রাত তিনটে অব্দি জেগে ‘কালবেলা’ উপন্যাসটা শেষ করেছি। শেষের দিকে ঘুমে চোখ জ্বালা জ্বালা করছিলো কিন্তু ছাড়তেও পারছিলাম না। কীভাবে এত তীব্র, তীক্ষ্ণ, তীরের ফলার মতো লেখা যায়! লেখার অভিঘাতে বারবার ছিটকে পড়ছিলাম। উপন্যাসের অধিকাংশ ঘটনাপ্রবাহ কলেজ স্ট্রিটের ওপর। আমারও খোলস ছেড়ে বেরিয়ে ওঠা সেখানেই। তাই লেখাগুলো ছবির মতো ভেসে উঠছিল। সুদূর মফস্বল থেকে উঠে আসা, বাস্তব সম্পর্কে অনভিজ্ঞ অনিমেষের প্রতিদিনের জীবন, তার ভেসে যাওয়ার কাহিনী, তার দিনবদলের স্বপ্ন… সবটাই নিজের মতো করে ছুঁয়ে দেখেছি। যৌবনের আবেগ আর বুকভরা আগুন নিয়ে স্থবির হয়ে যাওয়া একটা দেশকে তারা ধাক্কা দিয়ে জাগাতে চেয়েছিল কিন্তু আগুনের নিয়ন্ত্রিত ব্যবহার তারা শেখেনি। বেনোজল ঢুকেছে। শেষমেষ দিকভ্রষ্ট আগুনে তারা নিজেরাই পুড়েছে। জেলের অকথ্য অত্যাচারের কাহিনী পড়তে পড়তে শিউরে উঠেছি। সমস্ত আগুন দিনের দিগন্তরেখায়, বিপুল ছায়া নিয়ে আমাদের সমস্ত মনন জুড়ে এসে দাঁড়িয়েছে আর একটি চরিত্র- মাধবীলতা! কোনও বিপ্লবের সংজ্ঞায় মাধবীলতাকে বাঁধা যায় না। অন্ধকার শেষে ভোরের আলোর অপেক্ষাটুকুর মতো মাধবীলতারা জেগে থাকে। রোদে পুড়ে যাওয়া রাজপথ হোক, বৃষ্টিতে ভেসে যাওয়া উঠোন কিংবা হাড় কাঁপানো শীতের ছোবল… একইভাবে হাতে হাত রাখতে পারা বিপ্লবের চেয়ে কম কী? বিপ্লবের আর এক নাম মাধবীলতা।
সকালে ঘুম থেকে ওঠার পরেও দু-চোখে ‘কালবেলা’র রেশ লেগে আছে। ডিউটিতে যেতে হবে। টেবিলে রাখা বইটার গায়ে একবার হাত বুলিয়ে তাড়াতাড়ি সকালের কাজগুলো সেরে নিলাম। সবে মার্চের শেষ। এর মধ্যেই রোদটা বেশ চড়া হতে শুরু করেছে। কোনওরকমে একটা টি-শার্ট গলিয়ে, পকেটে একটা পেন নিয়ে দৌড়াতে শুরু করলাম।
আইসিইউ-র মধ্যে খারাপ রোগীর চাপ এখন তুলনামূলকভাবে কম। একটু রয়ে বসে কাজ করা যায়। বেশিরভাগ বাচ্চাই সুস্থ হয়ে জেনারেল ওয়ার্ডে ফিরে যাচ্ছে৷ যদিও সবটাই নিরবচ্ছিন্নভাবে ভালোর দিকে নয়। দোলের দিন সুমনা প্রথমবার ‘মা’ বলে ডাকতে শিখেছিল। কথা বললে চোখ মেলে তাকাতো। অল্প অল্প করে হাত-পা তুলতে শিখছিল। আমরাও আশায় দিন গুনছিলাম। এনকেফেলাইটিসের রোগীর কিছু কিছু দীর্ঘস্থায়ী অসুবিধে থেকেই যায় কিন্তু যদি দৈনন্দিন সাধারন কাজগুলো করে নিতে পারে সেটাও অনেক। তার মধ্যেই পাঁচ-ছ’দিন ভালো থাকার পর আবার বেশ কয়েকবার খিঁচুনি হয়ে গেল। রক্তচাপ কমে গেছে অনেকটা। যেটুকু সাড়া দিচ্ছিলো এখন সেটাও নেই। সুমনার মা এসে মুখটা মুছিয়ে দিচ্ছিলো। অস্পষ্ট গোঙানি ছাড়া ন’বছরের মেয়েটার মুখে আপাতত কোনও ভাষা নেই।
ওদিকে এক হাতে চ্যানেল নিয়ে আয়েশা সুলতানা সারা ওয়ার্ড ঘুরে বেড়াচ্ছে। ভর্তি হওয়ার সময় রক্তচাপ সাংঘাতিকভাবে বেড়ে ছিল। চোখ মুখ ফোলা। পেচ্ছাব দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছিল। ধীরে ধীরে আয়েশা আগের থেকে অনেকখানি সুস্থ হয়েছে। অন্য বেডগুলোর পাশে গিয়ে বাচ্চাদের আদর করছে। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলছে, “কেন কাঁদছো? কাঁদতে নেই। তুমি ঠিক হয়ে যাবে। এইতো আমি আদর করে দিচ্ছি দেখো… না… একদম কাঁদে না…”
ভাঙাচোরা কান্নার দিনেও মাধবীলতারা থাকে। মারীর দেশে ফুল ফোটে। লাল গোলাপ। সে শুধু মাধবীলতা হাসবে বলে।
ছবিঃ গুগল