এই পর্বে এবং এর পরবর্তী পর্বে আমরা মনের খুব সাধারণ প্রচলিত একটি ধারণা এবং আমাদের স্মৃতি মস্তিষ্কের কোথায় থাকে তাই নিয়ে কথা বলব। এতে একটু স্নায়ুবিজ্ঞান ও মনোবিজ্ঞানের কচকচি আছে। কিন্তু লিখতে যখন বসেছি না বলে উপায় নেই।
মন নিয়ে গ্রিক, রোমান থেকে শুরু করে জার্মান এবং আমাদের প্রাচীন ভারতীয় দার্শনিকেরা অনেক কিছু বলে গেছেন। কিন্তু প্রথম মন ও মানসিক ব্যধিকে যিনি বিজ্ঞানের দৃষ্টি দিয়ে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন তিনি সিগমুন্ড ফ্রয়েড। ভিয়েনার এই ইহুদি ছাত্রটি ডাক্তারি পাশ করে খুব চেয়েছিলেন প্রাণীদের দেহ ব্যবচ্ছেদ করে স্নায়ুতন্ত্র নিয়ে গবেষণা করবেন। কিন্তু এর মধ্যে তিনি বিয়ে করেছেন। তখনকার দিনে এখনের মত গবেষণাকে জীবিকা করা যেত না। তাই সংসার প্রতিপালনের কথা ভেবে তিনি মনোবিজ্ঞানকে নিজের প্রফেশন হিসেবে বেছে নিলেন।
ফ্রয়েড বললেন আমাদের মনের তিনটে স্তর আছে। সবচেয়ে বাইরেরটি কনশাস বা চেতন। এটি সবসময় বাইরের পৃথিবীর রং, রূপ, দুঃখ, আনন্দ এগুলোতে অংশ গ্রহণ করছে। মাঝের স্তরটি প্রিকনশাস বা অবচেতন। আর পরেরটা আনকনশাস বা অচেতন। বাইরের স্তরটি ফ্রয়েডের মতে সামান্য। একটি হিমশৈলের চূড়ার মত। সবচেয়ে বড় অংশটি আনকনশাস। এটি আমাদের নাগালের বাইরে। এর খবর আমরা পাই না। পরে যদিও ফ্রয়েড মাঝের স্তরটিকে বাদ দেন। শুধু চেতন ও অচেতন মনের স্তরের কথাই বলেন।
ফ্রয়েড বলেন আমাদের মনের এই দুটি স্তর ছাড়াও খুব গুরুত্বপূর্ণ অন্য তিনটে অংশ আছে। তারা ইগো (ego), ইড (id) এবং সুপারইগো (superego)। ইগো আমাদের নিজস্ব সত্তা, অটোবায়োগ্রাফিক্যাল সেলফ্। এটি মূলত চেতন স্তরের মধ্যে বিচরণ করলেও এর একটা অংশ অচেতনের মধ্যেও রয়েছে। এই অংশটি আমাদের সত্তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে।
ইড বা ইট এই শব্দটিকে ফ্রয়েড নীটশের থেকে ধার করেছিলেন। তিনি বলেন মনের এই অংশটি যুক্তি বা বাস্তবতা দিয়ে নিয়ন্ত্রিত নয়- এটি হেডোনিস্টিক নীতি বা কাম, ক্রোধ, লালসা ও মাৎসর্য দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। ফ্রয়েডের মতে এটিই আমাদের মনের সবচেয়ে আদিম অবস্থা। জন্মের সময় শিশুদের মন এই অবস্থায় থাকে। এটি সবসময় চায় ইগো যেন কিছুতেই আঘাত না পায়।
সুপারইগো মনের আদর্শগত অংশ। এটিও দুটি স্তরের মধ্যেই ঘোরাফেরা করলেও এর প্রধান অংশটি অচেতন। আমাদের উচ্চাকাংখার নিয়ন্ত্রক এই সুপারইগো।
ইগোর অচেতন অংশ সবসময় ইড-এর আদিম যৌন ও তীব্র কামনা বাসনাকে অবদমনের মাধ্যমে প্রতিহত করার চেষ্টা করে। এই কাজ করতে সে যে সবসময় সফল হয় এমন নয়। যাদের ক্ষেত্রে ইগো ব্যর্থ হয় তারাই নিউরোসিসের শিকার। ফ্রয়েড মনে করতেন নিউরোসিসের চিকিৎসা করতে হলে তাই রুগির মনের অচেতনে ডুব দিতে হবে। এই কাজ করতে গিয়ে তিনি যে পদ্ধতির অবলম্বন করেন তার নাম ‘সাইকোঅ্যানালিসিস’।
