আমাদের তপ্ননবাবু একটা চায়ের দোকানে বসে পতাকা বিড়ি ফুঁকছিলেন। আপাততঃ উনি খালপাড় বস্তি থেকে উচ্ছেদ হয়ে একটা ফ্ল্যাটে উন্নীত হয়েছেন। সেখানে একতলায় কমনরুমে এক বন্ধুর কৃপায় বিনা ভাড়ার বাসিন্দা। তাতে ওনার চিত্তপ্রফুল্লতায় কোনও ঘাটতি পড়ে নি। বরং কলকোলাহাল বর্জিত চমৎকার একটি পরিবেশে চুটিয়ে গানবাজনা করছেন।
এমন সময় খাঁদু হাঁফাতে হাঁফাতে এসে উত্তেজিত টুত্তেজিত হয়ে বললো “হিজড়ে…..এসেছে। পাশের বাড়িতে… বাচ্চা নাচাতে কুড়ি হাজার চাইছে”
তপ্ননবাবু ধোঁয়া ছাড়লেন “ফুসসসস”
“ফুসসসস মানে কী? ইয়ার্কি নাকি? জানো ভগবানের অভিশাপে ওদের এই রকম জন্ম!”
তপ্ননবাবু এবার নাসিকাপথে যে শব্দটা করলেন তাকে ভালুকের ডাক বলা যায় “ঘ্রুঁউউউৎ”
“তাহলে এরকম কেন হয়?”
তপ্ননবাবু দোকানদার গোদুকে একটা ফ্লেক সিগারেট দিতে বলেন। এককালে ওনার অবস্থা যাকে বলে অবস্থাপন্ন ছিলো। এখন কেউ খাওয়ালে সিগারেট জোটে নৈলে বিড়ি।
খাঁদু বললো “গোদুদা একটা করে চা”
তপ্পন মহা খুশিতে বললেন “আরে এটা কোনও শারীরিক জন্মগত ত্রুটি নয়”
গোদু চা এগিয়ে দিলো। তপ্পন চুমুক দিয়ে বললেন “এটা কখনও ম্যানমেড কখনও বা মানসিক আবার কখনও সামাজিক বা ধর্মীয় আচার”
গোদু খাঁদু দুজনেই গোলচক্ষু বিহ্বলমান “বলো কী খুড়ো?”
“সেটাই তো আমি বলছি। তবে শোনো জন্মগত ত্রুটিগুলোর কথা। এগুলো সবই ক্রোমোজোমের গন্ডগোল। প্রথম আসবে ট্রু হার্মোফ্রোডিটিজম”
“বাপ্রে! কী খটোমটো নাম, তোমার দাঁত পড়ে যায়নি তো খুড়ো?”
তপ্ননবাবু একগাল হেসে বললেন “বাঁধানো। নো চিন্তা। এই ট্রু হার্মোফ্রোডিটিজম, এটায় মানুষের পুরুষ জননাঙ্গ এবং স্ত্রী জননাঙ্গ দুটোই থাকে। সাধারণতঃ নানা গন্ডগোল থাকার জন্য এদের যৌনতা বোধ থাকে না। এবং কোনো হিজড়ের মধ্যে, দেশী অথবা বিদেশী, এই ট্রু হার্মোফ্রোডিটিজম দ্যাখা যায়না”
খাঁদু এবং গোলু বিষ্ময়াহত। গোদু, খাঁদুর অননুমতি সাপেক্ষে একটা ক্লাসিক সিগারেট এগিয়ে দ্যায়। তপ্পন ওটা অনেক বার দেখে, শুঁকে ঠোঁটে ঠ্যাকান-য্যানো মারিজুয়ানা খাচ্ছেন।
“এবার বলি সিউডো বা নকল হার্মোফ্রোডিটিজম সম্বন্ধে।এটাও ক্রোমোজোম ঘটিত রোগ। এতে একধরণের, ধরে নাও, পুরুষের আকৃতি থাকে অথচ ভেতরে স্ত্রী জননাঙ্গ থাকে। হিজড়াদের দলে এদেরও দেখা যায় না”
খাঁদু বিলম্বিত প্রশ্ন করে “তাহলে হিজড়ে কারা?”
গোলালুর মতো চোখ করে গোদুর প্রশ্ন “হিজড়ে কী ভাবে হয়?”
