করোনার প্রকোপে পুরোপুরি একঘেয়েমিভাবে বাড়িতেই দিন কাটছে| তবে লকডাউনের ভালো দিক বলতে আমার কাছে, দীর্ঘ দশ বছর পর পরিবারের সাথে এত বেশি সময় একসাথে দিন কাটানো (যেহেতু অষ্টম শ্রেণি থেকেই হস্টেল জীবন শুরু, এখনও চলছে)| এখন কাজ বলতে শুধু খাওয়া-দাওয়া আর ঘুম, পড়াশোনার সাথে সম্পর্ক প্রায় বিচ্ছেদের দিকে বললেই চলে|
প্রতিদিনের মতো সেদিনও দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর মোবাইল দেখতে দেখতে শুয়ে পড়েছি| চোখের পাতা গুলো ঘুমে বন্ধ হয়ে এসেছিলো, ঠিক সেই সময়েই দরজায় – “ঠক ঠক” করে বার তিনেক শব্দ| দরজা খুলতেই দেখি গ্রামের এক পরিচিত মহিলা, ‘ রহিমের মা’ জিজ্ঞেস করলাম কিছু বলবেন নিশ্চয়|
রহিমের মা প্রত্যুত্তরে – “ঘুমাছিলা তুমি”?
গম্ভীর স্বরে বললাম- “হ্যাঁ” (ঘুমন্ত মানুষ কে ঘুম থেকে জাগিয়ে যদি প্রশ্ন করা হয় ঘুমাচছ, তাহলে কার না রাগ হবে)| “যাইহোক এবার বলুন তাহলে কেনো এসেছেন?”
রহিমের মা – “শুনাছি তুমি ডাক্তার হয়াছ”|
আমি প্রত্যুত্তরে- “ঠিকই শুনেছেন তবে ডাক্তার এখনও হয়নি, ডাক্তারি পড়ছি (ছাত্র)”|
তারপর রহিমের মা সব দাঁত বের করে হাসতে হাসতে – “জানো বাবু, হামার নাতি হয়াছে”|
মনে মনে ভাবলাম ঘুম ভাঙিয়ে এটা জানানোর কি খুব দরকার ছিল, বিরক্ত হলাম বটে কিন্তু প্রকাশ না করে বললাম- “মিষ্টি নিয়ে এসেছ?”
রহিমের মা আবার সব দাঁত বের করে হাসতে হাসতে – “না বাবু আনিনি”|
“তাহলে কি জন্য এসেছেন?”
রহিমের মা – “জানো বাবু, কেস জনডিস “|
আমি হাঁ করে তাকিয়ে বললাম “মানে?” সাধারণত গুরুতর কিছু খারাপ খবর বোঝাতে আমরা বলি “এই রে কেস জনডিস” তাই ভাবলাম কিছু বিপদ হয়েছে| তারপর জিজ্ঞেস করলাম- “কি হয়েছে স্পষ্ট বলুন”|
রহিমের মা – “জানো বাবু, হামার নাতিটার ক্যাল থেকে একটু জ্বর জ্বর মনে হচ্ছে, মুখ আর গা একটু হলদা লাকছে”|
কিছুক্ষণ মনে মনে ভাবলাম আপনি ঠিকই বলেছেন “কেস জনডিস” অর্থাৎ শিশুটির জনডিস হয়েছে | রহিমের মাকে কিছু প্রশ্ন করলাম – শিশুর বয়স, কবে থেকে মুখ আর গা হলুদ লাগছে, ডাক্তার যে ডেট দিয়েছিলো সেই নির্ধারিত ডেটেই কি জন্ম হয়েছে অর্থাৎ টার্ম না প্রি- টার্ম সেটা বোঝার চেষ্টা করলাম, ইত্যাদি ইত্যাদি | অবশেষে বুঝলাম এটা ফিজিওলজিক্যাল জনডিস হবে মন তাই বলছে | রহিমের মাকে যথাসাধ্য বোঝালাম ভয়ের কিছু নেই, এটা স্বাভাবিক ভাবেই হতে পারে, ঠিকও হয়ে যাবে, তবে আপনি একজন শিশুদের ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান, আমাদের লালগোলার একজন ডাক্তারের কাছে পাঠালাম|
রহিমের মা লকডাউনে ডাক্তারের কাছে যেতে ইতস্তত করছিলেন করোনার ভয়ে আর টাকার অসুবিধে এই সময়ে (ওই টাকা টা থাকলে সবাই দু মুঠো খেতে পারবে লকডাউনে)| কিন্তু আমি বুঝিয়ে পাঠালাম উনাকে| রহিমের মা দুদিন নাতিকে ওষুধ খাওয়ায় তাতে জ্বর ভালো হলেও মুখে আর গায়ে হলুদ ভাব এখনও কিছুটা আছে তাই উনি চিন্তিত|
আবার বোঝালাম ওষুধগুলো খাওয়ান কয়েকদিনে ঠিক হয়ে যাবে, চিন্তার কিছু কারণ নেই, যদি এক সপ্তাহে ঠিক না হয় তাহলে আবার ডাক্তারের কাছে যাবেন| রহিমের মা চলে যায় সেদিন|
দু দিন পর খোঁজ নিলাম নাতি কেমন আছে?
