বাড়ি ফিরছি। রাজাবাজারের নীল-সাদা মসজিদের সামনের জায়গাটায় গুচ্ছের লোকের জটলা। শতকরা হিসেবে পাঁচ শতাংশের মুখেও মাস্ক নেই। এসব এলাকায় আইনের শাসনও চলে না বোধহয়। অথচ, অন্ধ ধর্মীয় নিয়মকানুন বহাল তবিয়তে আছে, গুটখা খেয়ে পুচপুচ করে থুতু ফেলা আছে, প্রশাসনের নাকের ডগায় দেদার নিয়ম ভাঙা আছে। শুধু মাস্ক নেই। বুদ্ধিজীবীরাও কোনও এক অজানা কারণে এসব এলাকার বেনিয়মের কথা এড়িয়ে চলেন। কুম্ভমেলার ভিড় নিয়ে সঙ্গত কারণেই প্রতিবাদ হয়। হওয়াই উচিত। কিন্তু, ভিড় ঘিরে বাছাই করা প্রতিবাদ বিরক্তি জাগায়। মন্দির হোক, মসজিদ হোক, মেলা হোক, খেলা হোক, রাজনৈতিক জমায়েত হোক; ভিড়টা ভিড়-ই। এবং সেটা বিপজ্জনক। যাক গে, আর বিতর্ক বাড়িয়ে কাজ নেই। ঘাড়ে সাকুল্যে একটাই মাথা। রাজাবাজার পেরিয়ে আসতেই মাস্ক পরা মানুষের সংখ্যা বেশ খানিকটা বাড়লো। যদিও বাদবাকি রাস্তায় কখনোই সেটা পঞ্চাশ-ষাট শতাংশ ছাড়ালো না। আর সেটা কখন? যখন দেশের দৈনিক সংক্রমণ প্রায় চার লক্ষ ছুঁল। যখন হাসপাতালে হাসপাতালে ভর্তি না হ’তে পারা রোগীর ঢল। যখন অক্সিজেনের অভাবে স্বাস্থ্য-পরিষেবা বিপর্যস্ত। যখন দাউদাউ করে জ্বলছে গণচিতা। যখন ঘরে ঘরে জ্বরজ্বালা-সর্দিকাশি। শুধুমাত্র নিজের এখনও সেরকম সমস্যা নেই বলে দেদার স্বেচ্ছাচারিতা। এর মধ্যেই অল্প উপসর্গ নিয়ে ঘুরে বেড়ানো অগুনতি লোকজন আছে । যারা নিজেরা হয়তো সেরে যাচ্ছে কিন্তু রোগটা ছড়িয়ে দিচ্ছে। এই অসভ্য ভারতবাসী, এই বর্বর ভারতবাসী, এই অশিক্ষিত ভারতবাসী আমার ভাই নয়। এদের সহনাগরিক ভাবতে আমার ঘেন্না হয়। এই লোকগুলোই আবার কোনও এক একুশে ফেব্রুয়ারি কিংবা পয়লা বৈশাখে বাঙালীসত্ত্বা জাগিয়ে তুলে নিজেদের বিদ্যাসাগর, রামমোহন কিংবা রবি ঠাকুরের উত্তরসূরী ভেবে আবেগ থরথর বক্তব্য রাখবে। সামান্য মাস্ক পরতে যাদের এত অনীহা সেই তারাই আবার বুক ফুলিয়ে ‘হোয়াট বেঙ্গল থিঙ্কস টুডে…’ ইত্যাদি বলে ফেলবে অবলীলায়।
এদিকে হাসপাতালে নতুন ভর্তি হওয়া রোগী মানে বেশিরভাগই কোভিড পজিটিভ। নতুন করে আরও তিনজন চিকিৎসক ও প্রায় জনাদশেক স্বাস্থ্যকর্মী করোনার কবলে পড়লেন। জানিনা, এই ক্রমহ্রাসমান লোকবল নিয়ে কীভাবে হাসপাতাল চলবে। আউটডোর ভিত্তিতে চিকিৎসা করাতে আসা বাচ্চাদের প্রায় আশি শতাংশ জ্বর-সর্দিকাশি বা পেট খারাপ। এখন করোনা পরীক্ষা করাতে বললে সেরকম অবাকও হচ্ছেন না কেউ। এদিকে ভ্যাক্সিন নিয়ে অসংখ্য ভুল তথ্যের ভিড়। ভ্যাক্সিনকে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির চক্রান্ত ইত্যাদি