জুন মাসের ৩,৪ ও ৫ তারিখে UNICEF-এর সহযোগিতায় এবং শ্রমজীবী স্বাস্থ্য উদ্যোগ ও WBDF-এর তত্ত্বাবধানে আমরা গোসাবা ব্লকের তিনটি দ্বীপের তিনটি গ্রামপঞ্চায়েতের নয়টি উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রে বেশ কিছু রোগীর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করি। গোসাবা ব্লকের BMOH, আশা কর্ম্ ANM ও সিস্টার দিদিমণিরা সর্বতোভাবে আমাদের সহযোগিতা করেছেন।
এই তিনদিন নয়টি উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রে আমাদের কাছে এসে ছিলেন প্রায় ৫৩০ জন; তার মধ্যে রোগীনির উপস্থিতির হারই বেশি অনেকেই দীর্ঘস্থায়ী শারীরিক সমস্যায় কষ্ট পাচ্ছেন। দীর্ঘ লকডাউনে যোগাযোগের অব্যবস্থা ও আর্থিক দুরবস্থার কারণে অনেকেই ওষুধ বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন, তাঁরা হয়ত কিছুটা সুরাহা পেলেন, কিন্তু অধিকাংশ মানুষই এই ক্যাম্প গুলিতে আসেন নি; কিছুটা বর্তমান পরিস্থিতিতে Corona ভাইরাস সংক্রমণের ভয়, কিন্তু আসল কারণ হতাশা। ডাক্তারবাবুরা প্রতিবার প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের (বন্যা-ঝড়) পরে দু-এক দিন আসেন কিছু ওষুধ মেলে কিন্তু তাতে কতদিন আর চলে? তারপর আবার তো সেই গতানুগতিক অবস্থা; সরকারি ভাবে ওষুধ আর জরুরী কিছু পরিষেবা (স্বাভাবিক প্রসব/সাপের কামড়/কীটনাশক খাওয়া)অবশ্য পাওয়া যায় গোসাবা গ্রামীণ হাসপাতালে। কিন্তু পরিষেবা নেবার জন্য তো হাসপাতালে যেতে হবে দু-তিন বার খেয়া পারাপার করে; হাসপাতালে পৌঁছাতে পারা আবার এক ই ভাবে ফেরত আসা; দীর্ঘস্থায়ী শারীরিক সমস্যায় কষ্ট পাওয়া একজন বয়স্ক মানুষের পক্ষে এটা যতটা শারীরিক ভাবে কষ্টসাধ্য ঠিক ততটাই কষ্টের যাতায়াতের খরচ জোগাড় করা। তার থেকে ভালো ওষুধের ঝামেলা বাদ দেওয়া; আর নাহলে কোয়াক ডাক্তারই ভরসা। জরুরী দরকার হলে বাধ্য হয়ে হাসপাতালে যেতে হবে আর নাহলে কাছাকাছি স্থলভাগে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা নার্সিং হোমে অস্বাস্থ্যকর পরিবেষে ভগবানের ওপর বিশ্বাস আর কোয়াক ডাক্তার বাবুর প্রতি ভরসা রেখে বেশ কিছু টাকা খরচ করে পরিষেবা পেতে হবে; গোসাবা গ্রামীণ হাসপাতালের ডাক্তারবাবুরা মাঝে মধ্যে কিছু old age ক্যাম্প করে থাকেন ঠিকই কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় তা বেশ অপ্রতুল।
আমাদের এই ক্যম্পগুলি যদি আরও কিছু নিয়মিত ভাবে করতে পারি তাহলে হয়ত মানুষজনের একটু সুরাহা হবে। উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ANM দিদিমনি রা গর্ভবতী মায়েদের কিছু ওষুধ (আয়রন/ক্যালসিয়াম) দিয়ে থাকেন যা সরকারী ভাবে যোগান থাকে কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী শারীরিক সমস্যার কোনো ওষুধ প্রায় থাকে না বললেই চলে। যদি এই উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলিতে আরও কিছু ওষুধ সরবরাহের ব্যবস্থা করা যায় তাহলে এই গরীব মানুষগুলোর কিছু উপকার হয় অন্ততপক্ষে হাসপাতালের প্রেসক্রিপসান দেখিয়ে উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলি থেকে তাঁরা প্রয়োজনীয় ওষুধ সংগ্রহ করতে পারেন।
