সবচেয়ে বেশি যে বাতে মানুষ ভোগেন, তা হল অস্টিওআর্থ্রাইটিস। ব্রিটিশ যুক্তরাজ্যের NHS-এর রোগীদের জন্য জ্ঞাতব্য তথ্য থেকে প্রস্তুত এই প্রতিবেদন।
গাঁট বা অস্থিসন্ধিতে ব্যথা এবং শক্তভাব (stiffness) হল অস্টিওআর্থ্রাইটিসের প্রধান উপসর্গ। কারুর কারুর অবশ্য গাঁটে ফোলা, গাঁটে টিপলে ব্যথা গাঁটটির নড়াচড়ায় খরখরে শব্দ হয়। কখনও জোড়ের নড়াচড়া করার সীমা কমে যায়। কম ব্যবহারের ফলে মাংসপেশি দুর্বল হয়, শুকিয়ে যেতে পারে। সবার কষ্ট একই রকম হবে এমনটা নয়, আবার একই মানুষের একাধিক জোড় আক্রান্ত হলে সব জোড়ে সমান উপসর্গ থাকবে এমনটাও নয়।
কারুর উপসর্গ থাকে অল্প, আসে-যায়। অনেকের কষ্ট লেগেই থাকে, তীব্রতা এতো বেশি যে দৈনন্দিন কাজকর্ম করে উঠতে অসুবিধা হয়।
যেকোনো জোড়েই অস্টিওআর্থ্রাইটিস হতে পারে, তবে বেশি আক্রান্ত হয় হাঁটু, কোমর (hip joints) আর হাতের ছোট জোড়গুলি।
হাঁটুর অস্টিওআর্থ্রাইটিস
হাঁটুতে এই রোগ হলে, সময়কালে দুটি হাঁটুই আক্রান্ত হয়। অবশ্য আঘাত বা অন্য কোন রোগে একটা হাঁটু প্রভাবিত হওয়া যদি অস্টিওআর্থ্রাইটিসের কারণ হয়, তাহলে আলাদা।
সবচেয়ে বেশি হাঁটু ব্যথা হয় হাঁটলে, বিশেষত চড়াই বা সিঁড়ি ওঠানামা করার সময়। চলতে চলতে কখনও কখনও হাঁটুটা যেন ছেড়ে দেয়, কখনও বা হাঁটুটা সোজা করা কঠিন হয়ে পড়ে। জোড়টা নড়াচড়া করার সময় হাল্কা ঘষার আওয়াজ হয় কোনও কোনও সময়।
কোমরের অস্টিওআর্থ্রাইটিস
এ রোগে কোমরের হিপ জয়েন্ট নড়াচড়া করতে অসুবিধা হয়। জুতো-মোজা পরতে, গাড়িতে ওঠানামা করতে কষ্ট হয়। সাধারণত কুঁচকি আর জোড়ের ঠিক বাইরেটায় ব্যথা হয়। নড়াচড়া করলে ব্যথা বাড়ে, অবশ্য বিশ্রাম করার সময় বা ঘুমোনোর সময়ও ব্যথা হতে পারে।
হাতের অস্টিওআর্থ্রাইটিস
অস্টিওআর্থ্রাইটিস প্রধানত হাতের তিনটে এলাকাকে প্রভাবিত করেঃ
১। বুড়ো আঙ্গুলের গোড়ায়
২। আঙ্গুলের ডগার কাছের জোড়গুলোতে
৩। আঙ্গুলের মাঝের জোড়গুলোতে।
আঙ্গুলগুলো শক্ত, ব্যথা আর ফোলা হয়ে থাকে, আঙ্গুলের জোড়ের ওপর উঁচু হয়ে থাকে। পরে ব্যথা কমে, অনেক সময় থাকেই না আর। কিন্তু ফোলা আর উঁচু থেকে যেতে পারে।
আক্রান্ত জোড়গুলো বাইরের দিকে বেঁকে থাকতে পারে। কখনওবা আঙ্গুলের পেছনে ব্যথাযুক্ত তরল-ভর্তি থলি হয়ে থাকে। কবজি থেকে যেখানে বুড়ো আঙ্গুল—সেখানে ফুলে থাকে অনেকসময়। লেখা, বয়াম খোলা, চাবি ঘোরানোর মতো কাজ করতে তাতে অসুবিধা হতে পারে।
অস্টিওআর্থ্রাইটিস কেন হয়?
