সরকার আর কো-মরবিডিটি মৃত্যুর কথা বলছে না দেখে অনেকে- তাঁদের মধ্যে চিকিৎসকরাও আছেন- অনেক কথা বলছেন। কো-মরবিডিটি থাকলে করোনা নিউমোনিয়াতে মৃত্যুর সম্ভাবনা বাড়ে। এই আলোচনা পাব্লিক ডিবেটের অন্তর্গত বিষয় নয়- এটি চিকিৎসকদের তাত্ত্বিক আলোচনার বিষয়। একটি গবেষণায় দেখা গেছে উহান ও আমেরিকার মৃত্যুর প্রায় 54% এর কোমরবিডিটি ছিল। আমরা প্রতিবাদ করেছিলাম এই জন্য যে কোমরবিডিটিতে মৃত্যু বলে করোনার মারণ ক্ষমতা ছোট করে দেখা হচ্ছে। করোনার মারণ ক্ষমতা যত কম হোক সংক্রমণ ক্ষমতা বেশি হওয়ায় একসাথে প্রচুর রোগীর শ্বাসকষ্ট শুরু হলে, রোগে না মারা গেলেও চিকিৎসার অভাবে মারা যেতে পারেন। তাই সাবধানতা দরকার। বস্তুতঃ করোনার সংক্রমণ ক্ষমতা অনেকটা বেশি ও অসাবধানতা অত্যন্ত ক্ষতিকর হয়ে উঠতে পারে। এটাও আমরা অনেকবার বলেছি যে, সরকার ও সবার মনে রাখা দরকার যে এবোলা, সার্স, মার্সের মারণ ক্ষমতা কোভিডের চেয়ে অনেক গুণ বেশি।
জনস্বাস্থ্য কর্মী ও সাধারণ মানুষের কাছে করোনা ভাইরাসের সামাজিক সংক্রমণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা ঠেকাতে সব ধরনের সতর্কতা অবলম্বন কথা দরকার। যাদের কোমরবিডিটি আছে ও যাদের বয়স 50র উপর তাদের আরো সতর্ক থাকা উচিত। করোনা ভাইরাস শরীরে আছে কি নেই সেটাই বিবেচ্য, সেই ভাইরাস থাকা অবস্থায় মৃত্যু হলে তা কোভিড মৃত্যু, তার কোমরবিডিটি থাক আর নাই থাক। রাজ্য সরকার আগের ভুল শুধরে নিয়েছে। আর রূঢ় সমালোচনা করে এই মূহুর্তে লাভ নেই। ভবিষ্যতে এসব নিয়ে তর্ক বিতর্ক হবে। হওয়া বাঞ্ছনীয়ও বটে।
এই প্রসঙ্গে WHOর নির্দেশিকা নিয়ে অনেকে কটাক্ষ করছেন, অনেক চিকিৎসক ও করছেন । চীনকে খুশি করা ইত্যাদিও অনেকে বলছেন। একটা প্যানডেমিক এখনো চলছে। নতুন নতুন তথ্য উঠে আসছে। তার বিশ্লেষণ চলছে। আগে যা ঠিক ভাবা হয়েছিল আজ তা নতুন তথ্যের আলোকে নতুন করে ভুল বলে প্রমাণিত হতেই পারে। বিজ্ঞান এরকমই; বিশেষতঃ যেখানে গবেষণা সম্পূর্ণ হয় নি। অনেকে বলতে পারেন যে গবেষণা যখন সম্পূর্ণ হয়নি তখন কথা বলা কেন? মুখ বন্ধ রাখলেই হয়! WHO যেটি চেষ্টা করছে তা হল প্রতিটি মৃত্যু ঠেকানোর চেষ্টা করছে, খড়কুটো আঁকড়ে ধরে বাঁচানোর চেষ্টা। ভাণ্ডারে যখন যা নতুন তথ্য জমা পড়ছে সাধারন মানুষের কাছে নিরপেক্ষ ভাবে তা বন্টন করছে, তাই আমি WHOকে সমর্থন করি।
চীনের প্রসঙ্গে বলি, চটজলদি কোন মন্তব্য করার আগে ভাবুন যে ইতিমধ্যে WHOর অনেক প্রশাসনিক পরিবর্তন হয়েছে। উচ্চপদে অনেক পুনর্বিন্যাস হয়েছে। রোটেশন পদ্ধতিতে ভারত এখন চেয়ারম্যান। চীনকে অতিরিক্ত সুবিধা দিলে চেয়ারম্যান অনেক কথা বলতেন। চেয়ারম্যান দেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রী। সংক্রামিত এলাকায় শ্রমিকদের আটকে রেখে যখন সংক্রমণ শুরু হল তখন অপরিকল্পিত ভাবে তাদের কেন ফেরত পাঠানো হল তার কি উত্তর দেবেন? লক ডাউন অন্য দেশে উঠেছে যখন সংক্রমণ কমতে শুরু করেছে। এখানে তা হয়নি। এই আক্রান্ত দেশগুলির সংক্রমণের হার ও লক ডাউন শুরু ও শেষের দিনক্ষণ দেখলেই বোঝা যাবে যে কেন সবাই অপরিকল্পিত বলছেন! WHOকে নিয়ে আলোচনার আগে দেশের এই আভ্যন্তরীণ বিষয়ে আলোচনা দরকার। বস্তুতঃ ডোনাল্ড ট্রাম্প ও আমাদের সরকার, ও তাদের অন্ধ ভক্তদের উদ্দেশ্য হল কোভিডের দায় কারো ঘাড়ে চাপানোর জন্য বলির পাঁঠা খোঁজা। চীনকে দোষী বলা, তবলীগের ঘাড়ে চাপানো তেমন