না, ভয়টয় আর পাচ্ছি না তেমন!
ঘরই নেই তো পোড়াবি কী?
খবরের কাগজ, দূরদর্শনের বিভিন্ন চ্যানেল, সহপাঠী-সহকর্মীদের নানা হোয়াটস্যাপ গ্রুপ থেকে জানতে পারছি, আন্দোলন দানা বাঁধছে, ছড়িয়ে পড়ছে জেলা থেকে জেলান্তরের মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালগুলিতে।
এমন কি প্রাইভেট প্র্যাকটিশনাররাও একদিনের প্রতীকী ধর্মঘটে যাবেন সারা রাজ্য জুড়ে, এমন কথাও চলছে।
আশান্বিত হচ্ছি, আবার হচ্ছিও না। নিহত মানুষটি আগে মেয়ে, পরে ডাক্তার।
নারীর আপসহীন সুরক্ষার প্রশ্নে এই আন্দোলনকে দীর্ঘমেয়াদী করা প্রয়োজন। আর প্রয়োজন চিকিৎসক অচিকিৎসক নির্বিশেষে, নাগরিক প্রান্তিক সমস্ত শ্রেণীর মানুষকে এর সঙ্গে জড়িয়ে নেওয়া।
খুব কঠিন?
পড়শি দেশ পারে, আমাদের দেশও পেরেছিল কয়েক বছর আগে — একবার নয়, অনেকবার। আমাদের রাজ্যও পারবে নিশ্চয়।
যতক্ষণ না সাধারণ মানুষকে জড়িয়ে নিতে পারছি, ততক্ষণ এটি একটি ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ হয়েই রয়ে যাবে — সংবাদমাধ্যমের কাছে, জনগণের কাছে, বাইরের দেশগুলোর কাছে।
বয়স, ধর্ম, পেশা নির্বিশেষে সব মেয়েদের বলি — দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছে আমাদের — frailty, thy name is woman জাতীয় ন্যাকা লব্জগুলোকে বিলুপ্ত করে দেওয়ার দিন এসে গিয়েছে।
প্রশাসন প্রশাসনের কাজ করুন, আইন, ন্যায়পালিকা তাঁদের নির্দিষ্ট কাজ করুন — আমাদের দাঁত, নখ বের করার সময় এসে গিয়েছে।
ঢের হয়েছে সুভদ্র, সুললিত, কমনীয় ব্যঞ্জনা! দশপ্রহরণধারিণীকে মহোৎসাহে আবাহন করে আরাধনা করব, আর বাস্তবে নিজেরা আটকে থাকব শুধু সিঁদুরখেলায়?
বেশ করব, রাতে বেরোব — রাত কারো বাপ মায়ের সম্পত্তি নয়। প্রাগৈতিহাসিক মানসিকতার টিভি সিরিয়াল, ইভ টিজিংকে রোম্যান্টিক বৈধতায় মুড়িয়ে মান্যতা দেওয়া বলিউডি রম-কম, বিজ্ঞাপনী জগতে প্রতি মুহূর্তে নারীর পণ্যায়ন, সোশ্যাল মিডিয়ায় নিরন্তর মিসোজিনিস্ট মিম, জোকস আর রিল — ব য় ক ট করুন।
সুস্থ রুচি ভিনগ্রহ থেকে এলিয়েনরা এসে তৈরি করে দিয়ে যাবে না। শুভবোধ ঈশ্বর সশরীরে মর্ত্যধামে এসে হৃদয় এবং মস্তিষ্কে ঠুসে দিয়ে যাবেন না — নিজেদেরই আয়ত্ত করতে হবে। নিজেদের স্বার্থে, সন্তানদের স্বার্থে, পরবর্তী প্রজন্মের স্বার্থে।
কর্মস্থলে, শিক্ষাঙ্গনে, পথে, ঘরে সবখানে বেড়ি পরিয়ে রাখবে ভেবেছে? ভয়ের শৃঙ্খল?