বলে কিছু আঁতেল গুজব ছড়াচ্ছিল। তাদের পত্রপাঠ ব্লক করলাম। নতুন এক শ্রেণীর বিজ্ঞানীর সংখ্যা বেশ বেড়েছে। যাঁরা বিভিন্নভাবে দাবী করার চেষ্টা করছেন- মাস্ক পরার দরকার নেই। এ জাতীয় বিজ্ঞানীদের থেকে যত দূরে থাকবেন ততই মঙ্গল। সরকারি কিংবা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশিকা মেনে চলুন। মাস্ক যে রোগের ছড়িয়ে যাওয়া অনেকটাই আটকায় এ ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ নেই। এমনকি যদি ড্রপলেটের (বা এরোসল) আকার মাস্কের ছিদ্রের থেকে অনেকটা ছোটও হয় তাও সবাই মাস্ক পরে থাকলে রোগ আটকাবে। অবাক হচ্ছেন? ধরে নিন, আপনি একটা ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। পরপর দুটো দেওয়ালে দুটো জানালা। দূর থেকে জানলার ফাঁকের চেয়ে অনেক ছোট বল ছুঁড়ে দেখুন। বেশিরভাগ সময় কোনও না কোনও জানলায় আটকাবে। বলের (অর্থাৎ ড্রপলেটের) আকার ফাঁকের চেয়ে বড় হ’লে (সেটাই হয় বেশিরভাগ সময়) তো এত কঠিন করে ভাবার দরকারই নেই। এবং, ভাইরাসের হাত-পা নেই। সে নিজে থেকে ছুটে দৌড়ে যায় না। বিরক্ত, বিধ্বস্ত, হতাশ হয়ে অনেকগুলো কথা উগরে দিলাম। পাগলের প্রলাপ ভেবেই নিজগুণে এড়িয়ে যাবেন আশা রাখি।
এই দুঃসময়ে সব রাজনৈতিক দল ভোটযুদ্ধ ভুলে দেশকে বাঁচানোর শপথ নিক। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া অব্দি সরকারকে (বিশেষ রাজনৈতিক দল নয়) সব ধরনের সাহায্য করা দরকার। এবারের মতো মারীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে জিতলে আবার জানতে চাইবো- স্বাস্থ্যখাতে জিডিপির মাত্র এক শতাংশ কেন? সর্দার প্যাটেলের মূর্তি না বানিয়ে কতগুলো হাসপাতাল বানানো যেত? মন্দির-মসজিদ কি মানুষের জীবনের থেকেও মূল্যবান?
কাজের চাপে আরশির জন্মদিনে আসতে পারিনি। আজ সবাই মিলে তিন বছর চারদিনের মাথায় জন্মদিন পালন করা হ’ল। মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরতেই দমবন্ধ ভাবটা কোথায় উধাও! মনে পড়লো, এই অসময়েও রাস্তার দু’দিকে লাল হয়ে ফুটেছে কৃষ্ণচূড়া। ঝকঝকে চাঁদের আলো সেই একই রকম স্নিগ্ধ। ক’টা তো মাত্র দিন… আর কিছুদিন নিজেদের বেঁধে রাখা যায় না মাস্কে-স্যানিটাইজারে-হাত ধোওয়ায়? দাঁতে দাঁত চিপে আর ক’টা দিন… আমরা বেশিরভাগই বিশ্বযুদ্ধ দেখিনি, দেশের স্বাধীনতা দেখিনি। কিন্তু আমরা এরকম একটা অতিমারী দেখেছি। এবং লড়েছি। নতুন প্রজন্মকে সে যুদ্ধজয়ের গল্পটাও শোনাবো আমরাই। মৃতদেহের স্তুপের ওপর দাঁড়িয়ে গল্প বলতে আমাদের কারোরই ভালো লাগবে না বোধহয়…