১.
কেউ কেউ স্বভাবজনিত কারণে নীচে ছেঁড়েন, কেউ কেউ পৌরুষজনিত কারণে ওপরে গজান। খুব রেয়ার কিছু লোকজন একই সঙ্গে কাজের দিক থেকে নীচে ছেঁড়েন এবং খামতি ঢাকতে ওপরের দিকে পৌরুষ গজান…
প্রায় একখানা গোটা বছর পাওয়া গেছিল করোনার বিরুদ্ধে অসম্ভব লড়াইয়ের রসদ জোগাড়ের জন্য। কিন্তু যেহেতু আমরা নেতা বুঝলেও রাজনীতি, প্যানিক বুঝলেও বিজ্ঞান এবং আইপিএলের ফুলফর্ম বুঝলেও বেসিক দাবিদাওয়ার বানান বুঝি না তাই হাহাকারের মাশরুম ক্লাউড এই মুহূর্তে আমাদের স্ট্রেচারে পড়ে থাকা মৃতদেহ দেখে হাসছে। আপনার দুর্জয় সাহস আর ফেসবুকীয় বক্তব্য আসলে নিরীহ চা-কাকুর বিরুদ্ধে খিল্লি আর একলা বিলেত ফেরত কিশোরের বিরুদ্ধে মবলিঞ্চিংয়ের অসীম বীরত্বেই আটকে থাকে। সরকার আর মোদী-শা’র বিরুদ্ধে একটা সামান্য বক্তব্য রাখতে গেলেই যেহেতু জানেন পেছনে আড়াই ফুট লম্বা আছোলা ঢুকে যাবে তাই সেসব কথা পড়ে থাকে গলির কোণেই, আর আপনার মৃত কবিতার ওপর বিজেপির বিজ্ঞাপনের অ্যাড আসে পনেরো সেকেন্ডের!
২.
“এটা করোনার দ্বিতীয় ঢেউ নয়, এটা সুনামি”। আজ্ঞে প্যানিক আমি ছড়াচ্ছি না, বলেছেন স্বয়ং দিল্লি হাইকোর্ট। ব্যাপারটা শুধু মোট দৈনিক সংক্রমণের নয়, ভয় সংক্রমণের উর্ধ্বমুখী হার (প্রায় ৩০%, অর্থাৎ এই মুহূর্তে প্রতি তিনজনের টেস্ট হলে একজন পজিটিভ আসছেন), অপেক্ষাকৃত অল্পবয়সীদের মধ্যে বেশি সংক্রমণ, সংক্রমণের severity এবং অতি অবশ্যই ভ্যাকসিন কভারেজের!
এদেশে আমি আপনি তো মানুষ নই, শুধুই একজন শুয়োরের বাচ্চা ভোটার। তাই বিজেপি (এবং তৃণমূলও) এই ভয়ঙ্কর দ্বিতীয় ঢেউয়ের মধ্যে আমাদের সামনে নির্লজ্জ নির্বাচনী গাজর ঝোলায় “ক্ষমতায় এলে বিনেপয়সায় ভ্যাকসিন দেব”! আমরা কেউ একবারও জিজ্ঞেস করি না এঁদের যে মোট ১২১টি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থায় কর্মীদের টাকা কেটে অথবা জনকল্যাণ তহবিল থেকে (দুয়ে মিলিয়ে আড়াই হাজার কোটির ওপরে) অথবা লক্ষ মানুষের প্রত্যক্ষ দানের মাধ্যমে যে টাকা জমা পড়েছিল পিএম কেয়ার্সের ফান্ডে সেই টাকাগুলো তাহলে কোথায় গেল? কত বড় নির্লজ্জ এবং অক্ষম হলে একটি দেশের সরকার একটি জাতীয় (স্বাস্থ্য) বিপর্যয়ের মধ্যে তার নাগরিকের জন্য ন্যূনতম ভ্যাকসিনেশনের দায়িত্বটুকু থেকে হাত ঝেড়ে বলতে পারে “আমার সরকারি হাসপাতালে ভ্যাকসিনের পর্যাপ্ত সাপ্লাই নেই তবু আমি এই মুহূর্তে খোলা মার্কেটে ভ্যাকসিন ছাড়ছি এবং সংস্থাগুলিকে তাদের দাম নির্ধারণের ফ্রিহ্যান্ড দিচ্ছি”! এদেশের এই মুহূর্তে ভ্যাকসিন উৎপাদন এবং ডিস্ট্রিবিউশনের হার অনুযায়ী ৬০% ভ্যাকসিন কভারেজ পেতে (WHO এর মতে হার্ড