দীর্ঘ সাড়ে চার বছর পর আজ আমাদের বিখ্যাত হাতুড়ে ডাক্তার মৃত্যুচরণ দাস দেশে ফিরছেন। ওনাকে “নিখাদ স্বাস্থ্য প্রচার আয়োগ” এবং “ভেষজ পুষ্টি মন্ত্রণালয়”-এর সহায়তায় দীর্ঘ এগারো বছরের জন্য আফ্রিকা আর ইউরোপের কিছু দেশে দেশীয় পুষ্টি দ্রবণ (কম্পূর্ণম, বর্নমোটা আর হরলিঙ্গম) মানে হেলথ ড্রিংক্স বিভিন্ন দেশের মানুষকে খাইয়ে তার ফলাফল নিয়ে গবেষণা করতে পাঠানো হয়েছিলো। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে তাঁকে ঠিক সাড়ে চার বছরের পর ওদেশ থেকে ফেরত পাঠিয়ে দেয়। মৃত্যুচরণবাবুর এরোপ্লেন আটচল্লিশ মিনিট দেরীতে আসছিলো তাই ইত্যবসরে ওনার চেম্বার পরিচালক ওরফে নিত্যসঙ্গী খালিপদ মন্ডল এয়ারপোর্টের এয়ার কন্ডিশনড ঘরে বসে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। যাই হোক প্লেন থেকে নেমে দুস্তর ত্রিস্তর বিস্তর খোঁজাখুঁজির পরে উভয়ের কোলাকুলি আলিঙ্গন ইত্যাদি হলো।
বাড়ি ফিরে খালিপদ চটপট ডিমের ঝোল আর গরম গরম সাদা ভাত রান্না করে ফেললো। তারপর ডাক্তারের পড়ার চৌপায়ায় (টেবিলে) থালা রেখে সপেঁয়াজ লঙ্কা দুজনে গপাগপ সাঁটিয়ে দিলেন। মৃত্যুচরণ বললেন “আহা কতদিন পর যে গরম ভাত আর ডিমের ঝোল খেলাম রে!” তারপর বাইরের ঘরে খালিপদ আর শোওয়ার ঘরে ডাক্তারের সে কী নিদারুণ নাকডাকা! মৃত্যুচরণের সঙ্গে পরিচয়ের আগে খালিপদ ভ্যানরিক্শা করে ঘুরে ঘুরে পুতুল বিক্রি করতো- কিন্তু হিসেবপত্তর বোঝে না বলে তার কেবলই লোকসান হতো। অবশেষে এখন সে ডাক্তারের দিবারাত্রির সঙ্গী। সন্ধেবেলা ঘুম থেকে উঠে চায়ের কাপ হাতে খালিপদ খাটে এসে বসলো আর ডাক্তার মৃত্যুচরণ বসলেন ওনার এক চিলতে বারান্দার আরাম চেয়ারে।
“তুমি এতো বছর গেছিলে কোথায়, দাদা? কী করতিই বা গেছিলে?”
ডাক্তার একটা নতুন ফ্লেক সিগারেটের প্যাকেট খুলে একটা সিগারেট ধরালেন। তারপর বললেন “আমি প্রথমে গেছিলাম বেঁটেদের দেশে আমাদের দেশের ঐ সব লম্বা হওয়ার পাউডরগুলো খাইয়ে ওদের লম্বা করা যায় কিনা জানতে– তারপর গেলাম লম্বাদের দেশে কী কী খেয়ে ওরা এতো লম্বা সেটা জানতে– এবার এইসব কথা আমি লিখে লিখে জানাবো….”
খালিপদর বিষ্ময় থৈ পায় না “বেঁটেদের দেশ?এরকুম দেশও আছে নাকি গো দাদা? তুমি সেখেনে গেইছিলে ……?”