রহিমের মা- “হ্যাঁ এখন ভালো আছে, ভাগ্যিস কবিরাজের কাছে গেছিনু তাই ভাল হলো”|
আমি বললাম- “মানে?”
রহিমের মা-“কবিরাজের কাছে গেছিনু, কবিরাজ ফুঁ দিয়েছিল আর ডাক্তারের ওষুধগুলা খাওয়াতে মানা করছিল, তাতেই দেখনু ভালো হলো গো”|
মুহূর্তের মধ্যে মন খারাপ হয়ে গেলো, প্রচণ্ড ক্ষোভ হচ্ছিল উনার ওপর যে এখনো কবিরাজিকে প্রাধান্য দেন মডার্ন মেডিসিনের যুগে আর একজন কবিরাজ কি মনে করে একজন ডাক্তারের দেওয়া ওষুধ খেতে নিষেধ করে, যদি কিছু হতো তাহলে ডাক্তারকেই দোষারোপ করা হতো| আর নিজের ওপরও রাগ হচ্ছিল যে আমি বোঝাতে ব্যর্থ তাই| আমি চুপ রইলাম আর রহিমের মা বিদায় নিল|
উপরের লেখাটি কিছুদিন আগের অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা।
যাই হোক এবার একটু নিও-ন্যাটাল জনডিস নিয়ে আলোচনা করা যাক।
১। নিও-ন্যাটাল জনডিস কী?
নবজাতকের রক্তে বিলিরুবিনের মাত্রা অত্যধিক হলে তখন তাকে নিও-ন্যাটাল জনডিস বলে |
২। নিও-ন্যাটাল জনডিস কত প্রকারের?
দুই প্রকারের – ফিজিওলজিক্যাল জনডিস ( রোগ নয়)
– প্যাথোলজিক্যাল জনডিস (এটা রোগ)
৩। ফিজিওলজিক্যাল জনডিস কেন হয়?
- নবজাতকের লোহিত রক্তকণিকার আয়ু কম, নব্বই থেকে একশো দিন হয় ( প্রাপ্তবয়স্কদের একশ কুড়ি দিন), হিমোগ্লোবিনের মাত্রাও বেশি তাই বেশি বিলিরুবিন তৈরী হয় |
- ইউ ডি পি গ্লুকোরোনাইল ট্রান্সফারেজ উৎসেচক যেটি বিলিরুবিন সংযুক্তকরণ এ সাহায্য করে সেটি অপূর্ণ থাকে |
৪। কিভাবে বুঝবেন ফিজিওলজিক্যাল জনডিস?