তপ্ননবাবু গুনে গুনে তিনবার কাশি দিয়ে বলেন “উফফফফ গলা শুকিয়ে গেছে, গরম লাগছে, মাথা বনবন করছে। আগামীকাল বাকিটা বলবো”
খাঁদু বিষণ্ণবদনে বললো “উফফ কী শয়তান, কী শয়তান।গোদু শয়তান বুড়োটাকে একটা ওম্লেট দে”
শয়তান বুড়ো বা তপ্ননবাবু বলেন “অহো কী চমৎকার সব বাক্যবন্ধ। যাহোক ডিমটা কচি করে হবে এবং লঙ্কা কুচি, পেঁয়াজ কুচি…” আহ্লাদে বুড়োর জিভ দিয়ে লালা ঝরে।
তপ্পনবাবু ওম্লেট আসার আগেই শুরু করেন। “আমাদের দেশে সমস্ত রীতি নীতির বাইরে চলছে দারিদ্র্য। লাগাম ছাড়া ঘোড়ায় চেপে চলছে টগবগ বগটগ… ঐ যে চৌমাথার মোড়, ওখানে একটা তেরো চোদ্দো বছরের ছেলে কাউন্টারে কাজ করতো… তো আমরা এক দোকানে ভাত খাই। একদিন ছেলেটা বললো “জানো দাদু আমি দোকানের কাজটা ছেড়ে দিয়েছি। এখন কাকার সঙ্গে কাজ করি….ঐ তিলকপুরের রথতলায়”
“কী করিস তাহলে?”
সে ছেলে কিছুতেই বলবে না। অনেক সাধ্যসাধনার পরে কবুল করলো যে ও এখন তিলকপুর থানার সামনে চৌমাথায় হিজড়ে সেজে টাকা নেয়। “এটায় অনেক বেশী বেশী টাকা। বোনটার বিয়ে দিতে হবে (এটা তপ্পনের ক্ষুদ্র ঘিলুতে ঢোকে না। বিয়ে দিতে টাকা লাগবে কেন?)
আরেকবার বর্ধমান থেকে দূরপাল্লার ট্রেনে করে ফেরার সময় দরজায় ঠ্যাং ঝুলিয়ে বসে আছি। পায়ের তলা দিয়ে হু হু করে প্ল্যাটফর্ম আর পাথর দৌড়চ্ছে। এমন সময় পাশে একটা হিজড়ে ঘ্যাঁসাঘেঁসি করে বসে বিড়ি টানতে লাগলো। বেলুড় আসতেই ট্রেনের গতি কমে এলো।লোকটা পরচুলা খুলে শাড়িতে মালকোঁচা মেরে রানিংএ নেমে গেল। কিম্বা মহাভারতে বৃহন্নলা….”
“আরে খুড়ো থামো মহাভারত আমরা পড়িনি… এসব ছেড়ে আসল কথায় এসো” ডিমের থালা এগিয়ে দিতে দিতে গোদুর সাফ কথা।
তপ্ননবাবু ডিম চিবুতে চিবুতে বলতে থাকেন- “হিজড়াদের কথা প্রথম জানা যায় ঐতিহাসিক যুগে। গ্রীস এবং পাশ্চাত্যের বহু দেশে। তারা রাজাদের মহিলা মহল পাহারা দিতো। এদেশেও খোজারা হারেম পাহারা দিতো। খোজা কিন্তু হিজড়ের আরেক নাম। এছাড়া কিন্নর, আরভানি-নানা জায়গায় এদের নানা নামে ডাকা হয়।
এখন কাদের ধরে হিজড়ে করা হতো সে বিষয়ে কোনো উল্লেখ নেই।
“হিজড়ে করা হতো?” গোদুর অনন্ত বিষ্ময়।
“হ্যাঁ হিজড়ে মানে এমন একজন পুরুষ যার ইয়ে মানে জননাঙ্গ ছুরির এক কোপে কেটে, রক্তপাত বন্ধ করতে কিছু গুঁজে দেওয়া হয়।”
খাঁদু হাত বাড়িয়ে একটা সিগারেট ন্যায়। চোখে আতঙ্ক। দৃশ্যতঃই হাতে ধরা লাইটার কাঁপছে। তপ্পনবাবু ডিম মুখে দিয়ে বলতে থাকেন। “পরে নানা ধর্মীয় কাজের জন্য পুরুষকে হিজড়ে বানানো হতো-মেয়েদের দিয়ে যেমন কুমারী পুজো করানো হয়। এই সব হিজড়েরা নিজেদের বয়স হলে একটু নারীভাবসম্পন্ন পুরুষদের নিয়ে এসে লিঙ্গচ্ছেদ করে হিজড়ে বানায়। সব থেকে বয়স্ক হিজড়েকে নায়ক বা গুরু বলা হয়। এই ভাবে আমাদের দেশে হিজড়ে প্রথা চালু আছে। এছাড়াও পশ্চাদমনোভাবের পরিবারে সমলিঙ্গ আকৃষ্ট ছেলেটাকে ঘর থেকে বের করে দেওয়া হয়-সেও স্বাভাবিক জীবন থেকে বঞ্চিত হয়ে হিজড়াদের পাল্লায় পড়ে শেষে হিজড়ে হয়ে যায়।”
খাঁদু একটু তো তো করে প্রশ্ন করে “সমলিঙ্গে আকৃষ্ট মানে…”
তপ্পন ডিমের থালা রাখতে রাখতে বলেন “গে, হোমোসেক্সুয়াল…কেন নাম শুনিস নি?”