আমাদের দৈনন্দিন জীবনে আমাদের জোড়গুলোতে অল্প মাত্রায় চোট-আঘাত লাগতেই থাকে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমাদের শরীর তা থেকে হওয়া ক্ষতি সারিয়ে নেয়, আমরা কোনও কষ্ট বুঝতেই পারি না।
কিন্তু অস্টিওআর্থ্রাইটিসে হাড়ের প্রান্তে থাকা তরুণাস্থিগুলো ভেঙ্গে যায়, ফল—ব্যথা, ফোলা আর জোড়টা নাড়াচাড়া করতে অসুবিধা।
ঠিক কারণটা জানা নেই, কিন্তু দেখা গেছে কিছু অবস্থায় অস্টিওআর্থ্রাইটিস হওয়ার ঝুঁকি বাড়েঃ
- জোড়ে আঘাতঃ কোনও আঘাত বা অপারেশনের ক্ষত সেরে ওঠার আগেই যদি সেই জোড়কে বেশি ব্যবহার করা হয়।
- অন্য রোগের ফলশ্রুতিতে অস্টিওআর্থ্রাইটিস—রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস বা গেঁটে বাত (gout)-তে বেশি আক্রান্ত জোড়ে অস্টিওআর্থ্রাইটিস হতে পারে।
- বয়স—বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অস্টিওআর্থ্রাইটিসের ঝুঁকি বাড়ে।
- পরিবারে অস্টিওআর্থ্রাইটিস থাকলে অস্টিওআর্থ্রাইটিসের ঝুঁকি বাড়ে, যদিও এর জন্য দায়ী কোন জিনকে এখনও খুঁজে পাওয়া যায়নি।
- স্থূলতা—ওজন বেশি থাকায় জোড়গুলোতে চাপ বেশি পড়ে। বিশেষত কোমর ও হাঁটুর মতো যে জোড়গুলো ভার বহন করে, সেগুলো বেশি প্রভাবিত হয়।
অস্টিওআর্থ্রাইটিস রোগ-নির্ণয় কিভাবে?
আপনার ডাক্তার অস্টিওআর্থ্রাইটিস সন্দেহ করবেন যদিঃ
- আপনার বয়স ৫০ বছর বা তার বেশি হয়
- আপনার জোড়ে ব্যথা আছে, কাজ করলে যে ব্যথা
- সকালে জোড়ে শক্তভাব যা ৩০ মিনিটের কম থাকে, অথবা শক্তভাব থাকেই না।
উপসর্গ যদি এর থেকে আলাদা হয়, তাহলে হয়ত অস্টিওআর্থ্রাইটিস নয়। যেমন সকালে জোড়ে শক্তভাব যদি বেশি সময় ধরে থাকে, তাহলে তা হয়ত রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসের কারণে।
সাধারণত এক্স-রে বা রক্তপরীক্ষার দরকার হয় না রোগ-নির্ণয়ে। অস্থিভঙ্গ (হাড়ভাঙ্গা) বা রিউমাটয়েড বাতের সঙ্গে আলাদা করার এক্স-রে বা রক্তপরীক্ষা করতে হতে পারে।
অস্টিওআর্থ্রাইটিসের চিকিৎসা
অস্টিওআর্থ্রাইটিস এক দীর্ঘস্থায়ী রোগ, তাকে সারানো যায় না। তার মানে কিন্তু এমনটা নয় যে অবস্থা দিনের পর দিন খারাপ হবেই। অনেক সময় উপসর্গ আস্তে আস্তে কমেও যায়। উপসর্গ কমানোর নানান চিকিৎসা রয়েছে।
অল্পস্বল্প উপসর্গ থাকলে, যেসবে উপকার পেতে পারেনঃ
- নিয়মিত ব্যায়াম
- ওজন বেশি থাকলে ওজন কমানো
- যথাযথ জুতো ব্যবহার
- দৈনন্দিন কাজের সময় জোড়ে চাপ কমানোর জন্য বিশেষ কিছু ব্যবস্থা নেওয়া।
উপসর্গ বেশি হলে এর সাথে বেদনানাশক ওষুধ এবং ফিজিওথেরাপিস্টের তত্ত্বাবধানে বিশেষ ব্যায়াম করতে হতে পারে।
খুব কম কিছু রোগীর এসব চিকিৎসায় ফল না হলে জোড়কে সারাতে, মজবুত করতে বা বদলাতে (প্রতিস্থাপন) করতে অপারেশন করতে হয়।
