছায় – কেন? ভাবছিলাম। অকারণ, অহেতুক মন আর্দ্র হলো। চশমার কাঁচ ঝাঁপসা হয়ে গেলো। এই কলকাতাকে চিনতাম না। নতুন করে চিনছি।
ভাবতে ভাবতেই পাশের ভদ্রলোককে বললাম, “ভাবতে পারেন, এই ভাবে জন(অ)সাধারন আমাদের জন্য খাবার নিয়ে আসছে! এই দৃশ্য কখনো চোখে দেখবো ভাবিনি।” ভদ্রলোক জবাব দিলেন, “ডাক্তারদের উপর রাগ দেখিয়েছি আগে, কিন্তু বুঝিনি কোন পরিস্থিতিতে কাজ করেন তাঁরা। আপনাদের পোস্টে দেখেছি আপনারা বহুবার বলেছেন সঠিক স্বাস্থ্য পরিষেবা পেতে আমাদের মতো জনসাধারণের পথে নামা উচিত। সরকার তার অন্তরায়। ডাক্তাররা নয়। বুঝিনি। ভুল বুঝেছি। বুঝেও চুপ থেকেছি। আজ আমাদের মতো মানুষ আপনাদের সাথে পথে আছে। আমার স্ত্রী পুত্র ভেতরে গেছে খাবার নিয়ে… শুধু অভয়াই নয়, এই পচে গলে যাওয়া সিস্টেম, এই নৈরাজ্য, এই ধান্দাবাজি, এই মিথ্যাচার, এই হুমকি কালচার সবমিলিয়ে চারিদিকে যে ভয়াবহ পরিস্থিতি এবং কিছু মানুষের ভেক ধরা নরপশুদের হাত থেকে আমাদের রাজ্য কে বাঁচাতে যে সামাজিক বিপ্লব আপনারা করছেন, এত বাধা, বিপদ সব পার করে, দিনের পর দিন যে আপনারা যে রাস্তায় পরে আছেন, আমরা অন্তর থাকে এই লড়াইকে অকুণ্ঠ সমর্থন জানাই। এ লড়াই আপনাদের নয়, আমাদের সকলের, আমাদের সকলের অধিকারের লড়াই… সাথে আছি। থাকবো।”
আরো একবার চশমার কাঁচ আবার ঝাঁপসা হলো। হাত দুটো ধরে ধন্যবাদ শব্দটাও উচ্চারণ করতে পারলাম না। গলার কাছে একটা দলা যেন জমা হল। উঠে এলাম… ওই ভীড়ের মধ্যে মিশে গেলাম…
মনে মনে আবার প্রণাম সারলাম…
এটা মানুষের লড়াই। ডাক্তারদের নয়। মানুষ এই লড়াই বুঝে নেবে…
পরিশেষে,
এই পরিশেষ অংশটি এক সহনাগরিক লিখেছেন, নাম জানি না…
কোনটা শর্ত?
১২ থেকে ১৫ জন, না
সব হাসপাতালের প্রতিনিধি?
কোনটা খোলা মন?
রুদ্ধদ্বার বৈঠক, না
সরাসরি সম্প্রচারিত বৈঠক?
কোনটা আশ্চর্যের?
ভোররাতে ইমেইল, না
সন্ধ্যার পর পোস্ট মর্টেম?
কোনটা রাজনীতি?
সকলের সাথে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া, না
তড়িঘড়ি মৃতদেহ দাহ করিয়ে দেওয়া?
কোনটা চিকিৎসকের দায়িত্ব?
অসুস্থ দুর্নীতির মধ্যে বসে পরিষেবা দেওয়ার চেষ্টা করা, না স্বাস্থ্যক্ষেত্রে সুচিকিৎসার উপযুক্ত পরিবেশ সুনিশ্চিত করা?
উত্তর চাই
বললাম যে! মানুষের লড়াই, মানুষই বুঝবে…