ফ্রয়েড ও তার এই চিকিৎসাপদ্ধতি প্রায় এক শতক ধরে জনপ্রিয় ছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে এর অসাড়তা ধরা পরে। বিভিন্ন মানসিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার সাথে তিনি অবদমিত যৌনতার যেসব ব্যাখ্যা দিয়েছেন তাও পরবর্তীকালে ভুল প্রমাণিত হয়েছে। ফ্রয়েড চেয়েছিলেন তার তত্ত্ব বা হাইপোথিসিস একদিন বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার দ্বারাই বিচার হবে। আজ অনেক ইন্টেলেকচ্যুয়াল ফ্রয়েডকে নিয়ে অবজ্ঞাজনক মন্তব্য করে থাকেন। এটা সহজেই আমাদের চোখে পড়ে। আমাদের মনে রাখা উচিত ফ্রয়েড এমন একটা সময় মন নিয়ে, স্বপ্ন নিয়ে চিন্তা করেছেন ও তাদের প্রয়োগ করার চেষ্টা করেছেন যখন স্নায়ু চিকিৎসার কোনো ঢাল-তলোয়ালই আমাদের হাতে ছিল না। আরো মনে রাখা উচিত ফ্রয়েড অচেতন মন নিয়ে যে কথা বলেছেন আধুনিক গবেষণায় তা সত্যি প্রমাণিত হয়েছে। তা নিয়ে আমরা একটু পরেই আলোচনা করব।
ফ্রয়েডেরও প্রায় দুশ বছর আগে এক ফরাসি গণিতজ্ঞ ও দার্শনিক প্রায় দুই শতকেরও বেশি সময় ধরে তার তত্ত্বের মাধ্যমে ক্যাথলিক সমাজে খ্যাতিমান ছিলেন তার নাম রেনে দেকার্তে। দেকার্তের প্রায় চারশ বছর আগে করা উক্তি আজো আমাদের সর্বাধিক উল্লিখিত উদ্ধৃতিগুলির মধ্যে একটি- ‘কগিটো আর্গো সাম’। cogito ergo sum। ল্যাটিনে কথিত এর অর্থ, ‘আই থিঙ্ক, দেয়ারফর আই অ্যাম’।
আধুনিক দর্শনের জনক দেকার্তে ১৬৩২ সালে প্রথম তার এই ‘ডুয়ালিটি’র তত্ত্ব প্রচার করেন। তিনি বলেন আমাদের যে দেহ তা বাহ্যিক। রেস এক্সটার্না। রক্ত, অস্থি-মজ্জা, স্নায়ু, মাংশপেশী, মস্তিষ্ক এসব নিয়ে এটি তৈরি। এর মধ্যে দিয়েই আমাদের আদিম সত্তা প্রবাহিত হয়ে চলেছে। আর অন্যটি হল রেস কজিট্যান্স- আমাদের চেতনা, সৌল বা আত্মা। এই চেতনা বা আত্মাই একজন মানুষের অন্তর্জগত নিয়ন্ত্রিত করে।
এই তত্ত্বে যেহেতু আত্মার কথা ছিল তাই ক্যাথলিক চার্চ এই মতবাদকে জনপ্রিয় ও গ্রহণযোগ্য করে তোলার জন্য বিরাট ভূমিকা গ্রহণ করে। আজকের দিনেও বিজ্ঞানলেখক ও দার্শনিক কার্ল পপার এবং ড্যানিয়েল ডেনেট আংশিক হলেও দেকার্তের ডুয়ালিটি তত্ত্বে বিশ্বাস করেন। আমরা যারা ভারতীয় তার তারা আজ চার হাজার বছর ধরে দ্বৈতবাদী দর্শনে দেহ ও আত্মার তত্ত্বে বিশ্বাসী। তাই আমাদের কাছে এই ধারণা কিছু নতুন নয়।
কিন্তু দেকার্তের প্রায় দেড়শ বছর পর আরেকজন ভিয়েনার বিজ্ঞানী ও দার্শনিক ফ্রানৎজ যোসেফ গল বললেন যে দেকার্তে যেমন মনে করেন মন দেহের বাইরের অংশ, স্মৃতি বা চেতনা একটি দেহবহির্ভূত অংশ তা ঠিক নয়। তিনি দেহের বিভিন্ন কাজের জন্য মস্তিষ্কের একটি বিশেষ বিশেষ উঁচু অংশ বা বাম্পকে এর জন্য নির্দিষ্ট করেন। ভিয়েনার ক্যাথলিক চার্চ গলকে এই মতবাদের জন্য ভিয়েনা থেকে বিতাড়িত করেন।
