অন্তর্বর্তীকালীন রিপোর্ট একটা দাখিল করা দরকার। কেমন চলছে আমার অভিযান।
যদিও যুদ্ধের প্রথমে আমার মনে হয়েছিল বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচ্যগ্র মেদিনী, কিন্তু ফিল্ডে নেমে দেখা গেল সেই সূচ্যগ্র মেদিনীও আর অবশিষ্ট নেই।
অথবা অন্য ভাবে বলা যায়। বেলাশেষে কর্ণ অনুভব করল তার রথের চাকা মাটিতে বসে গেছে। অধুনা গ্রন্থিবিপর্যয়ে সে প্রায় চলচ্ছক্তিহীন। তার প্রতিবর্তীক্রিয়াসমূহ(রিফ্লেক্স) অন্তর্হিত… দিগন্তে বিলীন। আর সমস্ত একদা অধিগত চেনা অস্ত্রের (পড়ুন পেন হোল্ড গ্রিপের স্পিন ইত্যাদির) প্রয়োগকৌশল মহাকাব্যিক নির্দেশে যেমনটি কথা ছিল তাকে ছেড়ে চিরবিস্মরণের অন্ধকারে চলে গেছে। সাপের ছোবলের মত বিষাক্ত স্পিনভরা সার্ভিস, বজ্রপাতসদৃশ স্ম্যাশ কিছুই তার আর মনে পড়ে না। সন্দেহ হয় কোনোদিনই ছিল কি? এক এক সময় মনে হয় তারা সব হারানো প্রিয়ার মুখ। আধুনিক পরিভাষায় বিশ্বাসঘাতক ক্রাশ। যাদের অনুসরণ করতে গেলে পিং পং বলটি টেবল খুঁজে পায় না। আর দুবারের বেশি তিনবার দ্রুত পদচারণা করলেই হৃদয়ে গ্যালপ রিদম।
এইবার আমার এখনকার মেন্টর বড় পুত্র জয় স্টিয়ারিং হাতে নেয়। মানে নেবার চেষ্টা করে। আমার কোচের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় সে।
আমার আপত্তিকে কুযুক্তির প্রয়োগে প্রতিহত করে।
আমি তাকে বলি, — কোচ কী? তুই নিজে কোনওদিন ট্রেইনিং নিয়েছিস যে আমাকে কোচ করবি?
এই বলার মধ্যে গভীর বেদনা মিশে থাকে। সত্যিই সেই আদিম যুগে মহামূর্খ আমি ওকে শুধুই জয়েন্টমন্ত্র জপ করা শিখিয়েছিলাম। কোনও খেলারই যাকে বলে ফর্মাল শিক্ষা, ফুটবল… ক্রিকেট… বা টেবল টেনিস কিছুই আমি ওকে ব্যবস্থা করে দিইনি। টিপিক্যাল ছা পোষা মধ্যবিত্ত বাঙালি তো।
জয় প্রতিবাদ করে না। মেনে নিয়েও আমাকে কথার প্যাঁচে ফেলে।— বাবা, বঙ্কিমচন্দ্র কবারে বিএ পাশ করেছিলেন তুমি জানো?
— হ্যাঁ, জানি বই কি! ফেল করেছিলেন, গ্রেস দিয়ে পাশ করানো হয়।
— কোন বিষয়ে জানো?
— তাও জানি। বাংলায়।
— পরীক্ষক?
মাথা চুলকোই। ঠিক জানি না ব্যাপারটা।
— জানো না তো! বিদ্যাসাগর। যিনি কিনা এন্ট্রান্স পাশও ছিলেন না। এন্ট্রান্স পরীক্ষাই ছিল না তো তাঁর সময়ে। তাহলেই দ্যাখো, কোচিং করতে… পরীক্ষা নিতে বিনাডিগ্রির মানুষও পারে।
তত কনভিন্সড হচ্ছি না দেখে এইবার পাশুপত অস্ত্র নিক্ষেপ করে সে।— আচ্ছা, তোমার লাইনেই ভেবে দ্যাখো। পৃথিবীর প্রথম এমবিবিএস মানে তোমাদের ভাষায় কোয়ালিফায়েড ডাক্তারকে পড়িয়েছিল, পরীক্ষা নিয়েছিল আর পাশ করিয়েছিল একজন কোয়াক, ডিগ্রিহীন ডাক্তার। ঠিক কি না?
মাথা নিচু করে মেনে নিই।
নির্জন এক কক্ষে আমার মুখোমুখি এক নিষ্ঠুর কোচ বল ছোঁড়ে আমার দিকে।
দূরাগত গীতার শ্লোকের মত নির্দেশ ভেসে আসে,
— স্ম্যাশ
— সার্ভ
— লুপ
— কাউন্টারড্রাইভ
— ব্লক
— পুশ
— চপ
— ব্লক…
হায়, আমার স্বর্ণযুগেও এত সব কৃৎকৌশল জানতাম না।
লক্ষহীন অসহায় পিং পং বল টেবিলে পড়ে না। ছুটে যায় দেওয়ালের দিকে… ছাদের দিকে
হতাশা প্রতিধ্বনি তোলে ঠক… ঠক… ঠক!