প্রায়ই আমার চশমা হারায়। নির্ধারিত এক জায়গায় রাখি না, কোথায় রাখলাম ভুলে যাই। দুর্দশার অন্ত থাকে না। গিন্নি প্রভূত গালাগালি সহ খুঁজে দেন।
আসলে বাড়িতে থাকলে, বিশেষ করে কিছু পড়া বা লেখার সময় চশমা ছাড়াই ভালো দেখি। মায়োপিয়ার মাইনাস আর কাছে দেখার প্লাস পাওয়ার মিলে শূন্য হয় বলেই এমনটি হয়, মানে এই চশমা ছাড়া কাছের জিনিস ভালো দেখতে পাওয়া। তাই চশমা খুলে রাখা আর হারানো নিত্যনৈমিত্তিক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আমি ছোটোবেলা থেকেই খেলাধুলোয় অপারদর্শী ছিলাম। এমন নয় যে, সব ছোট ছেলেমেয়েরা যেমন খেলার মাঠে যেত আমাদের ছেলেবেলায়, আমি সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত ছিলাম আজকের বাচ্চাদের মত। আদৌ ড্রয়িং-স্কুল, আবৃত্তির ক্লাস, বাধ্যতা মূলক সাঁতার বা পড়াশুনোর কোচিং কণ্টকিত ছিল না আমার ছেলেবেলা। বিকেল বেলা কিম্বা ছুটির দিন হলে দু’বেলা মাঠে যেতাম নিয়ম করে। ফুটবল মাঠে ছুটোছুটিও করতাম খুব। কেন না আমি চোখে খুব কম দেখতাম বলে আমার একমাত্র কাজ ছিল খেলার মাঠে নিজেকে বাঁচানো। যেখানে বল কাড়াকাড়ির গোলোযোগ, চোখে ভালো দেখতাম না বলে ভীতু আমি ডায়াগনালি অপোজিট ফাঁকা জায়গায় নিজেকে সরাতে ব্যস্ত থাকতাম। হাতের মুঠোর সাইজের তীব্র বেগে ধেয়ে আসা বল কিম্বা সরু তিনটে কাঠের সরলরেখা প্রায় অদৃশ্য থাকত আমার চোখে। তাই ক্রিকেট খেলার প্রশ্নই ওঠেনি।
একমাত্র সন্তান হওয়া সত্ত্বেও আমার এই করুণ অবস্থা জীবনসংগ্রামে ব্যস্ত জনকজননী অনুধাবন করতে পারেননি। ইতিমধ্যে আমি ক্লাস এইটে উঠে গেছি। জাজিগ্রামের জুনিয়ার হাইস্কুল ছেড়ে হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলে গেছি।
নয়নসুখ বলে এক গ্রামের যে স্কুলে পড়ছি গঙ্গার ভাঙনের কবলে পড়েছে সে’টি। সমস্ত স্কুলটা বাধ্য হয়ে উঠে গেছে অস্থায়ী চাঁচের বেড়া দিয়ে তৈরি এক ছাউনিতে। আগুন জনিত নিরাপত্তার খাতিরে সেখানে বিজ্ঞান বিভাগ চালু করা যায়নি।
আমাদের সে সময় পুরোনো হায়ার সেকেন্ডারি। কে কোন শাখায় পড়বে ক্লাস নাইনেই বেছে নিতে হত। বাবার প্রবল ইচ্ছে আর্টস নিয়ে পড়ি। তারপর সংস্কৃত। মা, টাটা কোম্পানির হাসপাতালের কম্পাউন্ডারের কন্যা। তাঁর প্রবল বাসনা ছেলে ডাক্তার হোক। ক্লাস এইট পাশ করার পর অতএব প্রবল টানাপোড়েন। যথারীতি সব ব্যাপারেই যেমন, আমার চিরপরাজিত বাবা আবারও হেরে গেলেন। আমাকে চালান করা হল বারাসতে, মামাবাড়িতে। গান্ধীস্কুলে বিজ্ঞান নিয়ে ক্লাস নাইন। নতুন স্কুল। রোল নম্বর বত্রিশ। ঠাঁই পেলাম লাস্ট বেঞ্চে।
সেখান থেকে বোর্ডের লেখা, স্যারের মুখ, সবই ঝাপসা। ঊনিশশ’ ছেষট্টি। খাদ্য আন্দোলন। মাইলোর রেশন তুলতে ভোর সাড়ে চারটেতে সমবয়সী মামার সাথে লাইন দিই। দূরে দাঁড়িয়ে বাস পোড়ানোর ধোঁয়া দেখতে যাই। হুমড়ি খেয়ে কাড়াকাড়ি করে বসুমতী পড়ি। সবটাই করি মসৃণ আগ্রহে।
