অক্টোবরের সকাল। রামমোহন ব্লকের আই.টি.ইউ. এর পাশাপাশি দুটো বেডে ভর্তি সোহম আর রিজওয়ানুর। দু’জনেই ভেন্টিলেটরে। সোহমের বয়স চার। ডায়াগনোসিস গুলেইন বারি সিন্ড্রোম। আর রিজওয়ানুর মোটামুটি বছর চল্লিশের। ভর্তি ফ্লেইল চেস্ট নিয়ে। যে লরিটার খালাসিগিরি করতো সেটাই ব্যাক করার সময় অসাবধানতায় দেওয়ালে পিশে দিয়েছিল ওকে। পরিণতি বুকের বামদিকে সাতটি আর ডানদিকে ছয়টি রিব ফ্র্যাকচার এবং তার সাথে হিমোথোরাক্স।
ন্যাশনালের আই.টি.ইউ. তে পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট স্টুডেন্টদের তখন টানা দেড় মাস ডিউটি পড়তো। লটারি করে বানানো ডিপার্টমেন্টাল রোস্টারে অক্টোবরের এক থেকে নভেম্বরের পনেরো পর্যন্ত স্লটে আমার নাম দেখে আমি খুব ভেঙে পড়েছিলাম। সিনিয়র দাদা শ্রীকান্তদা আমায় সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিল, “মন খুব খারাপ লাগলে অষ্টমী আর নবমী বাড়ি ঘুরে আসিস। আমি দু’দিন সামলে দেবো।” না, শ্রীকান্ত দাকে রিপ্লেসমেন্ট দেওয়ার প্রয়োজন হয়নি। সোহম আর রিজওয়ানুরকে ওই অবস্থায় ফেলে যেতে মন চাইছিল না।
অষ্টমীর রাত। সারাদিন খাটাখাটনির পর মেডিসিনের পিজিটি অরবিন্দ আর আমি একটু বসে জিরিয়ে নিচ্ছিলাম। আটটার সময় সিনিয়র স্যার ডাঃ রফি আহমেদ নাইট ডিউটিতে ঢুকেই সিস্টারকে হাল্কা আওয়াজ দিয়ে বললেন, “আপনার তো বিয়ের পর প্রথম পূজো! আজকের রাতটাও কি অন্য কাউকে দিয়ে ম্যানেজ করা গেল না? বর তো বাড়িতে ছটফট করবে।”
“স্যার, এই নার্সিং ইউনিফর্মটা যখন পরে থাকি তখন বরের নয়, পেশেন্টের ছটফটানিটাই আমাকে বেশি চঞ্চল করে।” বয়সে ছোট হলেও সিস্টারের এই উত্তর সেদিন আমাকে ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছিল।
রফি স্যারের পকেট কেটে সেই রাতে আমরা আই.টি.ইউ. লাগোয়া একটা ঘরে বসে একসাথে ডিনার করেছিলাম। বিরিয়ানি খেতে খেতে রফি স্যার সিস্টারকে বলেছিলেন, “দিদিভাই, বিজয়ার নাড়ুটা কিন্তু পাওনা রইলো।”
সেই নাড়ু আমাদের আর খাওয়া হয়ে ওঠেনি। সোহমকে আমরা বহু চেষ্টা করেও বাঁচাতে পারিনি। দশমীর দিন মায়ের ভাসান হওয়ার আগেই চার বছরের নিথর দেহটাকে হয়তো পরম যত্নে, পরম স্নেহে গঙ্গায় ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সোহমের বাবা-মা’র সামনে গিয়ে দাঁড়ানোর মতো মনের জোর আমার ছিল না। তাই সেই নিঃস্ব দম্পতির সেদিনের মানসিক অবস্থার বর্ণনা করা আমার পক্ষে অসম্ভব। তবে এটা বেশ মনে আছে অপরিসীম মনের জোর নিয়ে লড়াই চালিয়ে যাওয়া আরেকজন মহিলাও সেদিন পাশের ফাঁকা বেডখানা দেখে হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলেছিল। না, সে সোহমের কেউ হয় না। রোজ ভিজিটিং আওয়ারে রিজওয়ানুরকে দেখতে আসা লেখাপড়া না জানা একটি মেয়ে। রুকসানা বানু। শিক্ষিত নাগরিক সমাজে অকিঞ্চিৎকর একটি নাম। এক অকিঞ্চিৎকর ট্রাক-খালাসির বৌ।