সুবিধা না হওয়ায় এখন শুরু হয়েছে WHOর আদ্যশ্রাদ্ধ। করোনার জন্য মোদি বা মমতা দায়ী নন। কিন্তু সংক্রমণ ঠেকানো, চিকিৎসার উপযুক্ত ব্যবস্থা ও লক ডাউনে নিরন্ন মানুষের খাবার পৌঁছে দেওয়া সরকারের দায়িত্ব। সেই দায়িত্ব যে কেন্দ্রীয় সরকার পালন করেননি তার দায় তো আর হুর নয়। একদিকে গুদামে খাবার পচে আরেক দিকে নিরন্ন মানুষের মিছিল, প্রবাসী শ্রমিকের নরক যন্ত্রণা ও মৃত্যুর দায় কার? অপর দিকে যাদের অর্থ আছে তাদের জন্য কেন একটি সমান্তরাল ব্যবস্থা এসবের উত্তর কি দিতে হবে না? 13 কোটি মানুষ কর্মহীন, 41 কোটির কাছে অর্থ নেই, জিডিপি শূন্যের নীচে। এর দায় কি বিরোধীদের নাকি শাহদের? এখন যখন সমাজের কোনায় কোনায় সংক্রমণ পৌঁছে গেছে তখন গোমূত্র, পঞ্চগব্য, তালি বাজানো এসব নিরর্থক মনে হচ্ছে না? নোটবন্দীর সময় মাইক্রোচীপের গল্প হাজারে হাজারে শেয়ার, টিভিতে আলোচনা যেমন হাস্যকর অথচ ওসব নিয়ে কোন আলোচনা নেই তেমনি গোমূত্র ও পঞ্চগব্যও ভ্যানিস। তার বদলে চিন, টু, মুসলমান, সাম্প্রদায়িকতা, যুদ্ধের জিগির!!
দেশ যখন এই রকম ভুগছে তখন আবার নির্বাচনী প্রচার- সেটি কার পরামর্শে? ভদ্রলোক তো মাস তিনেক প্রায় সেল্ফ আইসোলেশনে ছিলেন। এখন বেরিয়ে এসেই আস্ফালন, সেই মহরমের বাজনা?
এই প্রসঙ্গে এই রাজ্যের কথা একটু বলা দরকার। প্রবাসী শ্রমিকদের নিয়ে রাজ্য সরকারের ভূমিকা ও লক ডাউনের সময় মানুষের যে ভোগান্তি তা দূর করার ক্ষেত্রে সরকার ব্যর্থ হয়েছে। তবে, কোমরবিডিটি সমস্যা বাদ দিলে সংক্রমণ ঠেকানোর যে তৎপরতা দেখিয়েছে তা তুলনামূলক ভাবে অনেকটা বৈজ্ঞানিক বলে আমার ধারনা, যদিও কোভিড হাসপাতাল নিয়ে প্রচুর অভিযোগ আছে ও গত কালকের তিনজনের মৃত্যুর দায় সরকারকে নিতে হবে। এম আর বাঙ্গুর সিএমসি হাসপাতালের আভ্যন্তরীণ কিছু সমস্যা আছে যা শুধু প্রশাসনিক নয়। চিকিৎসকদেরও একটু আত্মসমালোচনা করতে হবে, বিশেষতঃ যারা প্রশাসনে আছেন বা সরাসরি রোগীর সেবা করছেন। কিন্তু সাধারণভাবে চিকিৎসকদের ভূমিকা অত্যন্ত উজ্জ্বল। প্রতিদিন ছোটখাট সমস্যা হলেই তা নিয়ে সোসাল মিডিয়ায় লেখালেখি না করে তা সংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক আধিকারিকদের জানানো দরকার। মনে রাখতে হবে স্বাস্থ্য প্রশাসনে কিন্তু বেশিরভাগই চিকিৎসক।
করোনা সংক্রমণ নিয়ে নতুন তথ্য আরো আসবে। নতুন গাইড লাইনও বেরোবে। কিন্তু ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বিধি সবাইকে মেনে চলতে হবে। অনেকে স্মল পক্স ও মিজলসের সাথে কোভিডের তুলনা করছেন। উপসর্গহীন বাহক থাকায় করোনা মোকাবিলা কঠিন। আবার হার্ড ইমিউনিটি উপসর্গহীন বাহক থেকে হতে পারে।
নির্বাচনের ঢাকে কাঠি পড়েছে। আম্ফান দেখেছেন। এখন দেখবেন নতুন ঝড়। প্রতিদিন দুয়েকটা অশিক্ষিত মুসলিম দেবদেবীদের কুৎসিৎ কথা বলবে, হিন্দুদের খুনের কথা বলবে। সাম্প্রদায়িক ইস্যু সামনে না এলে বিজেপির অসুবিধা তো। আর এসব লেখার জন্য মুসলমানের কোন অভাব নেই। সব যে বিজেপির প্ররোচনায় হচ্ছে এরকম ভাবার ও কারণ নেই। খারিজি মাদ্রাসা থাকবে আর ঘৃণা থাকবে না আর অমিত শাহ থাকবে ঘৃণা ছড়াবে না এই দুটো সমার্থক। পরস্পরের পরিপূরক।
আশা করি সবাই করোনা ও সাম্প্রদায়িকতা দুটি ভাইরাস থেকে বেঁচেবর্তে ভোট-টোট দিতে পারবেন। ভালো থাকুন। সচেতন থাকুন।
ভালো লেখা। সবার পড়া উচিৎ। আমি তো চেষ্টা করব আমার পরিচিত, সবাইকেই পড়াতে।