মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী অবশেষে ধর্ণামঞ্চে এলেন।
অসাধারণ পদক্ষেপ। না, এতটুকু শ্লেষ নিয়ে বলছি না। খুব অনেস্টলি বলছি, মাননীয়ার এই পদক্ষেপ আমার অসাধারণ মনে হয়েছে। এবং তা শুধুই রাজনৈতিক বিচক্ষণতার পরিচয় হিসেবে অসাধারণ, এমনও নয়।
এই কাজটা আরও আগে করা যেত কিনা, কখন করলে সবচাইতে ভালো হতো, সেসব কথাও আপাতত মুলতবি রাখছি – আপাতত মুখ্যমন্ত্রীর এই সিদ্ধান্তকে শুধুই স্বাগত জানাই।
কিন্তু কিছু প্রশ্ন রয়েই গেল।
প্রথমেই প্রশ্ন তোলা যায়, দুর্নীতির অভিযোগ যা যা নিয়ে, সেসব টেন্ডারের একটিও তাঁর কাছে আসেনি। কিন্তু নিজের দফতরের যাবতীয় টেন্ডার বিষয়ে যিনি সম্পূর্ণ অন্ধকারে থাকেন, তিনি কেমন মন্ত্রী? সেক্ষেত্রে তো আজই মুখ্যমন্ত্রীর উচিত স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে বরখাস্ত করা। করবেন? নাকি শুধুই তদন্ত করার প্রতিশ্রুতি দেবেন?
কিন্তু এটা মূল প্রশ্ন নয়। যেসব টেন্ডার নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ উঠছে, সেগুলো খতিয়ে দেখা বা রোগী কল্যাণ সমিতিগুলো নতুন করে তৈরি করা, পদক্ষেপ হিসেবে এগুলো গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরি হলেও এসব দিয়ে স্বাস্থ্য-দফতরের গণ্ডগোলের মূলের কাছাকাছিও পৌঁছানো যাবে না।
ধরুন, থ্রেট কালচার বা হুমকির সংস্কৃতি। রোগী কল্যাণ সমিতি দিয়ে তো সেই সংস্কৃতি জিইয়ে রাখা নেই। নতুন রোগী কল্যাণ সমিতি তৈরী করে তো তার সুরাহা হবে না।
ধরুন, প্রশ্নপত্র বিক্রি করা। পয়সার বিনিময়ে ভালো নম্বর পাইয়ে দেওয়া। এ বিষয়ে তো কোনও টেন্ডার আহ্বান করা হয়নি। টেন্ডারের দুর্নীতির অভিযোগ পেলে মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী খতিয়ে দেখবেন বলে জানিয়েছেন – কিন্তু এই অভিযোগ?
বা ধরুন, যেসব দুর্নীতির কথা রোজই সামনে আসছে। যেমন, হাসপাতালের বর্জ্য সামগ্রী, সিরিঞ্জ ইত্যাদি, বাইরে বেচে দেওয়া। যেমন, চোরাপথে কিডনির ব্যবসা। টেন্ডারে দুর্নীতির অভিযোগ জানিয়ে বা রোগী কল্যাণ সমিতি নতুন করে তৈরী করলে তো এসব সমস্যার সুরাহা হবে না।
রাজ্য মেডিকেল কাউন্সিল – চিকিৎসার নীতি-নৈতিকতা রক্ষিত হচ্ছে কিনা, তা খতিয়ে দেখা যাঁদের মূল কাজ – সেখানে বসে আছেন এমন কিছু চিকিৎসক, যাঁদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও হুমকি-সংস্কৃতি চালু রাখার অভিযোগ। মুখ্যমন্ত্রী যখন প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন, যে, ডাক্তারদের ক্ষোভের জায়গাগুলো তিনি খতিয়ে দেখবেন, বর্তমান মেডিকেল কাউন্সিলটি অক্ষুণ্ণ রেখে সেই খতিয়ে দেখা কি আদৌ সম্ভবপর?
কলেজে কলেজে হুমকি-সংস্কৃতির অভিযোগ অথবা প্রশ্নপত্র দুর্নীতি বা পরীক্ষায় অনাচারের অভিযোগ – একটিরও কি সুবিচার সম্ভব, যদি তদন্ত চলাকালীন স্বাস্থ্যশিক্ষা-অধিকর্তা পদে বহাল থাকেন?
তো মোদ্দা কথাটা হলো – স্বাস্থ্যসচিব, স্বাস্থ্যশিক্ষা-অধিকর্তা এবং রাজ্য মেডিকেল কাউন্সিলের দুর্নীতিগ্রস্ত তত্ত্বাবধায়কবৃন্দ, এঁদের পদে বহাল রেখে কোনও দুর্নীতির অভিযোগই খতিয়ে দেখা সম্ভব নয়, দুর্নীতির সুরাহা তো অনেক অনেএএক দূরের কথা।
কার্যকরী আলোচনা করতে হলে, অন্তত এটুকু সত্য মেনে নিয়ে তারপরই আলোচনা শুরু করা উচিত। স্রেফ অভিযোগ শুনেই কারও বিরুদ্ধে ফৌজদারি মোকদ্দমা চালু হয়ে যাক বা কাউকে গ্রেফতার করে ফেলা হোক – এতখানি আবদার আমার নেই। কিন্তু যাঁরা পদে থাকাকালীন এতখানি দুর্নীতি-অনাচার ঘটতে পারল, তাঁদের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া – নিদেনপক্ষে পদত্যাগ করতে অনুরোধ করা – এটুকু তো প্রাথমিক কর্তব্য।
তো, আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করতে চাই, এমন কথা বলতে বা ভাবতে ভালো লাগে, শুনতে তো আরও ভালো লাগে। তবে মুখে একরকম কথা বলা আর কাজের মধ্যে তেমন সদিচ্ছার তিলমাত্র আভাস না থাকাটা কিন্তু মোটেই ভালো ব্যাপার নয়।