- শিশুর জন্মের প্রথম চব্বিশ ঘন্টায় দেখা যায় না, দ্বিতীয় দিন থেকে সপ্তম দিন পর্যন্ত থাকতে পারে জনডিস (টার্ম শিশু) এবং দ্বিতীয় দিন থেকে চৌদ্দ দিন পর্যন্ত থাকতে পারে (প্রি – টার্ম শিশুর)|
- মুখ থেকে শুরু হয়ে পায়ের দিকে এবং শরীরের মাঝখান থেকে বাইরের দিকে জনডিস (হলুদ ভাব) অগ্রসর হয়|
- হাতের তালু আর পায়ের তালুতে দেখা যায় না|
- বিলিরুবিনের মাত্রা পনেরো মিলি গ্রাম /ডেসিলিটার অতিক্রম করে না|
ঠিক এর বিপরীত বৈশিষ্ট্যগুলো থাকলে সেটাকে প্যাথোলজিক্যাল জনডিস বলা হবে|
- জন্মের প্রথম দিনে হতে পারে|
- এই ক্ষেত্রে জনডিস হাতের তালু এবং পায়ের তলায় দেখা যেতে পারে|
- এই ক্ষেত্রে বিলিরুবিন পনেরো মিলিগ্রাম /ডেসিলিটার এর বেশি থাকতে পারে|
- এটা শিশুর জন্মের পর সাত দিনরও বেশি (টার্ম শিশুর ক্ষেত্রে ) এবং চৌদ্দ দিনেরও বেশি (প্রি- টার্ম শিশুর ক্ষেত্রে) থাকতে পারে|
৫। প্যাথোলজিক্যাল জনডিসের কারণ?
- পলিসাইথিমিয়া (লোহিত কণিকা বেড়ে যাওয়া)
- হিমোলাইসিস (লোহিত কণিকা ভেঙে যায় Rh এবং ABO ইনকমপাটিবিলিটিতে)
- হেরিডিটারি স্ফেরোসাইটোসিস
- ইউ ডি পি গ্লুকোরোনাইল ট্রান্সফারেজ উৎসেচকের ঘাটতি ইত্যাদি ইত্যাদি |
৬। চিকিৎসা কী?
- ফটোথেরাপি (নির্দিষ্ট রং ও তরঙ্গের আলোক রশ্মি)
- এক্সচেঞ্জ ট্রান্সফিউশন (রক্ত পরিবর্তন)
- ফেনোবারবিটন (এক প্রকার ওষুধ)
নিজে থেকে চিকিৎসা করার মোটেও চেষ্টা করবেন না (শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ অথবা মেডিসিন স্পেশালিস্ট অথবা যেকোনো রেজিস্টার্ড মেডিক্যাল প্রাকটিশনারের কাছে চিকিৎসা করান)।
যথাসময়ে সঠিক চিকিৎসা না হলে প্যাথোলজিক্যাল জনডিসে শিশুর কি কি ক্ষতি হতে পারে?
সঠিক চিকিৎসা না হলে যেটা হয় তাকে ডাক্তারি পরিভাষায় বলে বিলিরুবিন ইনডিউসড নিউরোলজিক্যাল ডেফিসিট (কারনিকটেরাস) | তার ফলাফল হতে পারে :
- সিজার বা খিঁচুনি (মস্তিষ্কের ইলেকট্রিক্যাল সিস্টেমের ভারসাম্য নষ্ট হয়, ফলত মুভমেন্ট, ফিলিংস এই গুলোর পরিবর্তন হয়) |
- লেথার্জী (সব রকমের উৎসাহ, উদ্যম, শক্তি নষ্ট হয়)|
- ডেনটাল ডিসপ্লাশিয়া (ত্রুটিপূর্ণ দাঁতের গঠন হবে)|
- সেনসরি নিউরাল ডেফনেস (স্নায়ুর ত্রুটি হওয়ার জন্য কানে কম শোনা বা না শোনা)|
- সেরিব্রাল পলসি (লঘু মস্তিষ্কের কার্যকলাপ নষ্ট হয়)|
পড়ে বুঝতে পারলাম এখনো অনেক মানুষ কুসংস্কারে বিশ্বাস করে। সামাজিক সচেতন হবে তাদের বেশি করে বোঝাতে হবে
Outstanding writing,in rural area what kind of thinking is continuous among people and also shown their economic problem.but you express about treatment beautifully, diagnosis also speachless .carry on bro and go ahead ,best of luck ,may almighty Allah bless you and I am waiting for next cases.
Khub valo bhai,etake dhore rakhis,lekhata khub valo,asa kori in future aro valo kichu pabo tor kach theke,best wishes and lots of love bhai…