গল যে করোটির বিভিন্ন উঁচু অংশগুলোকে বিভিন্ন কাজের জন্য নির্দিষ্ট করেন পরের দিকের গবেষণায় তাদের মিল খুঁজে পাওয়া যায় নি। কিন্তু একটা কথা মনে রাখা দরকার গলই ছিলেন প্রথম বিজ্ঞানী যিনি বলেছিলেন আমাদের চেতন ও স্মৃতির অবস্থান আমাদের দেহের বাইরে নয় মস্তিষ্কের ভেতরে।
আমাদের স্মৃতির এক অন্যতম সঙ্গী হল ভাষা। সেই ভাষার উৎপত্তি আমাদের মস্তিষ্কের যে একটি বিশেষ অংশে তা সর্বপ্রথম সঠিকভাবে বলেন এক ফরাসি বিজ্ঞানী। তার নাম পিয়ের পল ব্রোকা। ১৮৬১ সালে প্যারিসের এক মুচির কথা তিনি বলেন যার নাম ছিল লেবোর্নে। ব্রোকার কাছে যখন সে দেখাতে আসে তার ২১ বছর আগে লেবোর্নের মাথায় স্ট্রোক হয়। লেবোর্নের বয়স তখন ৫১। স্ট্রোকের পর থেকেই তার কথা বলার ক্ষমতা হারিয়ে যায়। অন্যের কথা সে বুঝতে পারত কিন্তু জবাব দিতে পারত না। কথা জড়িয়ে যেত। লোকে বুঝতে পারত না। সে লিখেও তার মনোভাব বোঝাতে পারত না।
ব্রোকাকে দেখানোর এক সপ্তাহ পরেই লেবোর্নে মারা যায়। তার মৃত্যুর পরে ব্রোকা তার শব ব্যবচ্ছেদ করে দেখলেন স্ট্রোকের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তার মাথার সামনের দিকের ফ্রন্টাল লোব। আরো যারা এভাবেই কথা না বলতে পাড়ার অসুখ বা অ্যাফেসিয়ায় ভুগতেন তাদের মৃত্যুর পরে তাদের মস্তিষ্ক নিয়েও ব্রোকা পরীক্ষা করে দেখলেন তাদের সকলের ক্ষেত্রেই ক্ষতিগ্রস্ত অংশটি ফ্রন্টাল লোব। ব্রোকা আরো লক্ষ্য করলেন যদিও আমাদের মস্তিষ্কের ডান ও বামদিকের অংশ দুটি একটি অন্যটির আয়নার প্রতিরূপ কিন্তু এক্ষেত্রে সবারই ক্ষতিগ্রস্ত অংশটি বাঁ দিকের ফ্রন্টাল লোব।
এরপরই ব্রোকা তার বিখ্যাত উক্তিটি করেন- ‘উই স্পিক উইথ আওয়ার লেফট ব্রেন’।
প্রায় এই সময়ই জার্মানির আরেকজন বিজ্ঞানী ওয়ার্নিক্স আরেক ধরনের অ্যাফেসিয়ার রুগিদের নিয়ে গবেষণা করছিলেন যাদের কথা বলার সমস্যা নেই কিন্তু স্ট্রোকের পরে তারা অর্থপূর্ণ কথা বলতে পারছেন না। তারা যে ঠিকভাবে বলতে পারছেন না এটা তারা নিজেরাও বুঝতে পারছেন না। এদের মৃত্যুর পরে তাদের মস্তিষ্ক নিয়ে ব্যবচ্ছেদ করে তিনি দেখলেন এদের ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত অংশটি মাথার সামনে নয় পেছন দিকে। তিনি স্পিচ সেন্টার বা কথা বলার অংশ হিসেবে ব্রোকা ও তার উল্লিখিত অংশগুলোর কথা বললেন এবং তারা কিভাবে সংযুক্ত তারও ব্যাখ্যা দিলেন।
পরবর্তীকালে তাদের গবেষণা সঠিক বলে প্রমাণিত হয়েছে। আমাদের মনে রাখতে হবে ব্রোকাই প্রথম স্নায়ুবিজ্ঞানী যিনি প্রথম আমাদের কথা বলার মত একটি স্নায়বিক কাজের জন্য আমাদের ব্রেনের একটি অংশ যে জরুরি সেটি সঠিকভাবে উল্লেখ করেন।
ব্রোকা ও ওয়ার্নিক্সের হাত ধরে পরবর্তীকালে আমাদের ব্রেনের বিভিন্ন অংশগুলো কিভাবে আমাদের স্মৃতির বিভিন্ন অংশ হিসেবে নির্ধারিত হল এবং স্মৃতিকে আমরা কিভাবেই বা শ্রেণীবিভাগ করলাম তা নিয়ে আকর্ষণীয় আলোচনা করব।
(চলবে)