দুর্গাপূজা শেষ হল, লক্ষ্মীপূজাও পার হয়ে গেল। সোহমকে হারানোর কষ্টটাও ধীরে ধীরে কমে আসতে লাগলো। এদিকে সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে রিজওয়ানুরের দাড়ি গোঁফও এতো বড় হয়ে গেল যে এণ্ডোট্র্যাকিয়াল টিউব ফিক্সেশন ঠিকমতো করা যাচ্ছিল না। সিদ্ধান্ত নেওয়া হল যে ভেন্টিলেশনে থাকা অবস্থাতেই ওর দাড়ি-গোঁফ কামিয়ে দেওয়া হবে। অপেক্ষা শুধু রুকসানার অনুমতির। রুকসানা আসার পর এটা বলতেই সে অকপটে জানিয়ে দিলো, “ছাড়ুন তো ধর্মের কথা। দাড়ি-গোঁফ যা আছে একদম সাফ করে দিন। ও দিনে পাঁচবার নামাজ পড়তো তবুও ওর অ্যাক্সিডেন্ট হল। বাঁচার আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম। আবার দেখুন, এই পনেরো দিন একবারও নামাজ পড়েনি। তবুও তো মাথার উপরের যন্ত্রটা বীপ-বীপ আওয়াজ করে চলেছে। আমি জানি না কে ওকে বাঁচিয়ে রেখেছে। আগে সুস্থ হয়ে উঠুক, তারপর তো ধর্ম।”
জেনারেল সার্জারি, জেনারেল মেডিসিন, চেস্ট মেডিসিন, কার্ডিওথোরাসিক আর অ্যানেস্থেসিওলজি এই পাঁচটি ডিপার্টমেন্ট মেডিক্যাল বোর্ড করে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল রিজওয়ানুরকে কমপক্ষে একমাস পজিটিভ প্রেশার ভেন্টিলেশনে রাখা হবে। রিজওয়ানুরের সেন্ট্রাল ভেনাস লাইন দিয়ে চলতে থাকলো ফেন্টানিল, মিডাজোলাম, ভেকুরোনিয়াম আর নর-অ্যাড্রেনালিনের ইনফিউশন। তার সাথে তালে তাল দিয়ে ওঠা নামা করতে থাকলো ভেন্টিলেটরের হাপর। রোজগারহীন সংসারে বাচ্চাদের প্রতিপালন, দু’বেলা হাসপাতালে স্বামীকে দেখতে আসার ধকল আর আনুষঙ্গিক খরচ জোগাড় করতে করতে একসময় লড়াকু রুকসানারও মনোবলে ফাটল ধরলো। এই কয়েকদিনেই তার স্বাস্থ্যের ভাঙনটা বেশ প্রকট হয়ে উঠল। আগের মতো আর কথা বলত না। ভিজিটিং আওয়ারে বেডের পাশে একটা টুলে বসে সে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতো স্বামীর মুখের দিকে আর ফাঁকে ফাঁকে লক্ষ্য করতো হাপরের ওঠানামা।
লড়াই থামলো না। তিন সপ্তাহের মাথায় রয়েন্টজেন সাহেবের অজ্ঞাত রশ্মি জানান দিলো রিজওয়ানুরের পাঁজরের ভাঙা হাড় জোড়া লাগছে। সবাই আশার আলো দেখতে পেলাম। ধীরে ধীরে কমানো শুরু হল ওষুধের ডোজ আর ভেন্টিলেশনের সাপোর্ট। প্রায় চার সপ্তাহ পর রিজওয়ানুর চোখের পাতা খুললো।
দীপাবলির দিন সকালে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো ভেন্টিলেটরের পরাধীনতা থেকে রিজওয়ানুরকে মুক্তি দেওয়া হবে। না, এরপর আর কোনো বিপদ ঘটে নি। রিজওয়ানুর মুক্ত বাতাসে শ্বাস নিল। শুধু একটা মানুষ তার জীবনের একটা মাসের কোনো হিসেব পেল না।
আজ ভাইফোঁটা। রিজওয়ানুর বেডে বসে একটা ছোট্ট আয়না সামনে রেখে নিজের দাড়ি নিজেই কামাচ্ছে। আমি কাছে গিয়ে বললাম, “কী ঠিক করলে? আর দাড়ি রাখবে না?”
“না স্যার। বৌ বলেছে দাড়ি ছাড়া অবস্থায় দেখতেই নাকি আমায় বেশি ভালো লাগে।”
“খুব খারাপ কিছু বলেনি।” বলতে বলতেই খেয়াল করে দেখি রুকসানা পেছনে দাঁড়িয়ে।
দীর্ঘ এক মাস পর আজ মিঞা-বিবি একটু গল্প করবে। আমি অহেতুক আর কাবাব-মে-হাড্ডি হই কেন? ওদের জায়গা ছেড়ে দিয়ে আমি ডিউটি রুমে চলে এলাম।
একটু বাদে সিস্টার দিদি নক করলেন, “স্যার, রুকসানা একটু ভেতরে আসতে চায়। কিছু বলবে।”
বললাম, “পাঠিয়ে দিন।”
রুকসানা হাতে একটা ক্যারিব্যাগ নিয়ে ভেতরে ঢুকলো। আমতা আমতা করে সে বলতে শুরু করল, “স্যার, ভাইফোঁটার দিন আপনারা ছুটি পান না। আর আমিও মুখ্যু মেয়ে মানুষ। ভাইফোঁটার নিয়মকানুন জানি না। পায়েসটাও বানাতে পারিনি। এই লাচ্ছার প্যাকেটটা রেখে দিন। বানিয়ে খাবেন স্যার।”
আমি প্যাকেটটা হাতে নিয়ে পকেট থেকে একশো টাকার একটা নোট বার করে রুকসানাকে বললাম, “ভাইফোঁটার দিন বোনেরা যেমন ভাইকে ফোঁটা দেয়, ভাইয়েরাও তেমনি বোনকে গিফ্ট দেয়।”
শত অনুরোধেও রুকসানা টাকাটা নেয় নি।