“তালাবন্দির সময় আমার কাছে একজন ₹৩০০০/- সাহায্য চেয়েছিল। তার ৩ জনের পরিবারকে যাতে আগামি ৩ মাস কিছু খাওয়াতে পারে। তবে যদি কৃষিজাত পণ্য অত্যাবশ্যকীয় সামগ্রীর তালিকা থেকে চলে যায় তবে তা সম্ভব হবে না।”
অত্যাবশ্যকীয় সামগ্রী অর্থাৎ যে পণ্যগুলো ছাড়া সাধারণ মানুষ কী ধনী কী গরীব কারুর বাঁচা সম্ভব নয়। যেমন খাদ্য, ভোজ্য তেল, জীবনদায়ী ওষুধ ইত্যাদি। এই সামগ্রীগুলোর ব্যবহার ঐচ্ছিক নয় এবং এদের মূল্যবৃদ্ধি হলে সমস্ত জনগণ বিশেষ করে গরীবদের ওপর এর প্রভাব আরো বেশি করে পড়বে।
অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইনের মাধ্যমে সরকার এইসব সামগ্রীর অত্যুৎপাদন এবং বন্টন ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করে এদের মূল্যবৃদ্ধি দমন করতে পারত।ফলস্বরূপ সাধারণ মানুষ সুলভ এবং সাশ্রয়ী ভাবে জীবনযাপন করত। এটা ছিল বলেই ভারতীয় শ্রমিকদের মাথাপিছু বেতন বিশ্বের মধ্যে নিম্নতম । এদের জন্যেই ভারতের শিল্পক্ষেত্র লাভবান হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের তীব্র মেহনতের কারখানাগুলোর ভারতে আসার অন্যতম কারণ এই সস্তার শ্রম।
এই মূল্য নিয়ন্ত্রণের ফলাফল লক্ষ্য করা যাক :-
১। গরীব চাষী এফ সি আই কে তার শস্যের একাংশ সরাসরি বিক্রি করে। এর মাধ্যমে খাদ্য সংভরণ ব্যবস্থা বহন হচ্ছে। কিন্তু নিরুপায় হয়ে অতি স্বল্প মূল্যে তার মেহনতের বাকি ফসলকে সে কোনো মধ্যস্থ ব্যাক্তির হতে তুলে দিতে বাধ্য হয়। দালাল জাতীয় মানুষগুলো নিজেদের প্রকাণ্ড হিমঘরে খাদ্যশস্য মজুত করে রেখে খোলা বাজারে বিক্রি করে লাভবান হয়। কিন্তু সেই একই কৃষক চাষে মন্দার সময় পরিযায়ী শ্রমিকে রূপান্তরিত হয়ে কারখানায়, শিল্পক্ষেত্রে মেহনত করে উপার্জন করতে যায়। কৃত্রিম ভাবে সৃষ্টি করা এই কৃষি সংকটের মধ্যে দিয়ে উদ্বৃত্ত মেহনতি মানুষের জন্ম হয়। কারখানা এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে এদের ন্যূনতম বেতনে নিয়োগ করা যায়।
২। এই আইনটা আজ অব্দি নব্য উদারপন্থার মুক্ত বাণিজ্য নীতির করাল গ্রাসের প্রতিবন্ধক হিসেবে গরীব মানুষকে রক্ষা করছিল। বড় পুঁজিপতিদের এই ক্ষেত্রটাকে কুক্ষিগত করতে না পারার অন্যতম কারণ ছিল মূল্যবৃদ্ধির নিয়ন্ত্রণ। শিল্প ক্ষেত্রের গড় লাভের নিরিখে এই ক্ষেত্রে লাভের অঙ্ক অনেক সঙ্কুচিত ছিল। ফলস্বরূপ মেহনত সর্বস্ব এই কৃষিক্ষেত্রে যান্ত্রিকীকরণ হয়নি। দেশের ৫০% এর বেশি জনসংখ্যা যারা কৃষক তারা নিজেদের নিছক জীবনোপায়ের মাধ্যম এই ক্ষেত্রে খুঁজে পেয়েছিল।