“এটা কেন….মানে কাদের হতে পারে? গোদু যাকে বলে থতভম্ভ।
“নাও খুড়ো চা নাও..” গোদু নিজেও একটা চাচুম্বন করে’ বলে “এটা আমিই ইয়ে তোমাদের নিবেদন করছি”
“দ্যাখো আমাদের মানে পুরুষদের শরীরে দুটো সেক্স ক্রোমোজোম- একটা এক্স আর অন্যটা ওয়াই। আর মেয়েদের শরীরে যে দুটো থাকে দুটোই এক্স ক্রোমোজোম। পুরুষের বীর্য থেকে যদি ওয়াই ক্রোমোজোম নারীকে গর্ভবতী করে তাহলে নারীর এক্সের সঙ্গে মিশে ওটা এক্স ওয়াই হয়ে পুরুষ ছানা হবে আর পুরুষের এক্স ক্রোমোজোম নারীকে গর্ভবতী করলে দুটো এক্স ক্রোমোজোম মিলে একটা নারী ছানা তৈরি হবে। হোমোসেক্সুয়ালদের, সে ছেলেই হোক বা মেয়ে, তাদের ক্রোমোজোম এবং শারীরিক গঠন সম্পূর্ণ স্বাভাবিক হয়।”
“তাইলে??????” খাঁদুর চোখে মুখে বিষ্ময়,ভরা শ্রাবণের দিঘীর মতো, থৈথৈ করে।
“একটা ক্রোমোজোমের ভেতরে কয়েকশো, না না কয়েক হাজার, দুচ্ছাই মরুগ্গে… কোটি কোটি জিন থাকে। এরাই আমাদের সমস্ত শরীর, মন, যৌনতা, লম্বা, বেঁটে, হর্মোন-সব কন্ট্রোল করে। হয়তো যৌন মিলনকালীন বাবার শরীরের কোনও ওষুধের প্রভাব অথবা মায়ের শরীরে কোনও অবাঞ্ছিত ওষুধের প্রভাবেও এটা হয়। গর্ভবতী অবস্থায় মায়ের শরীরে হর্মোন ইত্যাদিদেরও কিছু ভূমিকা আছে। এটাকে বলা হয় ম্যাটার্নাল ইমিনাইজেশন হাইপোথিসিস। আবার কখনও পরিবেশের প্রভাবেও এটা হতে পারে।”
চাদোকানী হলে হবে কি স্বাধীন ব্যবসায়ী গোদুর পড়াশোনা আছে এবং বুদ্ধিও খুব সাফ। ও শুধায়
“পরিবেশের প্রভাব আবার কী?”
“একটা সমীক্ষায় দেখা গেছে- অনেকগুলো যমজ বাচ্চার ইতিহাস ঘেঁটে এই তথ্য বার করা হয়েছে। বিদেশে এসব হয়। এখানে গলা টিপে মেরেও ডেথ সার্টিফিকেট….”
“খুড়ো তুমি মেইন লাইন ছেড়ে কর্ড লাইনে চলে যাচ্ছো…” খাঁদুর চেতাবনি।
“হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ। তবে বলি। কিছু যমজ বাচ্চা স্বাভাবিক, মানে তথাকথিত স্বাভাবিক পরিবেশে বড়ো হয় আবার কিছু বাচ্চা সমলিঙ্গ আকৃষ্টদের মধ্যে বড়ো হয়। দেখা গেছে যারা সমলিঙ্গ আকৃষ্টদের মধ্যে বড়ো হয় তাদের মধ্যে সমলিঙ্গে আকর্ষণ বেশী হয়। তার মানে সামাজিক বাধ্যতা বা বিধি নিষেধ আমাদের সেক্সুয়াল বিহেভিয়ারকে কিছু দূর নিয়ন্ত্রণ করে।”
খাঁদু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। হয়তো হারিয়ে যাওয়া দাদাটার জন্যে। অথবা এমনিই।
তপ্পন ও উদাসী হয়ে বলতে থাকেন “যখন নারী কেবলমাত্র পুরুষে, এবং পুরুষ নারীতে আসক্ত তাদের স্ট্রেট বলা হয়। যখন নারী বা পুরুষ উভয় সেক্সে আকৃষ্ট হয় তখন হেটেরোসেক্সুয়াল বলা হয়। আর যখন কেবলমাত্র সমলিঙ্গে আকৃষ্ট হয়- তখন নারীকে লেসবিয়ান আর পুরুষকে গে বা হোমোসেক্সুয়াল বলা হয়। এছাড়া ঢের ঢের বিভাজন আছে। বাদ্দে ওসব কথা।” বলে গোদুর সিগারেটের ডিব্বা থেকে চারটে সিগারেট তুলে নিয়ে ফরাসি কিম্বা জাপানি কায়দায় বাও করে, অন্তিম কথাটি বলে বিদায় নিলেন
“আর আমি হলাম আসেক্সুয়াল। আমার কোনও যৌন আকাঙ্ক্ষা নেই। ভেনাস, অ্যাপোলো বা আফ্রোদিতি-আমি নির্বিকার। জিতেন্দ্রিয়।”