গোসাবা ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলিতে আমফান ঝড়ে ক্ষতির পরিমাণ অনেকটাই কম; তার একটা বড়ো কারণ আয়লা ও বুলবুল ঝড়ে যা ক্ষতি হয়েছে তার থেকে শিক্ষা নিয়ে এরা এখন অনেকটাই সাবলম্বী; কারও ভরসায় না থেকে গ্রামবাসীরা পরেরদিন গাছ কেটে সরিয়ে ফেলে ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তা মেরামত করে।
কিছু জায়গায় নদী বাঁধ ভেঙে চাষের জমি ও পুকুর প্লাবিত হয়। বোরো চাষের ফসল আগেই তুলে নেবার ফলে ফসলের কোনো ক্ষতি হয়নি। নোনাজল বের করে গ্রামবাসীরা নিজেরাই নদীবাঁধ মেরামত করে, তবে এই বাঁধগুলি বেশ দুর্বল আবার কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে এই বাঁধগুলির ক্ষতি হবার আশংকা থেকেই যায়। আয়লা পরর্বতী যে ক্ষতিগ্রস্ত নদীবাঁধগুলি কংক্রিটে বাঁধানো হয় সেগুলির অবশ্য তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি।
নদীর নোনাজল জল গ্রাম ঢুকে সাময়িক ক্ষতি না হলেও দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতির সম্ভাবনা আছে। আগামী ২-৩ বছর চায আবাদ হয়তো ভালো করে হবে না। জীবনযুদ্ধের তাগিদে হয়তো আবারো অনেকেই হবে পরিযায়ী শ্রমিক নতুবা ভরসা জঙ্গলের কাঠ মধু মাছ কাঁকড… কিন্তু বিপদ তো পিছু ছাড়ে না সেখানেও মাঝেমধ্যে অনেকেরই প্রাণ যায় বাঘের আক্রমণে।
মাটির বাড়িগুলি অনেকটাই ক্ষতিগ্রস্ত কিন্তু আয়লার পরে অনেকে নিজেদের আর্থিক সামর্থ্য অনুযায়ী পাকা বাড়ি তৈরি করে নেওয়ায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অনেকটাই কম; যেগুলির ক্ষতি হয়েছে গ্রামবাসীরা নিজেরা সামর্থ্য অনুযায়ী তার অনেকটাই মেরামত করে নিতে পেরেছে।
গ্রামীণ অর্থনীতির বিকল্প ভাবনার প্রয়োজন। সরকারি স্বনির্ভর কোনো প্রকল্প ক্ষুদ্র কুটির শিল্প এবং তার মূলধন যেন এই প্রান্তিক মানুষ জনের কাছে কাছে সহজে পৌঁছানো যায় তার ব্যবস্থা করা প্রয়ো…
নদী বাঁধের ভাঙ্গন রোধ করার জন্য সুন্দরবন তথা কলকাতার প্রাকৃতিক রক্ষাকবচ ম্যানগ্রোভ অরণ্যের রক্ষার ব্যবস্থা করা এবং ক্ষতিগ্রস্ত নদীবাঁধের যথাযথ মেরামতের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন; অবৈধ নির্মাণকাজের জন্যেও নদীবাঁধ ও ম্যানগ্রোভ অরণ্যের অনেকটাই আজ ক্ষতিগ্রস্ত।
আমার এই লেখার উদ্দেশ্য সাময়িক ভাবে এই মানুষগুলির পাশে থেকে আত্মতৃপ্ত না হয়ে দীর্ঘমেয়াদি কোনো উপায় খুঁজতে চাওয়া, যাতে গ্রামের মানুষ আরও বেশি করে স্বনির্ভর হতে পারে; যদি এভাবে কোনো একটি গ্রামকেও আমরা স্বনির্ভর হবার পথে কিছুটা সাহায্য করতে পারি ও তাকে মডেল হিসেবে তুলে ধরতে পারি, ভবিষ্যতে হয়তো আরো অনেকে তার থেকে শিক্ষা নিতে পারে।
এই রিপোর্ট লিখেছেন ডাঃ পূর্ণেন্দু দত্ত।