জয়নগরের দীপালি নস্করের নাম সকলেই ভুলে গেছেন আশাকরি। ভুলে যাওয়ারই কথা। মহিলা জীবনে বিশেষ কিছুই করে উঠতে পারেন নি। রবিনসন স্ট্রিট নামের কলকাতার এক অভিজাত পাড়ায় এক বাড়িতে গৃহ পরিচারিকার কাজ করতেন যাকে আমরা “কাজের মাসি” বলতে অভ্যস্ত। ঝি বা চাকর কথাটা বলতে আমাদের শিক্ষিত মধ্যবিত্তদের তথাকথিত পরিশীলিত রুচিতে আটকায়।
দীপালির কথা মতো সেই বাড়িতে দেড়মাস বেতন না পাওয়ায় কাজ ছেড়ে দেন। সেই বাড়ির গৃহকর্ত্রী হঠাৎ একদিন কোনো কারণে গয়নাগুলি বার করতে যান। তখনই তিনি দেখতে পান গয়নার বাক্সগুলি ভাঙা অবস্থায় রয়েছে। চুরির কথা জানতে পেরে সঙ্গে সঙ্গে শেক্সপিয়র সরণি থানায় অভিযোগ দায়ের করেন তার মেয়ে। সেই অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত শুরু করে পুলিশ। তদন্তের ধারায় বহুবার থানায় ডেকে জেরার পরে কিছু না পেয়ে দীপালির নারকো টেস্ট এর আয়োজন শুরু হয়। ঘটনাচক্রে থানায় অভিযোগকারী সেই মেয়ের নাম ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত, যিনি সম্প্রতি আবার খবরের শিরোনামে এসেছেন। তিনি প্রভাব খাটিয়েছেন অথবা পুলিশ নিজে থেকেই তার মতো নামি সামাজিক ব্যক্তিত্বকে খুশি করতে এই নারকো টেস্ট এর তোড়জোড় শুরু করেছিল তা বলা মুশকিল।
এ জিনিষ নতুন কিছু নয়। বাড়িতে কিছু খোয়া গেলেই আমাদের সন্দেহ এর তির অটোমেটিক্যালি চলে যায় ওই গৃহপরিচারিকার দিকে। আমরা, তার মধ্যবিত্ত নিয়োগকর্তারা অক্লেশে বলে ফেলি, ” ও ই সরিয়েছে। থানায় নিয়ে গিয়ে একটু কড়কে দিলেই সুড়সুড় করে সব বের করে দেবে”। ওই কড়কানোর নতুন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিটাই তো নারকো টেস্ট। চাপ দিয়ে দোষ স্বীকার করানো।
মৌখিক চুক্তি লঙ্ঘন করে বাড়তি কাজ করিয়ে টাকা না দেওয়া থেকে শুরু করে, বোনাস না দেওয়া, ইচ্ছেমত মাইনে কেটে নেওয়া এই সব চাপ আমরা মধ্যবিত্তরা দিয়েই থাকি।
এদেশে গৃহপরিচারিকাদের অল্প বেতনে কাজ করানো, বেতন না দেওয়া, শারীরিক নির্যাতন, অতিরিক্ত কাজের বোঝা ও অমানুষিক আচরণ করার অভিযোগ নতুন নয়৷ সাপ্তাহিক ছুটি, কাজের ফাঁকে বিশ্রাম অথবা বেতন নিয়ে দর কষাকষির তাঁদের কোনো সুযোগই নেই৷
অন্যান্য পেশার মতো মাতৃত্বকালীন সুবিধা আইন, ন্যূনতম বেতন আইনের আওতায় আসেন না ভারতের অসংখ্য গৃহপরিচারিকা৷ দেশে বেশ কয়েকটি শ্রম আইন থাকলেও কেনোওটিতেই গৃহপরিচারিকার সুরক্ষার কথা বলা নেই৷ এদেশে নিয়োগকারীর ইচ্ছায় গৃহকর্মী নিযুক্ত হন৷ পছন্দ না হলে নিয়োগ কর্তার ইচ্ছাতেই ছাঁটাই হন৷ কোনো সরকারি নিয়ম বা আইনের বালাইটুকুও নেই৷ আমাদের মধ্যবিত্তদের চাপেই নেই। কি যে আনন্দ হয় ভাবলে।
আমরা আমাদের অফিসে মেটার্নিটি লিভের সময় সীমা বাড়ানোর দাবি আদায়ের পাশে পেটার্নিটি লিভের কথা ভাববো। ডিএ আদায়ের দাবিতে জঙ্গি আন্দোলনে রাস্তায় নামবো। কিন্তু বাড়িতে ফিরে এসে এক মুহূর্তে নিজের প্রতিবাদী স্বত্তাটা ভুলে যাব। কারণ তখন তো আমি নিজেই মালিক। শ্রমিক তো অন্য কেউ, যার শ্রম আমি ন্যায্যমূল্য এর চেয়ে অনেক কম দামে কিনে নিচ্ছি প্রতিদিন।