ইমিউনিটির জন্য ন্যূনতম কভারেজ) আমাদের অপেক্ষা করতে হত মার্চ ২০২২ পর্যন্ত! এর মধ্যে সরকার জানিয়ে দিয়েছে ১৮-৪৫ এর ভ্যাকসিনেশন হবে শুধুমাত্র কোউইন অ্যাপে প্রিরেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমে, ‘মূলত’ বেসরকারি উদ্যোগেই। কোভিশিল্ডের দু’টি ডোজ নিতে দাম পড়বে ১২০০, কোভ্যাক্সিনের ২৪০০! মানুষের হাতে কাজ নেই, বেকারত্ব সর্বোচ্চ, হেঁশেলে আগুন, সবার ঘরে তো আর পার্টিফান্ড থেকে জনগণের মারা টাকা আসে না। এদেশের বিপুল জনগণের কতজন এই টাকাটা ভ্যাকসিনের জন্য খরচা করার বিলাসিতা বা সামর্থ্য রাখেন? ফলে আপাতত হার্ড ইমিউনিটির ভাই হয়েছে আর বেড এবং অক্সিজেনের ভাইপো, ‘বাঙ্গাল’ দখলের স্বপ্নই এদেশের ইতিহাস এবং বর্তমান জুড়ে আমার ও আমার বাবার এক ও একমাত্র সত্যি।
আমাদেরই টাকা নিজেদের পেছনে গুঁজে সরকার রান্নার গ্যাস থেকে ভর্তুকি তুলবে, পেট্রোল একশো ছোঁবে, কাঁচা বাজারে মূল্যবৃদ্ধি হবে লাগামছাড়া এবং তারপরে বাকি টাকায় এমপি কিনে এবং পশ্চিমবঙ্গ জয়ের কান্ডারী হেভিওয়েটদের জন্য শুধু দুশো কোটি হোটেলভাড়া দেওয়ার পরেও মাস-ভ্যাকসিনেশনের দায়িত্বটুকুও নেওয়া যাবে না! আপনি এ নিয়ে সামান্য গলা তুলুন, সে গলায় পা দিয়ে দেঁতো হাসি হেসে কোনও এক শুয়োরের বাচ্চা পাশ থেকে ঠিক বলে উঠবে “কুছ ভি করলো ভোসডিকে, আয়েগা তো মোদি হি”
৩.
সেই, আয়েগা তো মোদি হি, এছাড়া এ মায়াজীবনে আর আছেটাই বা কী। মানুষের কান্না, হাহাকার আর চিতার আগুনের দৃশ্য সবকিছুর মধ্যেও টিভিতে খায় ভালো। এবং খায় মোদির আসানসোল জনসভা আর তার গর্বোদ্ধত উচ্চারণ, মাস্কহীন অমিত শা’র হাজার হাজার লোকসহ রোড শো!
কারণ অ্যাঙ্কর থেকে শুরু করে মোদি-শা জানে এদেশের মানুষের প্রশ্ন করার মন আর আঙুল তোলার ধক, দুটোই দীর্ঘদিনের চেষ্টায় ভেঙে ফেলা গেছে। এদের সমস্ত সাহস ধাবিত হয় ‘অন্য’কে মবলিঞ্চ করার প্রতি, এদের সমস্ত পড়াশুনোর শুরু ও শেষ হোয়াটস্যাপ ফরোয়ার্ডে, এদেশের রাজনীতির বেসিক স্ট্যান্ডার্ড দিলীপ ঘোষে আর চিকিৎসাবিজ্ঞানের আপার লিমিট ডঃ হর্ষবর্ধনেই আটকে থাকে। এদের সমস্ত ক্রুদ্ধ বক্তব্য ধাবিত হয় শুধু এবং শুধুমাত্র মাস্কহীন, সচেতনতাহীন জনগণের বিরুদ্ধেই। হ্যাঁ, জনসচেতনতা বাড়ান বস, রাগ দেখান, কিন্তু আজকের এই কোল্যাপ্সের সমস্ত দায় শুধুই ‘মাস্কহীন চেতনাহীন জনগণের’ এই ধান্দাবাজিটা সরিয়ে রেখে সরকারকেও বলুন এই ধ্বংসের প্রাপ্য দায়টুকু তাকে নিতে। সেটুকু ধক যেহেতু আপনার নেই, কোনোকালে ছিলও না, তাই সৎ এবং নির্ভীক টিভির পর্দায় চিতাদৃশ্যের পাশেই শেষ পর্যন্ত ফুটে ওঠে কোলাপ্স করেছে নাকি ‘সিস্টেম’!