বাইরে যেওনা, জুজু আছে? আমরা প্রত্যেকে নিজের কাছে নিজেই একটা প্রতিজ্ঞা করি, আসুন — যেখানে একজন মেয়ের উপর অবমাননা হতে দেখব, শারীরিকের কথা ছাড়ুন, মানসিক এমনকি সামাজিক ভাবেও কোনো মেয়েকে চাপে ফেলার চেষ্টা হচ্ছে দেখব, প্রতিবাদ করব সর্বশক্তি দিয়ে। অন্তত আমি তো করবই। আত্মীয়, বন্ধু, স্বজন, সহকর্মী যে-ই হও, আমার প্রতিবাদ আছড়ে পড়বেই। আমার আর কিছু হারাবার নেই।
পৃথিবী, তার সমাজ, তার জল, স্থল কেবলমাত্র পুরুষতান্ত্রিকতার জায়গির নয়।
এখন আর পিছিয়ে আসার জায়গা নেই — ভয় ভুলে সকলে সর্বস্তরের মেয়েদের সামগ্রিক নিরাপত্তা এবং প্রকৃত অত্যাচারীর শাস্তির আন্দোলনে শামিল হই চলুন।
কোনো সভ্যতা কিন্তু শেষ পর্যন্ত অধর্মের জয়ের নিশান ওড়ায়নি — ইতিহাস সাক্ষী।
পুনশ্চ:
একটু যোগ করছি। এটা আমার এতদিনকার ফেসবুকি বিপ্লবতুল্য পোস্ট নয়।
যদি একজনও এই পোস্টে প্রতিক্রিয়া না দেন বা মন্তব্য না করেন, আমার বক্তব্য বিন্দুমাত্র বদলাবে না।
ফলেন পরিচিয়তে।
একজন সত্তরোর্ধ্ব প্রবীণ নাগরিক হিসেবে আপনার সঙ্গে সহমত পোষণ করছি। বিগত শতাব্দীতে, এমনকি এই শতাব্দীর প্রথম দশকেও এরকম নারকীয় ঘটনা ঘটতে দেখিনি। প্রয়াত প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য একবার বলেছিলেন যে দুষ্কৃতীরা সর্বদাই কোন রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় আশ্রয় নিতে চায়, কিন্তু দেশের সর্বনাশ তখনই নেমে আসে যখন দুষ্কৃতীরা মনে করে সরকারটাই তাদের। গত এক দশক ধরে ঠিক এটাই ঘটছে। তোলাবাজি, ডাকাতি, খুন, ধর্ষণ – এখন প্রায় নিত্য ঘটনা। কোন একজন নয়, কোন এক সংগঠনও নয়, দেশকে শেষের সেই ভয়ঙ্কর দিনের হাত থেকে বাঁচাতে সকল শ্রেণীর সাধারণ মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। কর্মস্থলেই ধর্ষিতা ও নারকীয়ভাবে খুন হয়ে যাওয়া এক চিকিৎসক-ছাত্রীর শোচনীয় মৃত্যু আমাদের বিবেক জাগরিত করুক; আমরা তাকে বাঁচাতে পারিনি। শুধু দুফোঁটা চোখের জল নয়, আজ অন্তত তার স্মৃতির উদ্দেশ্যে আমরা করজোড়ে ক্ষমা প্রার্থনা করি।
একেবারেই খাঁটি কথা বলেছেন। নিজে বহুকাল পেশাদার চাকুরি করার সময় দেখেছি, মহিলারা
দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক, অরক্ষিত, এটাই প্রতিষ্ঠিত সত্য বলে ধরে নেয়া হয়। মহিলারাও এই ধারণাতে ইন্ধন জোগাতে সদা প্রস্তুত।
ভদ্রভাবে অন্যায়, শোষণ, দমনের প্রতিবাদ কানেই তোলা হয় না আর জোর গলায় প্রতিবাদের প্রতিক্রিয়া সব সময়েই প্রশাসনিক শাস্তি বা সামাজিকভাবে এক ঘরে করে দেওয়া। এই ভয়ের আবহ তৈরি করে আরও ভয়ানক পরিস্থিতি তৈরি করাই পুরুষতন্ত্র। একে জোটবদ্ধ ভাবে দাঁত নখ দিয়ে প্রতিরোধ না করতে পারলে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকেই যাবে।