মৃত্যুচরণ সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে বলেন “আমি প্রথমে আফ্রিকায় গেছিলাম – বাঘ, সিংহ, হাতি, জলহস্তী, গোরিলা আর হাজার রকম পাখির সঙ্গে পৃথিবীর সব থেকে বেঁটে মানুষদের বাসা ওখানে … ওদের পিগমি বলে .. গভীর জঙ্গলে থাকে…. ছোটো ছোটো সব মানুষ – ওরা তীর ধনুক বর্শা দিয়ে শিকার করে …ব্যাবিঙ্গা, এম্বুতি, বাকা, বাইকা, এফে, বেটওয়া, কতো রকমের পিগমি আছে রে ”
খালিপদ বলে “ওরা সবাই শিকার করে কেন?”
“ওরা ঐ সব জন্তু জানোয়ারের মাংস খেয়েই বাঁচে রে”
“বাচ্চারাও?” খালিপদর জিজ্ঞাসা।
মৃত্যুচরণ ঘাড় নাড়েন ।
খালিপদ বিশেষজ্ঞের মতামত দেয় “তাইলি বোধয় বাচ্চারা কচকচি হাড়গুনো খায়”, খালিপদর কচকচি হাড় বড্ড পছন্দ।
মৃত্যুচরণ বলতে থাকেন “একটা ছোটো দেশ বুরুন্ডি .. সেখানেও ওরকম বেঁটে মানুষ থাকে…”
“বুরুন্ডি?”
“ট্যাঙ্গানাইকা লেকের পূব দিকে একটা দেশ – ওখানে বেটওয়া বলে একটা উপজাতি আছে – কিন্যারোয়ান্ডা আর কিরুন্ডি ভাষায় কথা বলে ..দুটোই খুব কাছাকাছি ভাষা অনেকটা বাংলা আর অহমিয়া যেমন কাছাকাছি সেরকমই … আমি প্লেনে উঠে যেতে যেতেই ঐ ভাষাটা চটপট শিখে নিলাম তারপর সোজা গভীর জঙ্গলে…”
খালিপদ অবাক “জঙ্গুল? ওদেশেও জঙ্গুল আছে?”
“হ্যাঁ রে, ঘন জঙ্গল…. তিন হাজার রকমের গাছ … দু একটা বাওবাব গাছও আছে .. বিরাট বড়ো বড়ো .. বোতলের মতো দেখতে .. আগার সরু জায়গাটা থেকে ডালপালা বেরোয় .. ওই গাছেরা ওদের গুঁড়ির মধ্যে জল জমিয়ে রাখে – পিগমিরা সব ঐ গভীর জঙ্গলের ভেতরেই থাকে”
খালিপদ স্তব্ধ হয়ে শুনতে থাকে। “জানিস তো কম্পূর্ণম – হরলিঙ্গম বর্নমোটা এসবের হাজার হাজার প্যাকেট সঙ্গে নিয়ে গেছিলাম – আর সেই সঙ্গে অনেক অনেক বাংলুর বোতল নিয়ে গেছিলাম … ঐ বোতল কয়েকটা দিতেই বেটওয়াদের সর্দারের সঙ্গে ভাব হয়ে গেল। ও তো বাংলু পেয়ে ভীষণ খুশি- বলে কী জানিস?ঐ ইবোগুইনা মানে ইবোগার থেকে এ জিনিস অনেক ভালো। ইবোগুইনা জানিস না?” মৃত্যুচরণ খালিপদর অজ্ঞতায় হাসেন “ওটা হলো এক রকমের গাছের ছাল… খেলেই বিদঘুটে সব স্বপ্ন দেখা যায়। তারপর এক সন্ধেবেলা আমি আর সর্দার বাংলু নিয়ে বসে সর্দারকে আমার প্ল্যানটায় রাজী করালাম। সর্দার ইঙ্গোনা ঢাক বাজিয়ে বাজিয়ে সত্তর হাজার বেটওয়াকে আমার প্ল্যানের কথা জানিয়ে দিলো …ব্যাস তারপর থেকে দুবেলা আট বছরের সব বাচ্চাদের কম্পূর্ণম, হরলিঙ্গম আর বর্নমোটা খাইয়ে ওদের উচ্চতা মাপতে লাগলাম …” মৃত্যুচরণ ম্লান হাসেন “কিন্তু বাচ্চাগুলো একটাও লম্বা তো হলোই না বরং সাড়ে চার বছর পরে কিরকম যেন গ্যাদগ্যাদে ল্যাৎপ্যাতে থলবলে হয়ে গেল – দেখেশুনে আমাকে তো সর্দার আরেকটু হলেই ক্রাইসোমেলিড ভীমরুলের বিষমাখা বর্শা দিয়ে খুঁচিয়েই দিচ্ছিলো – কোনো রকমে রাতের অন্ধকারে পালিয়ে আসি”
মনোক্ষুণ্ণ খালিপদ মন্তব্য করে “পেইলে এলে? তোমায় খুঁচোতে পারলো নি?”
