ভারতে কোভিডে ঘোষিত মৃত্যু পাঁচ লাখ মত। কিন্তু সম্প্রতি সায়েন্সের একটি পেপারে রাশিবিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন, আসল সংখ্যাটা এর ৬ গুণেরও বেশি, ৩২ লক্ষ। গত বছরের ডেল্টা আক্রমণের সময় আমার কিসা গৌতমী আর বুদ্ধের উপাখ্যান মনে পড়ে। পুত্রহারা কিসা গৌতমী বুদ্ধের পায়ে লুটিয়ে পড়ে বলেছিলেন, তাঁর একমাত্র ছেলেকে বাঁচিয়ে দিতে। বুদ্ধ তাঁকে নগরে যে গৃহে কখনো মৃত্যু প্রবেশ করেনি, সেখান থেকে এক মুঠো সর্ষে আনতে বলেছিলেন। সারদিন কিসা গৌতমী দ্বারে দ্বারে ঘুরেও সেরকম গৃহ পাননি, যেখানে মৃত্যু প্রবেশ করেনি। ডেল্টার সময় আমাদের সেই অভিজ্ঞতাই হয়েছে। এমন কেউ নেই বোধহয় নেই বাংলায়, যার পরিচিত-স্বজন-বন্ধু-আত্মীয়-প্রতিবেশী কাউকে ডেল্টা কেড়ে নেয়নি। তাছাড়া সংবাদ মাধ্যমে আমরা দেখেছি, গুজরাটের সুরাতে ২৪ ঘণ্টা রোজ কোভিড মৃতদেহ দাহ করতে করতে চুল্লির ধাতু গলে যাওয়া, দেখেছি ড্রোন থেকে দিল্লিতে গণচিতার ছবি, দেখেছি উত্তর প্রদেশে পুড়াতে না পারা লাশ ভেসে আসার ছবি। আমাদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও এসব খবরের ভিত্তিতে আমরা অনুধাবন করতে পারি, যে সরকারি পাঁচ লাখ আসলে কোন সংখ্যাই নয়, আসলে তা অনেক বেশি। সায়েন্সের পেপারটিও সেই দিকেই নির্দেশ করে।
নেচারে একটি আলোচনা এসেছে, অন্যান্য পেপারের ভিত্তিতে যেখানে রাশিবিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন, কোভিডে অদ্যবধি পৃথিবীতে মৃত্যু হয়েছে ১-২ কোটি লোকের। ঘোষিত ৫৬ লক্ষর চেয়ে সংখ্যাটা ২-৩ গুণ বেশি। এবার একটা মৃত্যু মানে একটা মৃত্যু নয়, একটা পরিবার হারাল তার বাবাকে, মাকে বা সন্তানকে। কোন পরিবার হারিয়েছে একমাত্র উপার্জনকারীকে। যেমন, আমার পরিচিত ৩১ বছরের একজন ডেল্টায় যখন মারা যান, তখন ঘরে তার তিন বছরের শিশু এবং স্ত্রী আসন্নপ্রসবা ছিলেন। এধরণের ঘটনা একজন সরকারি ডাক্তারের ক্ষেত্রে (বন্ধুর সহকর্মী) শুনেছি। তরুণ ডাক্তার সবে প্রাকটিশ শুরু করেছলেন, সেরকম অর্থই নেই বাড়িতে। এঁদের স্ত্রীরা কি করে সন্তানদের বড় করবেন, সেটাই এখন বিরাট চ্যালেঞ্জ। বা ধ্বংস হয়ে গেছে পুরো পরিবারই। মধ্য ত্রিশের শিক্ষক স্বামী ভোটের ডিউটিতে গিয়ে সংক্রামিত হন। এরপর স্বামীস্ত্রী দুজনে সংক্রামিত হয়ে মারা যান, দুবছরের বাচ্চা এক সপ্তাহের মধ্যে অনাথ হয়ে গেল। তাই এই ক্ষতি খালি মৃতের সংখ্যা নয়, এই সংখ্যার ভার বইতে হবে আগামী এক প্রজন্মকে, যে পরিবারের ওপর এরকম দুর্যোগ নেমে এল।
এরপরেও কিছু মানুষ কোভিড নিয়ে বলতে গেলে প্ল্যান্ডেমিক বলে অন্যদের ব্যঙ্গ করছে, ভ্যাকসিন-মাস্কের বিরুদ্ধে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে, নিজেদের বহুযুগ আগের অর্জিত একটি চিকিৎসক পরিচিতি দিয়ে লোক খেপিয়ে যাচ্ছে খালি নিজেদের প্রাসঙ্গিক রাখতে, মিডিয়াতে মুখ দেখিয়ে মসীহা সাজতে। কোন ভুয়ো চিকিৎসক নিজের ব্যাবসা বাড়াতে ডায়েট দিয়ে কোভিড সারাবে বলছে। কোন হোমিওপ্যাথ মাস্কের বিরুদ্ধে, ভ্যাকসিনের বিরুদ্ধে বলে নিজের ব্যাবসা বাড়াচ্ছে। এরা নিজেদের সত্যজিৎ রায়ের ‘গণশত্রু’ সিনেমার চন্ডীপুরের ডাঃ অশোক গুপ্ত হিসেবে নিজেদের দেখাতে চাইলেও, এরা আসলে তার উল্টোটা। এরা সত্যিই গণশত্রু। আইনের আওতায় এরা বেঁচে গেলেও (যদিও বাঁচা উচিৎ নয়), এদের মুখোশ খোলা একান্ত দরকার।
তথ্যসূত্রঃ ১। COVID mortality in India: National survey data and health facility deaths, SCIENCE (2022)
২। The pandemic’s true death toll: millions more than official counts, Nature, NEWS FEATURE, 18 January 2022