প্রায় অভিভাবকহীন মামাবাড়িতে হয় না শুধু লেখাপড়া। স্কুলে বোর্ডের লেখা দেখতে পাই না। ক্লাস চলাকালীন যাবতীয় বদমায়েশি প্র্যাকটিস করি। অঙ্কের তারকস্যার দেখেও দেখেন না।
ফল ফললো হাতে নাতে। হাফ ইয়ার্লিতে অঙ্কে বাইশ। অ্যানুয়ালে খুব খাটাখাটনি করে পঁচিশ। স্কুলের ভেতরে মাঠে জমায়েতের সামনে হেডস্যার রেজাল্ট পড়লেন। নাম নেই।মুখ চুন। মামা, কানে কানে ফিসফিসিয়ে বলে গেল, ঘাবড়াস না। সেকেন্ড লিস্টে নাম আছে। অফিস থেকে জেনে এসেছি।
ঠিকই তাই। প্রোমোটেড উইথ ওয়ার্নিং।
তদ্দিনে বাবা ট্রান্সফার হয়ে এসেছেন জঙ্গীপুরের উল্টোদিকে রঘুনাথগঞ্জে। সেখানের স্কুলে সাইন্স রয়েছে। কিন্তু হেডমাস্টারমশাই বাবার পরিচিত হওয়া সত্ত্বেও ক্লাস টেনএ ভর্তি নিতে গররাজি। এত উঁচু ক্লাসে এক সাবজেক্ট ফেল ছাত্র… ঝুঁকি হয়ে যাবে। বাবা হাতে পায়ে ধরে বললেন, এক সপ্তাহ সময় দিন স্যার। তার পর অঙ্ক পরীক্ষা নিন। না পারলে নেবেন না।
এক সপ্তাহ ঘরের দরজা জানালা বন্ধ করে ঘষামাজা চলল। নতুন স্কুলে ভর্তি হলাম। এ’ খানেই প্রথম ধরা পড়ল গলদ। ইংরিজি ক্লাসে বোর্ডের লেখা না দেখে পাশের ছেলের খাতা থেকে টুকতে দেখে বাঘের মত ঝাঁপিয়ে পড়লেন মৃগাঙ্কবাবু।
বোর্ড থেকে না দেখে ওর খাতা দেখে লিখছিস কেন?
অম্লানবদনে স্বীকার করলাম, আমি বোর্ডের লেখা কিছুই দেখতে পাই না। আমার বাকি ধারণার কথাও সবিস্তারে বললাম। ফার্স্টবেঞ্চে যারা বসে তারা স্যারের মুখ আর বোর্ডের লেখা সব দেখতে পায় বলেই ফার্স্ট সেকেন্ড হয়। আর পেছনের বেঞ্চে বসে সেই সুবিধে পাওয়া যায় না বলেই আমরা ফেলু।
মৃগাঙ্কস্যার এ হেন ব্যাখ্যায় হতবাক।
পরের দিন অবধারিত গার্জেন কল। আমার বেচারা বাবাকে, হেডমাস্টার মশাইয়ের ঘরে বসিয়ে যাচ্ছেতাই বকাবকি করলেন মৃগাঙ্কবাবু। মফসসলের স্কুলে মাস্টারমশাইএর সেই সুতীব্র ভালোবাসা মনে পড়লে আজও চোখে জল চলে আসে।
পরের দিনই গঙ্গা পেরিয়ে জঙ্গীপুরে ডাক্তার দেখান হল। ডাঃ সালাউদ্দিন সম্ভবত নাম ছিল তাঁর। খুব যত্ন করে দেখলেন। এক সপ্তাহ পর চশমা নেবার ডেট। বাবার সাথে গিয়ে সেই চশমা পড়ে বাইরে রাস্তায় এসে আমি অবাক। পৃথিবী এত সুন্দর দেখতে? রাস্তায় এত দূর থেকেও পথিকের জামার ভাঁজ এত স্পষ্ট দেখা যায়।
সে বছরই ফেলুবাবু অঙ্কে একশ’য় একশ। হায়ার সেকেন্ডারিতে স্কুলের প্রথম ফার্স্ট ডিভিসন আমরা। সেই থেকে আমার ভূষণ এই চশমা । কতবার ভাঙল। আগে কাচের ছিল। এখন প্লাস্টিক লেন্স। বাই ফোকাল। কাজের সুবিধের জন্য এখন প্রোগ্রেসিভ।
প্রকৃতিকে ধন্যবাদ। আমার চোখে মায়োপিয়া দেওয়া হয়েছে। এ’সংসারে যারা দূরের তাদের ঝাপসা দেখি। প্রায় দেখতেই পাই না। ইচ্ছে করে দেখেও না দেখার ছল করতে হয় না।
আর যারা কাছের, হৃদয়ের পাশটিতে? তাদের দেখতে আমার চশমাই লাগে না।
★
এটি নেহাতই পুরোনো লেখা।
রিসেন্ট আপডেট হল, আমার ছানি অপারেশন হয়ে গেছে। দু চোখেই।
যার ফলে মায়োপিয়া সেরে গেছে। দূরের জিনিস দেখতে পাচ্ছি স্পষ্ট, চশমা ছাড়াই।
কিন্তু কাছের মুখগুলো ঝাপসা হয়ে গেছে। চিনতে পারছি না তাদের।
সত্যি, এক জীবনে কতই হল!