এদের গালে একখানা বিরাশি সিক্কা হাঁকিয়ে কেউ বলে না যে এই সিস্টেমটা আসলে কেন্দ্র সরকার! যে একটি বছর সময় পেয়েও চরম দায়িত্ববোধহীন হয়ে, বিজ্ঞানী এবং চিকিৎসকদের সমস্ত সাবধানবাণীকে জাস্ট প্রয়াগরাজে ভাসিয়ে দিয়ে পেটি পলিটিক্সের চাষ করে গেছে। আর আজ যখন গোটা চিকিৎসাব্যবস্থা আক্ষরিক অর্থেই ভেঙে পড়েছে, খুব অন্যরকম কিছু না ঘটলে সামনের দিন কয়েকের মধ্যে পাল্লা দিয়ে ভাঙবে বাকি পিলারগুলোও, তখনও জনসভা আর রোড শোর গর্ব নিজের ট্যুইটার হ্যান্ডেল থেকে শেয়ার করবেন ডঃ হর্ষবর্ধন। আজ্ঞে চাপ নেবেন না, আপনি কিন্তু ট্যুইটারে কোভিড নিয়ে সরকারের কোনও সমালোচনা করতে পারবেন না, অলরেডি অফিসিয়াল নিষেধাজ্ঞা বেরিয়ে গেছে। যোগীজি বলে দিয়েছেন ‘অক্সিজেন নেই বেড নেই’ টাইপের ‘গুজব’ ছড়ালেই NSA এর আওতায় দখল করা হবে সম্পত্তি! আর আমি শালা ক্লান্ত চারদেওয়ালের ভেতর প্রাণপণে ডিউটি থেকে ফেরা প্রিয়জনকে বাঁচাচ্ছি অবশ্যম্ভাবী মেন্টাল ব্রেকডাউনের হাত থেকে!
৪.
এই দেশটা একদিনে তৈরি হয়নি বস, তাই এই অবস্থাটা একদিনে কাটবেও না। কেউ জনস্বাস্থ্য নিয়ে প্রশ্ন তোলেননি এতদিন, বেড না পেলে জিজ্ঞেস করেননি সরকার কী করছে, প্রশ্ন তুলেছেন এদেশে থাকতে যদি এতই সমস্যা পাকিস্তান যেতে অসুবিধে কোথায়, হাত তুলেছেন সামনে পড়ে থাকা একক ডাক্তারের ওপর! তাই আজ যখন পাকিস্তানের মানুষ আপনার স্বাস্থ্যব্যবস্থার কলোসিয়ামের পাশে অক্সিজেন নিয়ে দাঁড়াতে চায় আর আপনি তার পাশেই ট্যুইটারে ট্রেন্ড করেন হ্যাপি বার্থডে সচিন আর ভারত কা বীরপুত্র মোদি, তখন আপনি ভেতরে জানেন সম্ভ্রম থেকে শুরু করে যুক্তি, বোধ থেকে শুরু করে প্রায়োরিটির প্রতিটি খেলায় আপনি হেরে ভুত হয়ে গেছেন! আপনার শুধু পুরোনোর গল্প আর ঐতিহ্যের গর্ব আছে কারণ আপনার কাছে বর্তমানের উত্তর অথবা ভবিষ্যতের রূপরেখার কোনোটাই নেই। তাই আপনি রাস্তায় পড়ে থাকা মৃতদেহের পাশাপাশিই বায়োবাবলের ওপাশে থাকা সান্ধ্য আইপিএলই ডিজার্ভ করেন। আপনার রাজনীতিহীনতার ওপর, প্রশ্নহীনতার ওপর, ভয়ের ওপর দিয়ে রোড শো করে যায় নির্লজ্জ রাজনীতি ও সংলগ্ন মৃত্যুমিছিল।
পাল্টা সাহসটাহসের কথা বলতে আর আলোর কথা শোনাতে পারলাম না বলে দুঃখিত। খ্যাতির চাষ অথবা নিউ এজ গুরুর জীবনবাণীর হোয়াটস্যাপ ফরোয়ার্ড কোনোটাই করি না। আমার কাছে এই মুহূর্তের ব্যক্তিগত ও সামগ্রিক হতাশাটুকুই বাস্তব, চোখের সামনে স্যাচুরেশন চল্লিশের নীচে নেমে গিয়ে বিনা অক্সিজেনে স্ট্রেচারে পড়ে থেকে কোল্যাপ্স করে যাওয়ার অসহায়তাটুকুই তীব্রতম সত্যি, ঘুম না আসা রাতের পাশে জমে ওঠা দুশ্চিন্তার ছাইটুকুই অণুজীবন।
কেউ কেউ যুগপৎ নীচে ছেঁড়েন এবং ওপরে গজান। বিনম্রতার পাঠ নেওয়া ভদ্রলোকেরা সকালে উঠে তার দিকে তাকিয়ে দেখেন উঠোন জুড়ে পড়ে আছে শিউলি ফুল আর দেওয়াল জুড়ে জেগে আছেন রবিঠাকুর। যাদের শরীরে হিথ লেজারের রক্ত বয় শুধু তারাই দেখতে পায় সাধুর আস্তিনের নীচে লুকিয়ে রাখা আছে হাজার কঙ্কাল, আর টিভিকমোডে লাইভ শো হচ্ছে মৃতদেহ জড়িয়ে থাকা মানুষের চিৎকারের।
আমার মৃত্যুর খবরের সামনে বিজেপির বিজ্ঞাপনের অ্যাড এলে স্কিপ করবেন না, ওটুকু বিনোদন আমার এবং আপনার মূল্যহীন জীবনে অবশ্যম্ভাবী প্রাপ্য ছিল…