অস্টিওআর্থ্রাইটিস রোগীর বয়স বা ফিটনেস যাই হোক না কেন, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসার একটা হল ব্যায়াম। ব্যায়াম এমন হওয়া উচিত যাতে মাংসপেশিগুলো মজবুত হয় এবং সাধারণ ফিটনেসও ভালো হয়। অনেকে ভাবেন ব্যায়াম করলে কষ্ট বাড়বে, আসলে কিন্তু তা নয়। ব্যায়াম এছাড়াও ওজন কমাতে সাহায্য করে, শরীরের posture উন্নত করে, চাপ কমায়।
বেশি ওজন বা স্থূলতায় কিছু জোড়ে চাপ বেশি পড়ে। শারীরিক সক্রিয়তা ও সঠিক খাদ্যাভ্যাসে ওজন কমানো যায়। কিভাবে নিরাপদে ওজন কমানো যায়, তার জন্য ডাক্তার ও ডায়েটিশিয়ানের পরামর্শ নিন।
বেদনানাশক হিসেবে শুরুতে ব্যবহার করা উচিত প্যারাসিটামল। মনে রাখা উচিত প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে প্যারাসিটামলের সর্বোচ্চ দৈনিক মাত্রা ৪গ্রাম অর্থাৎ ৫০০ মিলিগ্রামের ৮টা বড়ি। এতে ব্যথা না কমলে আইবুপ্রোফেন বা ডাইক্লোফেনাক অথবা সেলেকক্সিব বা ইটোরিকক্সিব দেন ডাক্তার। কখনও কোডিন, ট্রামাডলের মতো আফিমজাত ওষুধও দেওয়া হয়, তবে এগুলোর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় ঝিমুনি, বমিভাব ও কোষ্ঠবদ্ধতা হতে পারে।
অনেক সময় অস্টিওআর্থ্রাইটিসে ব্যথার মলম (টপিকাল NSAID—অস্টেরয়েড প্রদাহরোধী ওষুধ) দেওয়া হয়, তবে এর কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। ব্যবহার করা হয় ক্যাপাসেসিন (capasaicin) মলমও। লংকার সক্রিয় এই উপাদান বেদনার অনুভূতিবাহী স্নায়ুগুলোকে ব্লক করে ব্যথা কমায়, তবে পুরোপুরি কাজ করতে এ মোটামুটি একমাস সময় নেয়।
কখনও কখনও অস্টিওআর্থ্রাইটিসে জোড়ে স্টেরয়েড ইঞ্জেকশন দেওয়া হয়। যদি তাতে লম্বা দিন ফল পাওয়া যায় তাহলে আবার দেওয়া যেতে পারে, তবে বছরে তিনবারের বেশি নয় আর দুটো ইঞ্জেকশনের মধ্যে যেন অন্তত তিনমাসের ফারাক থাকে।
অপারেশন বাদে অন্য সব চিকিৎসায় যাঁরা ফল পাননি, তাঁদের আক্রান্ত জোড়ে হায়ালুরোনিক এসিড (Hyaluronic acid) ইঞ্জেকশন দেওয়া হয় অনেক সময়—কয়েক সপ্তাহে পাঁচটা অবধি ইঞ্জেকশন দিতে হতে পারে। হায়ালুরোনিক এসিড এমনিতে জোড়ের ভেতরকার সায়ানোভিয়াল তরলে থাকে—পিচ্ছিলকারক ও শক-অ্যাবসর্বার হিসেবে কাজ করে। এই ইঞ্জেকশনে লাভ পাওয়া গেলে ছয় মাস ছাড়া আবার দেওয়া যেতে পারে।
জীবনযাত্রার পরিবর্তন ও ওষুধপত্র বাদে অন্যান্য কিছু চিকিৎসায় কখনও কখনও ব্যথা কমে ও দৈনন্দিন কাজকর্ম করায় সুবিধা হয়।
- TENS (Transcutaneous Electrical Nerve Stimulation)—বৈদ্যুতিক উত্তেজনা দিয়ে ব্যথার অনুভূতি-নিয়ন্ত্রণকারী সুষুম্নাকান্ডের স্নায়ুপ্রান্তগুলোকে অসাড় করে দেওয়া হয় এতে।
- গরম বা ঠান্ডা সেঁকে ফল পান কেউ কেউ।
- ফিজিওথেরাপিস্ট দ্বারা জোড়ের স্ট্রেচিং করিয়ে ফল পান কেউ কেউ।
- বিশেষ ধরনের জুতো যাতে শক-অ্যাবসর্বিং শুকতলা আছে, তাতে ভার বহন করতে সুবিধা হয়।
- লেগ ব্রেস আর সাপোর্টেও ভার বহনে কিছু সুবিধা হয় কারুর কারুর, কিন্তু বিশেষজ্ঞ পরামর্শ ছাড়া এসব ব্যবহার করা উচিত নয়।
- কোমর বা হাঁটুর অস্টিওআর্থ্রাইটিসে হাঁটাচলা করতে অসুবিধা হলে লাঠি বা ছড়ি ব্যবহার করা যেতে পারে। যেদিকটা আক্রান্ত তার বিপরীত দিকে লাঠি ব্যবহার করা উচিত, তাতে আক্রান্ত দিকে ভার কম পরে।
- জোড়ে খুব ব্যথা হলে যদি জোড়কে বিশ্রাম দিতে হয় তাহলে বন্ধ-ফলক (splint) ব্যবহার করা যায়।
অপারেশন
অস্টিওআর্থ্রাইটিসে অপারেশন লাগে কম ক্ষেত্রেই, অপারেশনেরও রকমফের আছে।
- আর্থ্রোপ্লাস্টি (arthroplasty)—এতে জোড়কে প্রতিস্থাপণ করা হয় প্লাস্টিক-ধাতু দিয়ে তৈরী কৃত্রিম জোড় দিয়ে।
- আর্থ্রোডেসিস (arthrodesis)—জোড়টাকে স্থায়ীভাবে জুড়ে দিয়ে নড়াচড়া বন্ধ করে দেওয়া হয় এই অপারেশনে।
- অস্টিওটমি (osteotomy)—জোড়ের নীচে বা ওপরে ছোট এক টুকরো হাড় কেটে বাদ দেওয়া বা জোড়া হয় এই অপারেশনে, যাতে জোড়ের ক্ষতিগ্রস্ত অংশের ওপর চাপ না পড়ে।
অস্টিওআর্থ্রাইটিসের কিছু রোগী আকুপাংচার করান। এই চিকিৎসা কার্যকর হিসেবে প্রমাণিত নয়।
গ্লুকোসামিন সালফেট ও কন্ড্রিটিন –এর মতো কিছু পুষ্টি-পরিপূরক (nutritional supplement) কোনও কোনও ডাক্তার অস্টিওআর্থ্রাইটিসে ব্যবহার করেন, কিন্তু তাতে কতোটা কাজ হয় সন্দেহ আছে, আর এগুলোর দামও খুব বেশি।
রুবিফাসিয়েন্ট (rubefacient) মলম বা জেল হিসেবে পাওয়া যায়, চামড়ায় ঘষলে লাল হয়ে যায়, গরম ভাব লাগে। অস্টিওআর্থ্রাইটিসে ব্যবহার করেন কেউ কেউ। কিন্তু এর প্রভাবও প্রমাণিত নয়। .
অস্টিওআর্থ্রাইটিস নিয়ে বাঁচা
মনে রাখবেন ঠিকঠাক চিকিৎসা পেলে অস্টিওআর্থ্রাইটিস নিয়ে সুস্থ, কর্মক্ষম জীবনযাপন করা যায়। অস্টিওআর্থ্রাইটিস রোগের তীব্রতা বেড়েই চলবে এবং তা থেকে বিকলাঙ্গতা হবেই এমনটা নয়। সঠিক খাবার-দাবার, নিয়মিত ব্যায়ামে মাংসপেশিগুলো শক্তিশালী থাকে, ওজন নিয়ন্ত্রণে থাকে—যা অস্টিওআর্থ্রাইটিসের জন্য ভালো, যার অন্য উপকারিতাও আছে।
অস্টিওআর্থ্রাইটিস প্রতিরোধ
অস্টিওআর্থ্রাইটিসকে হতে না দেওয়া পুরোপুরি সম্ভব নয়। কিন্তু যথাসম্ভব চোট-আঘাত বাঁচিয়ে চললে, যথাসম্ভব সুস্থ থাকলে অস্টিওআর্থ্রাইটিসের ঝুঁকি কম থাকে। দৌড়নো, ওজন তোলার মতো যেসব ব্যায়ামে জোড়ে চাপ পড়ে সেগুলোর বদলে সাইকেল চালানো, সাঁতার কাটার মতো ব্যায়াম করা ভালো যেগুলোতে জোড়ে চাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে। সপ্তাহে আড়াই ঘন্টা করে মাঝারি তীব্রতার অ্যারোবিক ব্যায়াম করা সুস্থ রাখবে আপনাকে।
শরীরের সঠিক অবস্থিতি (posture)—কিভাবে বসবেন, দাঁড়াবেন, কাজ করবেন, তাও অস্টিওআর্থ্রাইটিসের ঝুঁকি কমায়।
স্বাস্থ্যের বৃত্তে পত্রিকায় পূর্বে প্রকাশিত।
খুব শিক্ষামূলক ও সচেতনতামূলক লেখা। ভালো থাকবেন।