ডাক্তার ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে খালিপদর দিকে তাকিয়ে বলেন “তারপর গেলাম লম্বাদের দেশে। নেদারল্যান্ডস বা হল্যান্ড। ওখানে সবাই লম্বা লম্বা। একটা লম্বু পরিবারের বাড়িতে গেলাম– যেখানে দাদু ছেলে মেয়ে নাতি পুতি গুষ্ঠি শুদ্ধ সব্বাই তাল ঢ্যাঙা। আমি তো ডাচ ভাষা আগে থেকেই অল্প অল্প জানতাম। খানিক গল্প টল্প করে জিজ্ঞেস করলাম ‘Gezondheidsdrank?’ মানে হলো হেলথ ড্রিংকস”
খালিপদ সমঝদারের মতো মাথা নাড়লো “তারপর?”
“বুড়ো ভয়ানক খুশি হয়ে লাল গাল কাঁপিয়ে– নাকের পাটা ফুলিয়ে – চোখ কুঁচকিয়ে খুব একচোট হেসে একটা বোতল আমার দিকে এগিয়ে দিলো। আমি তো ঢকঢক করে গিলে নিয়েছি। তারপর দেখি আমার চোখের সামনে দিয়ে কতোগুলো মাছ উড়ে উড়ে যাচ্ছে। গাছেরা হামাগুড়ি দিয়ে দিয়ে আমায় ঘিরে ফেলেছে। লাল গালের বুড়োটা কাঁপতে কাঁপতে একটা মোমবাতি হয়ে গেছে– বলছে ফুঁ দিও না হে , ফুঁ দিও না কিন্তু ….ভয়ের চোটে আমি টেনে টেনে নিজের অর্ধেক চুল ছিঁড়েই ফেললাম– সেই থেকেই আমার মাথাভরা টাক ..”
খালিপদ অবাক বিষ্ময়ে শুনতে থাকে।
“পরে শুনলাম -ওটা একটা ভয়ানক কড়া মদ – হাপসবার্গ গোল্ড লেবেল অ্যাবসিন্থে – শতকরা প্রায় নব্বই ভাগই অ্যালকোহল … বেশী গিললে উল্টোপাল্টা সব জিনিস পত্র দেখা যায় – আধুনিক শিল্পীরা ছবিটবি আঁকার আগে নাকি ঐ সব পান করে তারপর আঁকে। তা আমার বাংলুই ভালো বাবা – বুঝলাম হেলথ ড্রিংকস ফ্রিংক্স খায় না ওরা এমনি এমনিই ঢ্যাঙা– আর ঐ বেটওয়ারা এমনি এমনিই বেঁটে। এইসব হেলথ ড্রিংকসে কিস্যু হয় না। সোওওওজা ফিরে এলাম। বুঝলি?”
খালিপদ কিন্তু খুশি নয় “ওই বেঁটেগুনোকে কেউ আর নম্বা করতি পারবে না?”