এই আইন সাম্প্রতিক কালে সংশোধিত করে তিনটি অধ্যাদেশ প্রণয়ন করা হয়। শস্য, ডাল, তেলের বীজ, ভোজ্য তেল, পেঁয়াজ এবং আলুর ওপর থেকে মূল্য নিয়ন্ত্রণ, মজুত করা এবং রফতানির সীমাবদ্ধতা উত্তোলন করা হচ্ছে। অর্থাৎ মধ্যস্থ ব্যক্তি এবার কৃষিজাত ফসল স্বল্প মূল্যে কৃষকদের থেকে কিনবে আর উদ্বৃত্ত ফসলকে হিমঘরে মজুত করে কৃত্রিম ভাবে বাজার নীতির সরবরাহ ও চাহিদার সূত্র মেনে মূল্যবৃদ্ধি করবে। গরীব চাষীর এর থেকে কোনো লাভ হবে না। বিগত অর্থবর্ষে (২০১৯-২০২০) কৃষিক্ষেত্র ৪% বৃদ্ধি দেখলেও ২০১১-২০১২ থেকে শিল্পক্ষেত্র মুখ থুবড়ে পড়েছে। বর্তমান অর্থনৈতিক মন্দা তাকে আরো প্রকট করেছে। আইনের পরিবর্তন এই বড় পুঁজিপতিদের লাভের স্বার্থেই করা হয়েছে।
পৃথক ভাবে আরেকটি অধ্যাদেশ পাশ করা হয়। এর ফলে ভূমির কেন্দ্রিকরণ,পুঁজি দ্বারা চালিত ভাগচাষ এবং কৃষিক্ষেত্রের যান্ত্রিকীকরণ সহজতর হবে। জমি দখল বিধিসিদ্ধ হবে এবং ক্ষুদ্রাকার কৃষিকাজ অসম্ভব হয়ে যাবে। ২০১১ জনগণনা অনুযায়ী দেশে ৮৭% ক্ষুদ্র এবং প্রান্তিক কৃষি পরিবার আছে (২ হেক্টরের থেকে কম জমি)। কৃষি ,পশুপালন,বেতন এইসব থেকে তাদের আয় ব্যয়ের থেকে কম। এতো কিছু সত্ত্বেও ৬০% পরিবার ভূমিকে তাদের সম্পদ হিসেবে ধরে রেখেছে। আইনের এই পরিবর্তনের ফলে গ্রামীণ মানুষের দুর্দশা বাড়বে এবং তারা শহুরে বস্তিতে ফিরে যেতে বাধ্য হবে। সর্বোপরি শ্রমিক আইন এখন জলবৎ তরল করা হয়েছে। নামমাত্র মূল্যে তাদের দিয়ে অমানবিক মেহনত করাতে শিল্পক্ষেত্র তৈরি। চাষী নিজের রক্ত জল করা শ্রমের বিনিময়ে আদানি ও আম্বানির কোষাগার ভরাবে। বিদেশি পুঁজির বিনিয়োগ বেশি দূরে নেই। আর বি আই ব্যাংক অফ চায়নাকে নথিভুক্ত করেছে যাতে চায়নার পুঁজিতে “মেক ইন ইন্ডিয়া” থুড়ি “লেবার ইন ইন্ডিয়া” তে বিনিয়োগ আসে।
দ্রব্যমূল্যের ওপর নিয়ন্ত্রণ না থাকলে খাদ্য সামগ্রীর দাম হুহু করে বাড়বে। তার সাথে পাল্লা দিয়ে সামগ্রিক ভাবে জীবন যাপনের খরচটাও বাড়বে। এফ সি আই এবং অন্যান্য গণবন্টন ব্যবস্থায় আগ্রাসনের মাধ্যমে সামাজিক ভর্তুকি ধীরে ধীরে লোপ পাবে। এফ সি আই এর ২.২৫ লক্ষ্য কোটি টাকা ঋণ আছে এবং আস্তে আস্তে সেটারও বেসরকারিকরণ হবে। সরকার খাদ্যে ভর্তুকির জায়গায় সরাসরি টাকা পাঠাবার পরিকল্পনা করছে। ২০১৫ সালে সরকার ১,২৫,০০০ কোটি টাকার যে ভর্তুকি দিত তা এখন ১৭০০০ কোটি টাকা কমে ১,০৪,০০০ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। রাষ্ট্রের এই ঔদাসীন্যের ফলে গরীব মানুষকে মুক্ত বাজার নীতির কাছে আত্মসমর্পণ করতে হবে।