তু আমাদিগের ভাষা শিখলি কেমনে বুলতো?– আশি ছুইছুই ডাক্তারবাবুকে প্রশ্ন সোনামণি সরেনের।
ডাক্তার একমনে পরীক্ষা করে যাচ্ছেন সোনামণির সঙ্গে আসা রোগীকে। ‘হু’ ছাড়া কোন উত্তরই দিলেন না সেই প্রশ্নের।
রোগী দেখা শুরু হয় সকাল ৯ টার দিকে। তারপর থেকে বসে টানা একশ থেকে দেড়শো জন রোগী তিনি নিজেই দেখেন। রোগী দেখতে দেখতে সময় কখনো শেষ দুপুর বা বিকেল পর্যন্ত গড়ায়। বেশিরভাগ রোগী আসেন ৭০ কিলোমিটার দূর থেকে কখনো বা আরো দূরের ঝাড়খন্ড থেকে।
বাঁকুড়ার ছাতনা ব্লকের ভগবানপুরের ফুলবেড়িয়া গ্রামের আমাদের হাসপাতালে প্রতিদিনের দিনলিপি এরকমই। এই এলাকায় আশেপাশে নেই কোন সরকারি হাসপাতাল বা স্বাস্থ্য কেন্দ্র। শহর থেকে পিচঢালা রাস্তা বয়ে ইদানিং কিছু ডাক্তারবাবু এসেছেন বটে , কিন্তু তাঁদের আস্তানা ওই এলাকার সদরগুলোতেই। প্রয়োজনের সময় তাঁদের সাড়া কমই পাওয়া যায়। গ্রামের মানুষের প্রধান ভরসার জায়গা তাই এই বুড়ো ডাক্তার বাবু, যাঁকে শীত গ্রীষ্ম বর্ষায় পাওয়া যায় স্থানীয় মানুষের অসুখে বিসুখে। আর প্রয়োজনে যিনি তাঁদের ভাষায় কথাও বলতে পারেন।
ডাক্তারবাবু কর্মজীবনে ছিলেন মেডিকেল কলেজ, ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ, বাঁকুড়া সম্মিলনী মেডিকেল কলেজ, আর জি কর মেডিকেল কলেজের ওষুধ বিজ্ঞানের শিক্ষক। সরকারি চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার আগে ছিলেন স্কুল অফ ট্রপিক্যাল মেডিসিন-এর প্রধান ও একই সঙ্গে রাজ্যের ড্রাগ কন্ট্রোলার। অবসর নেওয়ার পর তিনিই পশ্চিমবঙ্গ হেলথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম রেজিস্ট্রার হিসেবে যোগ দেন। কিন্তু খুব সহজেই ওই পদ তিনি ছেড়ে আসতে পেরেছিলেন সাধারণ মানুষকে চিকিৎসা দেবেন বলে। এখন আমাদের হাসপাতালে তিনি একমাত্র নিয়মিত চিকিৎসক।
একজন স্থায়ী চিকিৎসক হলেও আমাদের হাসপাতালে তিনি রোগী দেখার সম্পূর্ণ পরিকাঠামোকে গড়ে তুলেছেন। প্রচলিত পথের চেয়ে এখানে রোগী দেখার পদ্ধতি একটু ভিন্ন। প্রথমে রোগীর কাছ থেকে তাঁর রোগ সংক্রান্ত ইতিহাস জেনে নিয়ে তা প্রেসক্রিপশনে নথিভুক্ত করেন একজন স্বাস্থ্যকর্মী। তারপরে সেই প্রেসক্রিপশন যায় চিকিৎসকের কাছে। চিকিৎসক রোগসংক্রান্ত প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেওয়ার পর আমাদের হাসপাতাল থেকেই পাওয়া যায় জেনেরিক নামের ওষুধ। জেনেরিক নাম হওয়ায় ওষুধের দামও কম পড়ে। ওষুধের পাশাপাশি আমাদের হাসপাতালে এক্সরে, বিভিন্ন ধরনের রক্ত পরীক্ষা করা যায় ন্যূনতম অর্থমূল্যে। বেশিরভাগ পরীক্ষার রিপোর্টই একদিনের মধ্যে হাসপাতালের প্যাথলজি সেন্টার থেকে পাওয়া যায়।
এহেন পি কে সরকারের ডাকে এখন মাঝেমধ্যে এক এক জন চিকিৎসক আসেন রোগী দেখার জন্য। কিন্তু তারা কেউই নিয়মিত নন। আসলে ব্যতিক্রমী কাজে উৎসাহ দেওয়া সহজ কিন্তু ব্যতিক্রমী কাজ করা কঠিন।
কিন্তু কলকাতার ঘরবাড়ি বা সমস্ত প্রতিষ্ঠা ছেড়ে ওই প্রত্যন্ত গ্রামে গিয়ে চিকিৎসা কেন্দ্র গড়ে তোলাকে তিনি কোনোভাবেই ব্যতিক্রমী কাজ বলতে নারাজ। তাঁর কথায় কোন ব্যতিক্রমী কাজ করার উদ্দেশ্যে তিনি এই চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান করেননি, করেছেন মানুষের কাজ করার জন্য। কারণ তিনি মনে করেন দেশের সাধারণ নাগরিকদের স্বাস্থ্যের দায়িত্ব সরকারের নেওয়া উচিত। কিন্তু সরকার যখন তা করেনি, তিনি তাঁর মতো করে প্রান্তিক এলাকার নাগরিকদের চিকিৎসা দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তাঁর কথায়,” ভারতবর্ষের বেশিরভাগ মানুষ এখনো পর্যন্ত গ্রামে বসবাস করেন। অথচ এই বিপুল মানুষের কাছে কোন রকম চিকিৎসা পরিষেবাই পৌঁছায় না। ডাক্তারের অভাবে বিনা চিকিৎসায় মরে রুরাল ইন্ডিয়া। তবুও শাইনিং ইন্ডিয়ার এক বিন্দু সাইন গিয়েও পৌঁছায় না প্রান্তিক ভারতবর্ষে। একদিকে দেশ নাকি ডিজিটাল হচ্ছে, কিন্তু স্বাস্থ্য শিক্ষার মতো বেসিক পরিষেবাকে বাদ দিয়েই।” তাঁর মতে একমাত্র গ্রামের মানুষ হয়েই গ্রামের সমস্যা বোঝা যায়।
সেই কারণেই তিনি গ্রামের ছেলেমেয়েদের প্রাথমিক চিকিৎসার প্রশিক্ষণ দেওয়ারও ব্যবস্থা রেখেছেন আমাদের হাসপাতালে।
আহা মন ভরে গেল। দারুণ, দারুণ