পাল্টা চাপ বাড়ানোর চেষ্টা কিন্তু শুরু হয়ে গেছে। সাবধানে থাকবেন। ২০১০ সালে ইন্টারন্যাশানাল লেবার অর্গানাইজেশন কর্তৃক আয়োজিত পরিচারিকাদের অবস্থা বিষয়ক বিশেষ সম্মেলন-পরবর্তী সময়ে বিচ্ছিন্নভাবে ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে পরিচারিকাদের ‘শ্রমিক’ হিসাবে মর্যাদা এবং শ্রমিকের অধিকার আদায়ের উদ্যোগ গৃহীত হলেও সম্মেলনের স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্র হিসাবে ভারতবর্ষে কেন্দ্রীয় স্তরে সেরকম কোনো উদ্যোগ দেখা যায় নি।
গৃহ-শ্রমিকসহ বিভিন্ন অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের জন্য ২০০৮ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার সামাজিক নিরাপত্তা আইন কিম্বা ২০১৭ সালে সামাজিক সুরক্ষা যোজনা চালু করলেও তা নিয়ে যে ব্যাপকহারে প্রচার এবং গৃহ-পরিচারিকাদের মধ্যে তাদের অধিকার সংক্রান্ত সচেতনতা বৃদ্ধির দরকার ছিল সরকারের তরফ থেকে তা ঘটেনি। ২০১৭ সালের সামাজিক সুরক্ষা যোজনায় যদিও গৃহ-শ্রমিকদের জন্য স্বাস্থ্যবিমা, চিকিৎসা এবং সন্তানদের পড়াশুনো সংক্রান্ত খরচ এবং পেনশনের উল্লেখ রয়েছে গৃহ-পরিচারিকা হিসাবে নাম নিবন্ধীকরনের মাধ্যমে, যদিও তাতে নূন্যতম মজুরি সহ অন্যান্য দাবি আদায়ের কোনো ব্যবস্থা নেই।
মধ্যবিত্ত ভোটব্যাংক হারানোর ভয়ের কারণে বা মৌলিক শ্রেণীগত চরিত্রের কারণেই কোনো রাজনৈতিক দলই এই গৃহপরিচারিকদের মর্যাদা আদায়ের লড়াইতে সেইভাবে আগ্রহ দেখায় নি বহুদিন যাবত। কিন্তু ওরা জোট বাঁধতে শুরু করেছে। সংগঠন বানাচ্ছে।
এদের এই সব সংগঠন-মঠন ইত্যাদি দেখে বুঝলেন মশাই আমি মানে আমার মতো আগুনখেকো বিপ্লবীও আজকাল একটু চাপে আছি। ছোটলোকগুলো কি শুরু করেছে বলুন তো। বলে কি না মাতৃত্ত্বকালীন ছুটি। ওর প্রেগনেন্সি আর আমার বউ এর প্রেগনেন্সি এক হ’ল ? পাগল না সিপিএম ?
ও হ্যাঁ। বলতেই ভুলে গিয়ে ছিলাম। ৩১শে মার্চ বিপ্লবী নারীবাদী আন্দোলনের নেত্রী কোলনতাই এর জন্মদিন। যিনি বলেছিলেন, “Women’s world is divided, just as is the world of men, into two camps; the interests and aspirations of one group bring it close to the bourgeois class, while the other camp has close connections with the proletariat, and its claims for liberation encompass a full solution to the woman question.”
চিন্তার কোনোও কারণ নেই। দীপালি নস্কররা ফেসবুক পড়ে না। মার্ক্স, জেটকিন, কোলনতাই – এ সব তাদের কাছে বোগাস। ছোটলোকের বাচ্চাগুলো ছোটলোকই থাক চিরকাল। তাতেই আমাদের লাভ। বেশি ঝামেলা করলেই দেব শালা নারকো টেস্ট লেলিয়ে। অপমানে মাথা নিচু করে চোরের মতো চলে যাবে। যেমন চলে গিয়েছিল জয়নগরের দীপালি নস্কর।
কিন্তু ধরুন যদি মাথা নিচু করে না চলে যায়, যদি রুখে দাঁড়ায় ? আমাদের রাজ্যে কিন্তু এরই মধ্যে গঠিত হয়ে গেছে পশ্চিমবঙ্গ গৃহ পরিচারিকা সমিতির ট্রেড ইউনিয়ন যারা ইউনিয়ন হিসাবে সরকারি স্বীকৃতিও আদায় করে নিয়েছে।
তাই বলবো, স্বপ্ন দেখতে দোষ কি। হতেও তো পারে দেশ জুড়ে বিপ্লবের পরে গঠিত হল প্রথম পিপলস কমিসারেট ঠিক যেমনটা হয়ে ছিল সোভিয়েত রাশিয়ায় বলশেভিকদের নেতৃত্বে যার নারী শিশু সমাজ কল্যাণ দপ্তরের প্রথম কমিসারের নাম আলেকজান্দ্রা মিখাইলভনা কোলনতাই। নামটা মনে রাখবেন প্লিজ। স্রেফ দিপালী নস্কর, কমিশার, নারী শিশু সমাজ কল্যাণ দপ্তর।