হোম আইসোলেশনে তো প্রবেশ করলাম। কিন্তু প্রবেশ করার পরে বুঝলাম অনেক সমস্যা, অনেক জটিলতা, অনেক বিভ্রান্তি আছে। সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। তার আগে বরং আলোচনা করা যাক, আইসোলেশনে যেতে হল কেন। এক কথায় উত্তর, করোনা পরীক্ষায় পজিটিভ ধরা পড়েছে বলে। তার সঙ্গেই অবধারিত প্রশ্ন আসে, টেস্ট কেন করতে হলো।
একটু আগের থেকে বলি। আগস্ট মাসের শেষ সপ্তাহটা বেশ গরম ছিল। বস্তুত এবছর আমরা, উত্তরবঙ্গবাসী গরম খুব একটা টের পাই নি। মাঝে-মধ্যে কয়েকদিনের জন্য পড়েছে। সেরকমই একটা স্পেল ছিল আগস্টের শেষ সপ্তাহে। যথারীতি গরমের প্রকোপে বারবার স্নান, এমন কি রাত এগারোটাতেও। ঠান্ডা জল একটু বেশি খাওয়া। প্রতি বছর এই সময়টা অনেকেরই ঠান্ডা লাগা, সর্দি-কাশি-জ্বর – এসব একটু-আধটু হয়। আমার তো হয়ই। কখনো বেশ বাড়াবাড়িই হয়। এবারও একদিন টের পেলাম, গলাটা একটু খুসখুস করছে, নাকটা যেন ভেজা ভেজা। সতর্ক হলাম ঠিকই, কিন্তু যা হবার তা তো হয়ে গেছে। আমার দৃঢ় ধারণা ছিল আবহাওয়ার পরিবর্তন, তাপমাত্রা এবং আর্দ্রতার ওঠানামা – এসবই কারণ।
প্রথম দু দিন সেরকম কিছু সমস্যা ছিল না। তৃতীয় দিন ভোরের দিকে বুঝলাম জ্বর আসছে। ঘুম ভেঙে গেল। ঠান্ডা লাগছে। গায়ে চাদরটা টেনে নিলাম। হাত-পা রীতিমতো ব্যাথা করছে। সকালে চা-বিস্কুট খেয়ে প্যারাসিটামল খেয়ে নিলাম। তাতে অনেকটাই স্বস্তি পাওয়া গেলো। বাজারও করলাম। গলা ব্যাথা একটু একটু টের পাচ্ছিলাম ঠিকই, কিন্তু সেরকম সিরিয়াস কিছু মনে হয়নি। চতুর্থ দিন রাত থেকে একটু বাড়াবাড়ি মনে হচ্ছিল। তারপরে ক্রমশ বাড়তে থাকে — গা হাত পা ব্যাথা, সঙ্গে গলা ব্যাথা। প্যারাসিটামল চালিয়ে যেতে থাকি। সঙ্গে লবণ জলের গার্গলও শুরু করি।
প্যারাসিটামলের জন্য জ্বরের প্রকোপ কম ছিল, কিন্তু জ্বর-জ্বর একটা ভাব, গা-হাত-পা চাবানো আর দুর্বলতা সারাদিনের সঙ্গী। গলা ব্যথা ক্রমশ তীব্রতর হতে থাকে। খাবার গিলতে, এমনকি জল বা চা খেতেও অসুবিধে। কী খাচ্ছি, তার স্বাদ পাচ্ছিলাম না। গন্ধও বোধহয় ঠিকঠাক পাচ্ছিলাম না। এই সমস্ত উপসর্গই কিন্তু খুব সাধারণ। শ্বাস নালীর যেকোনো ধরনের ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাস সংক্রমণ অথবা অ্যালার্জি জনিত রোগে মোটামুটি এ ধরনের উপসর্গ হয়ে থাকে। ছোটবেলা থেকে আমারও বহুবার হয়েছে। তবে খুব অদ্ভুত ব্যাপার, কাশি কিন্তু প্রায় ছিল না। দুশ্চিন্তা একটু থাকলেও করোনা সংক্রমণ যে হয়নি তা নিজেকে বোঝাচ্ছিলাম। অন্যদেরও। অন্যরাও আমাকে তাই বোঝাচ্ছিলেন।
তবে প্রথম দিন থেকেই আমি কিন্তু নিজেকে অনেকটা বিচ্ছিন্ন করে নিয়েছিলাম পরিবারের বাকিদের থেকে, বিশেষত বাচ্চারা এবং আমার মা। বাইরে খুব একটা যাচ্ছিলাম না। কিন্তু গলা ব্যথা আর দুর্বলতা আরো বাড়তে থাকায় চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলাম। টেলিফোন মারফত। পুণ্যদা। মানে ডাক্তার পুণ্যব্রত গুণ। গত প্রায় পাঁচ বছর আমি ওঁরই চিকিৎসাধীন। আমাদের মেডিকেল ক্যাম্পে। ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতির মাথাভাঙ্গা শাখা এবং শ্রমজীবী স্বাস্থ্য উদ্যোগের যৌথ পরিচালনায় মাথাভাঙ্গায় যে মাসিক যুক্তিসম্মত চিকিৎসা শিবির চলে, সেখানে। তিনি প্যারাসিটামলের ডোজ একটু বাড়িয়ে দিলেন, আর কিছু রক্তের পরীক্ষা। হিমোগ্লোবিন, টিসি-ডিসি-ইএসআর, এএসও টাইটার। সঙ্গে অমোঘ ঘোষণা করলেন, “সম্ভব হলে করোনা টেস্ট করিয়ে নাও।” সন্ধ্যাবেলায় রিপোর্ট পাঠালাম। বললেন – ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ হয়নি। সুতরাং কোনরকম অ্যান্টিবায়োটিকের প্রয়োজন নেই। ভাইরাস সংক্রমণই মনে হচ্ছে। যদি একটু অসুবিধা হয়, করোনা টেস্ট করার কথা আবার বললেন।
প্যারাসিটামল আর গার্গল চলতে থাকল। টেস্ট করাবো কি করাবো না যখন ভাবছি, তার মধ্যেই ছোট মেয়ের জ্বর এলো। এরপর আর ভাবার কিছু ছিল না। সোজা চলে গেলাম মাথাভাঙ্গা মহকুমা হাসপাতালে কোভিড পরীক্ষা শিবিরে। পরের দিন সংবাদ।
এখন প্রশ্ন হল, পরীক্ষা না করালে কী হতো? আমার কিছুই হতো না। যদিও আমার বেশ কিছু রোগ আছে (ডায়াবেটিস নেই), কয়েক রকমের ওষুধ প্রতিদিন খেতে হয়, তা হলেও সম্ভবত আমার বড় কোন সমস্যা হতো না। অন্তত হয়নি যে, তা তো দেখাই যাচ্ছে। কিন্তু সমস্যা হতে পারত সাত বছর বয়সী আমার ছোট মেয়ের এবং সাতাত্তর বছর বয়সী আমার মা’র। যতই আলাদা ঘরে থাকি, আইসোলেশন বলতে যা বোঝায় সেটা তো হচ্ছিল না। আমি তো পুরোপুরি ঘরবন্দি ছিলাম না তখন। স্বাভাবিকভাবেই কোন না কোনভাবে সংক্রমণ হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা ছিল।
এখানে একটি কথা বলা প্রয়োজন। কোভিডের কিন্তু এখনও পর্যন্ত কোন চিকিৎসা নেই। মাঝারি এবং তীব্র উপসর্গযুক্ত রোগীদের হাসপাতালে ভর্তি করে উপসর্গের বিভিন্নতা ও তীব্রতা অনুসারে চিকিৎসা করা হয়। এক্ষেত্রে সময় মতো রোগ নির্ণয় এবং হাসপাতালে ভর্তি হওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আবার উপসর্গহীন এবং মৃদু উপসর্গযুক্ত রোগীদের সে অর্থে কোন চিকিৎসার প্রয়োজন নেই। তবে নজরদারিতে থাকা প্রয়োজন। আর সবচেয়ে প্রয়োজন হল বিচ্ছিন্ন থাকা, বাড়িতে বা সরকারি সেফ হোমে। সাধারণত যে কোন রোগের ক্ষেত্রে রোগ নির্ণয় এবং তার চিকিৎসা করা হয় রোগীকে সুস্থ করার লক্ষ্যে। তবে, এক্ষেত্রে এই বিচ্ছিন্ন থাকা কিন্তু নিজের জন্য নয়। পরিবারের স্বার্থে, প্রতিবেশীদের স্বার্থে, বৃহত্তর সমাজের স্বার্থে।
তাই অন্তত উপসর্গযুক্ত ব্যক্তিদের এবং তাঁদের সরাসরি সংস্পর্শে যাঁরা এসেছেন, প্রত্যেকের পরীক্ষা করানো প্রয়োজন। এই কয়েকদিনে প্রচুর মানুষের সঙ্গে ফোনে কথা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে বেশ কয়েকজন বলেছেন, আমার মতো বা একটু কম উপসর্গ তাঁর এবং তাঁর পরিবারের এক বা একাধিক সদস্যের ছিল। কিন্তু পরীক্ষা করান নি। ঠিক হয়ে গেছে। কেউ বা বলেছেন, চিকিৎসকই নাকি পরীক্ষা করাতে নিষেধ করেছেন। অনেককেই দেখছি উপসর্গ গোপন করে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছেন। চিকিৎসক পরীক্ষা করানোর পরামর্শ দিলেও উপেক্ষা করছেন। আমার মনে হয়, এগুলো সঠিক সিদ্ধান্ত নয়। অবশ্য, রোগ গোপন করার এই প্রবণতার পেছনে সর্বত্র সরকার ও স্থানীয় প্রশাসনের কিছু কাজকর্মের এবং গণ মাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমের বড় ভূমিকা আছে। এ বিষয়ে সম্ভব হলে পরে লেখার ইচ্ছে থাকল।
(ক্রমশ)