কাল কলেজ স্কোয়ার থেকে আর জি কর পর্যন্ত যে মিছিল হয়েছে তা সাম্প্রতিকে এই শহর দেখেনি। আমি যখন মিছিলের পেটের কাছে, শোভাবাজার, তখন শুনলাম মিছিলের মাথা শ্যামবাজার ক্রসিংয়ের সামনে। এক ভাই তখন ফোনে জানাচ্ছে তারা কয়েকজন মিছিলের একটু শেষের দিকে, কলেজ স্কোয়ার থেকে বেরিয়েছে সবে।
কাল আর জি কর ক্যাম্পাস, তার বর্তমান ছাত্রছাত্রীরা যে মাস দেখেছে, তার স্বতঃস্ফূর্ততা আর ক্রোধ দেখেছে, তাও তারা সাম্প্রতিকে দেখেনি। কালকের মিছিল মুখে মুখে ছড়ানো মিছিল। একটা বড় অংশ ডাক্তার সমাজ থেকে ছিল। ততোধিক বড় অংশ ছিলেন অডাক্তার। কোনও সেন্ট্রাল লিডারশিপ ছিল না, ছিল না পূর্বনির্ধারিত কোনও নির্দিষ্ট অ্যাজেন্ডা। তারপরেও মিছিল শেষে আর জি করে জমায়েত হয়েছে। গোটা ক্যাম্পাস কেঁপেছে স্বতঃস্ফূর্ত স্লোগানে। নতুন করে দাবীদাওয়া ড্রাফট হয়েছে। সেসব রিপ্রেজেন্টেটিভরা প্রেস কনফারেন্সে বলবেন। আমি শুধু ব্যক্তিগত জায়গা থেকে কয়েকটা কথা বলি…
১. পুলিশ এবং বিচারব্যবস্থার প্রতি আস্থা রেখেই বলছি, আমার এবং আমাদের মনে হচ্ছে এবার অনেকখানি দেরি হয়ে যাচ্ছে। এই নৃশংস ধ*র্ষণ- খু*ন একজনের কাজ নয়, হতে পারে না। এভিডেন্স বলছে। মৃত্যু পরবর্তী ঘটনাক্রম বলছে। আর জি করের ভেতর থেকেই লোকজন বলছে। তাহলে কেন আমরা রবিবার পর্যন্ত অপেক্ষা করব সিবিআই এর? পুলিশ এখনও পর্যন্ত কি যথেষ্ট সময় পাননি? যেখানে মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন সিবিআই চাইলে তাই হবে, সেই চাওয়াটা পিছিয়ে দেওয়া হচ্ছে ঠিক কার স্বার্থে?
২. ঘটনার দিন আর জি করের জুনিয়র ডাক্তারদের কাছে প্রথমে মেসেজ যায়, একজন থিসিস রিলেটেড কারণে মানসিক চাপে পড়ে “আত্ম*হত্যা” করেছেন! পুলিশ মৃতার মা-বাবা কে জানায় মেয়ে “আত্ম*হত্যা” করেছে! আরজিকরে প্রাথমিকভাবে যে কমিটি গঠন করা হয়েছিল সেখানে সায়কায়াট্রির ফ্যাকাল্টিকে রাখা হয় যেন “সাইকোসিস/ স্ট্রেস/ ট্রমা” ইত্যাদি অ্যাঙ্গেল গুলো প্রতিষ্ঠা করা যায়!
প্রথমে জানা যায় ঘটনার জায়গায় সিসিটিভি নষ্ট। তারপরে জানা যায় ঘটনার জায়গায় সিসিটিভিই নেই। তারপরে চব্বিশ ঘন্টা পেরিয়ে সিসিটিভি ফুটেজ সামনে আসে এবং জলের মত সব পরিষ্কার হয়ে যায়। (তথ্যগতভাবে ভুল বললে জানাবেন)
এবং অপরাধীর সমস্ত মোটিভ দিনের আলোর মত পরিষ্কার হয়ে যায়। ওহ সরি, আপরাধীর কোনও “মোটিভই” নেই। সে সিরিয়াল অফেন্ডার, বিকৃতকাম ও বিকৃতমনষ্ক। সে মত্ত অবস্থায় একটি ভরা হাসপাতালে ঢোকে, শুধু নিজের লালসা মেটাতে এরকম একটি ঘটনা ঘটায় এবং বেরিয়ে আসে। ফেলে আসা হেডফোন এবং সিসিটিভির লিড থেকে ধরা পড়ে, সমস্ত কিছু স্বীকার করে এবং নিরুত্তাপ হয়ে বলে “ফাঁসি দিলে দিন”।
এ স্বাভাবিক? হতে পারে কখনও?
৩. আমি একজন আউটসাইডার হয়ে, যার সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে কোনও পূর্বপরিচিতি না থেকে, কাল আধঘন্টা সময়ে যদি কাল আর জি করের ছাত্ররা নিজেরাই সেইসব নাম তুলে দিতে পারে যারা এখনও ভয় দেখাচ্ছে, মুভমেন্টকে ভুল পথে চালিত করছে, তাহলে প্রবল পরাক্রমী পুলিশের ক্ষেত্রে এগুলো জানা কি খুব দুরূহ?
এ প্রসঙ্গেই, কাল শুনেছিলাম আরজিকরের চারজন জুনিয়র ডাক্তারকে লালবাজারে ডাকা হয়েছিল। তার আপডেট কী?