মৃত্যুচরণ উদাস হয়ে খানিকটা ভাবলেন তারপর বললেন “দ্যাখ খালিপদ লম্বা হওয়াটা আসলে হর্মোনের খেলা। গ্রোথ হর্মোন এবং আরও কিছু হর্মোনের ওপরে লম্বা বেঁটে হওয়া নির্ভর করে। সাধারণ ডাল ভাত মাছ ডিম সবজি এই সব পেট ভরে খেলেই লম্বা হবে যদি হর্মোন সব ঠিকঠাক থাকে”
খালিপদ বলে “বেশী করে হর্মোন ইঞ্জেকশন দিলি হয় না – হয় না তাইলি নম্বা?”
“নারে খালিপদ, কেবলমাত্র যদি হর্মোন কম থাকে তাহলেই ঠিক মাপমতোন দিলে এটা কাজ করবে। নৈলে হয় হঠাৎ করে হাড় গোড় সব বীভৎস মোটা মোটা হয়ে যাবে আর নাহলে ছোটোবেলায় ইঞ্জেকশন দিলে আকাশ ছোঁয়া লম্বা হয়ে যাবে”
খালিপদ বলে “তাইলে পিগমিগুনো বেঁটে কেন আর আমিই বা ইয়ে মানে এ্যাতো ছোটোখাটো কেন?”
মৃত্যুচরণ একটু চুপ করে থেকে বলেন – “সবই জিনের লীলা রে খালিপদ – জিনের লীলা”
খালিপদ কপালে হাত ঠেকায় “দাদা তাইলে তুমিও আজকাল জিন পরি অপদ্যাবতা এইসব মানতিছো?”
ডাক্তার একটা ব্যাঁকা হাসি হাসলেন “এ জিন অন্য জিন, শরীরের ভেতরে কোষের মধ্যে থাকে আর এরাই আমাদের কি হবে না হবে সব কিছু কন্ট্রোল করে …”
খালিপদ হাঁ করে শুনতে থাকে ।
“এরা অনেকগুলো অ্যামাইনো অ্যাসিড দিয়ে তৈরি। ধরা যাক লম্বা হওয়ার জিনটায় অ্যালানাইন, থ্রিওমিন, গ্লাইসিন আর সিস্টেইন এই চারটে অ্যামাইনো অ্যাসিড থাকে। দেখা গেছে বেটওয়াদের থ্রিওমিন নেই। কিন্তু পাশের জেলার বান্টুদের লম্বা হওয়ার জিনে থ্রিওমিন আছে। তাই বান্টুরা সব লম্বা। তেমনই যে সব মানুষ হর্মোন ঠিকমতো থাকা সত্ত্বেও লম্বা হয় না তাদের ঐ জিনের সিক্যুয়েন্সে থ্রিওমিন নেই। সুতরাং হর্মোনেরা লম্বা হওয়াটা ঘটায় কিন্তু সব হর্মোন ঠিক থাকলেও কতোটা লম্বা হবে সেটা আদতে লম্বা হওয়ার জিনই ঠিক করে। সবাই যা খায় সেটা খেলেই লম্বা হওয়া যায়। ঐ সব হেলথ ড্রিংকস সব কটাই মিথ্যের ব্যবসা। কিছু বুঝলি?”
খালিপদ কপালে হাত ঠেকিয়ে বলে “বাবা মা কেউ ছেল না.. কে আর আমাকে ঐসব হেল ড্রিং কিনে খাওয়াবে বলো দি’নি– আমরা হলাম গরীব গুর্বো মানুষ আমাদের কপালে ঐসব নাই .. আমরা বেঁটেই থাকবো”
মৃত্যুচরণ হতাশ হয়ে বলেন “এই মাত্র যে বললাম ওসব খেয়ে কোনও লাভ নেই সেটা মাথায় ঢুকেছে?”
“হুঃ তুমি বললেই হয়ে গেল– সারা দিন টিবিতে বলতিছে এই খাও ওই খাও তবে নম্বা হবে .. আমি বুঝি দেখিনি?”
মৃত্যুচরণ ঘুমিয়ে পড়েন। উনি বকবকিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন।