ছোট্ট একটা খুপরিতে রোগী দেখছি।
মাঝ বয়সী ভদ্রমহিলা ধপাস করে টুলে বসে বললেন, ‘ওহ… আপনাকে দেখানোর জন্য যা অপেক্ষা করতে হলো…. আঁটি পুঁতলে এতক্ষণে আম গাছ হয়ে যেত।’
এসব মন্তব্যের উত্তর দিতে নেই। গম্ভীর গলায় বললাম, ‘নাম বলুন।’
উনি বললেন, ‘উর্মিমালা চট্টোপাধ্যায় সান্যাল রায়চৌধুরী।’
‘সর্বনাশ…’
ভদ্রমহিলা বললেন, ‘সর্বনাশ তো অবশ্যই। পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা আমার নামের সর্বনাশ করে দিয়েছে। বিয়ের আগে ছিলাম চট্টোপাধ্যায়। বিয়ের পরে যোগ হলো সান্যাল।’
আমি বললাম, ‘আর রায়চৌধুরী? সেটা কোথা থেকে এলো?’
ভদ্রমহিলা হাসলেন। বললেন, ‘প্রথম বিয়ে টেঁকেনি। তিন বছরের মধ্যে ডিভোর্স হয়ে গেছে। কিন্তু ততদিনে প্যান কার্ডে, ভোটার কার্ডে- সবকিছুতেই চট্টোপাধ্যায় সান্যাল হয়ে গেছি। বর্তমান স্বামীর টাইটেল রায়চৌধুরী।’
কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। অনেক রোগী জড়ো হয়েছে। প্রায় সকলেই অধৈর্য হয়ে উঠেছে। অধৈর্য রোগীদের আমি বড় ভয় পাই। আজকেই একটি খবর সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে। বাঘাযতীন হাসপাতলে এক অধৈর্য রোগী চিকিৎসকের প্যান্ট খুলে নিতে চেয়েছেন।
মহামারীর প্রথমদিকে সাধারণ মানুষ ভয়ে ভয়ে ছিলেন। যত দিন যাচ্ছে তত ভয় কাটিয়ে তাঁরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চাইছেন। তার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে ডাক্তার পেটানো শুরু হয়েছে। ঝাড়গ্রাম, কালনা, কুমারগ্রাম সব জায়গা থেকেই নিয়মিত চিকিৎসক নিগ্রহের খবর আসছে।
যত এইসব খবর পাচ্ছি, ততো মনটা খিঁচড়ে যাচ্ছে। প্রায় সাড়ে চারশো চিকিৎসক করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে মারা গেছেন। তাদের কথা কেউ মনে রাখেনি। এমনকি স্বয়ং কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, তাঁর দপ্তরে করোনায় আক্রান্ত স্বাস্থ্যকর্মীদের মৃত্যুর তথ্য নেই।
একের পর এক সহকর্মীদের মৃত্যুর খবরে হৃদয় ক্ষত বিক্ষত হচ্ছিল, কিন্তু ভয় পাইনি। বরঞ্চ তাদের নিঃশেষে প্রাণ বলিদান দেখে অনুপ্রাণিত হচ্ছিলাম। স্বাস্থ্যকর্মীদের নিগৃহীত হওয়ার খবরে আবার ভয় পেতে শুরু করেছি। বুঝতে পারছি করোনা যত ছড়াবে, নড়বড়ে পরিকাঠামো আড়াল করে দাঁড়ানো চিকিৎসকদের ওপর আঘাত আরো বাড়বে। নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকার জন্য অনেকেই ডাক্তারদের, স্বাস্থ্যকর্মীদের বলির পাঁঠা করবেন।
আমি কোনরকম সুরক্ষাহীন খুপরিজীবী চিকিৎসক। মাঠে- ঘাটে- হাটে রোগী দেখে বেড়াই। বাঁচানোর কেউ নেই। বাড়িতে তবু সঞ্জয়দা আর গৌড় থাকে। বাইরের খুপরিতে ভগবানই ভরসা।
তবে এখানেও একজন আছেন। আমি খুপরিতে ঢুকলেই চুপচাপ বাইরে দাঁড়িয়ে থাকেন। সামনের চায়ের দোকানের কাকু। শুকনো চেহারা। মাঝে মাঝেই পেটে ব্যথায় ভোগেন। বয়স পঁয়ষট্টি থেকে সত্তরের মধ্যে।
লকডাউন এর সময় চায়ের দোকান বন্ধ ছিল। তখনো আসতেন। দিনের পর দিন কোনো আয় নেই। চলছে কি করে জিজ্ঞাসা করতে ভয় পেতাম।
আমি আসলেই এক কাপ চা বানিয়ে দেন। করোনার সময়ে রোগী দেখতে দেখতে চা খাওয়া সম্ভব নয়। চা আস্তে আস্তে ঠান্ডা হয়। তবুও বারণ করিনা। কারণ ওই চাটুকু দিয়েই কাকু ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকেন। ভিড় সামলান। কেউ ঝগড়াঝাঁটি করলে ধমক লাগান। লগবগে তালপাতার সেপাই-এর উপর ভরসা করে আমি নির্ভয়ে রোগী দেখি।
আমি কি চা কাকুর কোনদিনও কোন উপকার করেছিলাম? মনে তো পড়ে না। বরঞ্চ ওনার ছোট ছেলেকে আমি বাঁচাতে পারিনি।
বছর দুয়েক আগে ছেলেকে নিয়ে এসেছিলেন। পেট বাজিয়ে বুঝেছিলাম জলে ভর্তি। সম্ভবত অ্যালকোহলিক লিভার সিরোসিস।
কাকুর আর্থিক অবস্থা তার হতশ্রী চায়ের দোকানের মতই। আর জি করে পাঠালাম। অনেক ঘোরাঘুরির পর ভর্তি হলো। পরীক্ষা-নিরীক্ষা হলো। রোগ একই বেরোলো। আলকোহলিক সিরোসিস আর এসাইটিস।
তারপর ছেলেটি মাঝে মাঝে আমার কাছে আসতো। আর জি কর হাসপাতালেও যেত। আস্তে আস্তে পেটের ফোলা কমে গেল। কাজকর্মও শুরু করেছিল।
একদিন ভোরে কাকু ভ্যানে করে ছেলেকে আমার কাছে নিয়ে এলেন। খুব খারাপ অবস্থা। মাঝরাত থেকে রক্ত বমি করছে। ভোর রাত থেকে অজ্ঞান।
সাথে সাথে কাছাকাছি হাসপাতালের এমার্জেন্সিতে নিয়ে যেতে বললাম। কিন্তু ছেলেটি রাস্তাতেই মারা যায়।
পুত্র হারা পিতার প্রতিক্রিয়া অদ্ভুত হলো। কাকু তারপর থেকে যখনই ওই চেম্বারে যাই, চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকেন। কেন দাঁড়িয়ে থাকেন- জিজ্ঞেস করলে হাসেন। বলেন, ‘ভালো লাগে।’
অথচ উল্টোটাই হওয়া উচিত ছিল। মিডিয়ায় উল্টো ঘটনা দেখে আমরা অভ্যস্ত। ভরসার বিষয় মিডিয়ার বাইরেও একটা জগত আছে। বিশাল জগত। সেখানকার মানুষেরা হাজার প্রলোভন সত্বেও খুব খারাপ নন। কোন ঘটনা ঘটলেই চিকিৎসককে দলবেঁধে পেটাতে আসেন না। ক্ষতিপূরণের জন্য ঘনঘন “সিপিএ”তে কেস করেন না।
তবে বুঝতে পারি সেটুকু ভরসার জায়গাও বেশিদিন থাকবে না। আমাকেও হয়তো ঝামেলা থেকে বাঁচতে মাথার ওপরে ছাদ খুঁজতে হবে। স্বাধীন খুপরিজীবী চিকিৎসকের অপমৃত্যু হবে। নিরাপত্তা দিতে পারেন এমন কোনো প্রভুর কাছে নিজেকে বন্ধক রাখতে হবে।
তবে যতদিন তা না হয়, আমি দিনলিপি লিখে যাই।