৪. বাইরের রাজ্যে থাকার জন্য যেটুকু পরিচিতি হয়েছিল, সেখান থেকেই এই মুহূর্তে আমার লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে যাচ্ছে। প্রতিটি অডিও ক্লিপ, স্ক্রিনশট, আজ শুধু এ রাজ্যে নয়, গোটা দেশে ছড়িয়ে গেছে! তারা হতবাক হয়ে জিজ্ঞেস করছে, “ইজ দিস ট্রু”? আমার নন- মেডিকো বন্ধুরা হোয়াটস্যাপ করছে, “এটা কী হয়ে গেল”?আমি এই সবাইকে কী উত্তর দেব? মনে প্রাণে চাইছি যেন সবকিছু ভুল হয়, কিন্তু এসব অভিযোগের সামান্য একটিও যদি ঠিক হয়, গোটা মেডিকেল ফ্র্যাটার্নিটির সামনে আমি, আমরা কোন মুখ নিয়ে দাঁড়াব? গোটা দেশের কাছে “নিরাপদতম শহর” এর গর্ব ধরে রাখা, “মিছিল নগরী”, আমার কলকাতা, আমার রাজ্য নিয়ে যেটুকু গর্বের বাকি ছিল, কোন লজ্জার আড়ালে আমরা সবাই লুকোবো সেটুকু?
যদি ধরেও নিই এগুলি মিথ্যে রটনা, কিন্তু আর জি করের নিজের ছাত্রছাত্রীর কী দায় পড়েছে নিজেদের কলেজের নামকে এতখানি নীচে নামানোর? সেটা একজন করে, দু’জন করে, কিন্তু এতজন একই লাইনে কথা বলছে কেন? মিডিয়ার সেনশেনালিজমের কথা পাশে রাখলেও, কেন এতবড় একটা ঘটনায় সমস্ত সিরিয়াসনেসে, পুলিশ এইদিকগুলো খতিয়ে দেখবে না?
৫. কাল সন্দীপ ঘোষ আর জি কর থেকে পদত্যাগের কয়েক ঘন্টার মধ্যে কীভাবে ন্যাশনালে প্রিন্সিপালের পদে নিযুক্ত হতে পারেন? তার সম্বন্ধে বিগত কয়েক বছর ধরেই একের পর এক যে ভয়াবহ অভিযোগ উঠে আসছে, সেসব ছেড়েই দিলাম। শুধু এই ঘটনার দিকে তাকালেও, তিনি শুধু পদত্যাগ করেই নিজের দায় ঝেড়ে ফেলতে পারেন? নাকি এটি একটি সুচতুর খেলা যেন তাঁকে আর জবাবদিহির দায় নিতে না হয়?
কেন সন্দীপ ঘোষ সহ আরজিকরের সমস্ত কর্তৃপক্ষকে এনকোয়ারির আওতায় আনা হবে না? পদত্যাগে আর এক সরকারি জায়গা থেকে আরেক জায়গায় গিয়ে তারা তাদের ঘাড় থেকে এই ভয়ঙ্কর ঘটনার দায় নামিয়ে দিতে পারেন?
৬. কাল আর জি করে মাস মিটিংয়ে আমরা চেয়েছিলাম এই নারকীয় ঘটনায় পুরুষ রিপ্রেজেন্টেশানের বাইরে মেয়েরা যেন এগিয়ে আসে, মাস অ্যাড্রেস করে। ভাবতে পারবেন না কী পরিমাণ ট্রমার মধ্যে আছে সমস্ত মহিলা ডাক্তাররা। এত বড় একটা মিছিলের পরে, এতবড় একটা মাসের সামনেও তারা রীতিমতো ভয় পাচ্ছেন। ভিক্টিম হওয়ার ভয়।
এ আমার শহর নয়। কিছুতেই এ আমার শহর হতে পারে না।
আমি ডাক্তার- অডাক্তার নির্বিশেষে আলাদা করে সমস্ত নারীদের আহ্বান জানাচ্ছি, এর শেষ করুন। এর শেষ দেখে ছাড়ুন।
____________________________________________
আরজিকরের ঘটনা একটি এক্সট্রিম ফর্ম অফ ওয়ার্কপ্লেস ভায়োলেন্স। একটি ভয়ঙ্করতম রাজনৈতিক খু*ন। অরাজনীতি দিয়ে রাজনীতির মোকাবিলা হয়না। ক্ষমতাবানেরা চেয়ারে বসে দায়হীন ক্ষমতার উদযাপন করবে, গোটা ক্যাম্পাস জুড়ে প্রিন্সিপালের তত্ত্বাবধানে বছরের পর বছর ডাক্তার নয়, পার্টি ক্যাডার তৈরি হবে, আর আমরা অরাজনৈতিক হয়ে মাথা নীচু করে দিনগত পাপক্ষয় করব, আমাকে, আমাদেরকে এই শহর এই রাজনীতি শেখায় নি।
আমার বোন, আমাদের তিলোত্তমা সম্পূর্ণ বিচার চাওয়ার আগে পর্যন্ত এ শহর অচল হোক। ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে স্বাধীনতার ঝান্ডা উঠুক আমাদের ক্রোধ আর স্লোগানের ভেতর দিয়ে। ট্রাফিক সিগনালে নুরানি বোনেরা গেয়ে উঠুক “ম্যায় সোনা হু মিট্টি নহি/ যো তেরি শার্ট তে লাগি তেনু ঝাড় দি”…
নেভার ফরগেট। নেভার ফরগিভ।