গত জুন মাসে চারজন পোলিও টিকাকর্মীকে আফগানিস্তানে বন্দুকবাজরা আলাদা আলাদা ঘটনায় গুলি করে খুন করে। সুধী পাঠক সত্যি করে বলুন তো খবরটা আপনার চোখে পড়েছিল? এর আগে ওই একই দেশে গত মার্চ মাসে তিন জন মহিলা স্বাস্থ্যকর্মীকে গুলি করে হত্যা করা হয়, তাদের অপরাধ-তারা পোলিও-র টিকা দিচ্ছিলেন। এই খবরটাও আমাদের দেশের কাগজের শিরোনামে আসেনি।
রাজনীতি পড়িনি পাঠ্য বই হিসেবে, পররাষ্ট্র-নীতি জানি না, কূটনীতিতো আরই বুঝিনা, কিন্তু জনস্বাস্থ্যের একজন সামান্য কর্মী হিসেবে এটুকু বুঝি যে পোলিও রোগটা দূর করতে হবে। আফগানিস্তানে এই বিষয়ে সবচেয়ে বড় অন্তরায়ের নাম “তালিবান”। নাঃ, বানিয়ে বলছি না, জাত ক্রোধ থেকে বলছি না, সাম্প্রদায়িক হয়ে বলছি না। এটা আমার কথা নয়। এটা বাস্তব। নিদারুণ বাস্তব।
“তালিবানি নিষেধাজ্ঞার জেরে আফগানিস্তানের বিস্তীর্ণ অন্ঞ্চল জুড়ে বাড়ি-থেকে-বাড়ি পালস পোলিও অভিযান করা যায় না যার ফলে বিরাট ফাঁক তৈরি হচ্ছে। প্রায় ৩.৩ মিলিয়ন বাচ্ছা ওই অঞ্চলে বসবাস করার ‘অপরাধ’-এ বার বার ওই পোলিও টিকা খাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।”
এর ফলাফল? ২০১৯ সালে ২৯টি পোলিও কেস হয় আফগানিস্তানে, যা আপাতদৃষ্টিতে তেমন কিছু মনে না হলেও ল্যানসেট-এর ভাষায় “ভয়াবহ” (ভারতে একটা কেস দেখা গেলেই “মহামারী” বলে ঘোষিত হবে)। এই বিপদ যে শুধু আফগান বাচ্চাদের, তা নয়, আফগানিস্তান-পাকিস্তানের এই পোলিও ছড়িয়ে পড়তে পারে সারা বিশ্বে। আমরা, যারা বছরের পর বছর খেটেখুটে ভারতকে “পোলিওমুক্ত” রাখছি, তাদের সব পরিশ্রম জলে যেতে পারে।
তালিবানদের এই অদ্ভুত আত্মঘাতী আচরণের পেছনে আছে তাদের প্যারানয়েড মানসিকতা। তারা মনে করে যে বাড়ি থেকে বাড়ি ওই টিকাকরণের নামে নাকি “সাম্রাজ্যবাদী” গুপ্তচরের দল গোপন তথ্য সংগ্রহ করবে। তাই তাদের ঢুকতে দেওয়া যাবে না।
জাবিউল্লা মুজাহিদ নামটা এখনো সুধী পাঠকের কাছে অচেনা ঠেকলেও অচিরেই পরিচিত হয়ে যাবেন কারণ তিনি তালিবানদের একজন নামকরা মুখপাত্র। গত বছর যখন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ১১২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের কোভ্যাক্স প্রোগ্রামের আওতায় কোভিভ টিকাকরণ করতে চায় তখন এই মুজাহিদ বিবৃতি দিয়েছিলেন যে, “তারা ওই কর্মসূচি সমর্থন করবেন এবং টিকাকরণ টিমকে তাদের বন্দুকের নিশানা বানাবেন না কারণ ওই টিম বাড়ি-থেকে-বাড়ি যাবে না, স্বাস্থ্যকেন্দ্রে বসেই টিকা দেবে।”
সুধী পাঠক, ভাবুন একবার, তালিবানরা ঠিক করে দেবে কোন টিকা দেয়া যাবে আর কোনটা নয়। আর ওদের কথা না শুনলে? কেন? বন্দুকের নিশানা হবেন জনস্বাস্থ্যের কর্মীরা। সোজা প্রশ্নের সোজা উত্তর। আসলে তালিবান কোনো গোষ্ঠীর নাম নয়, কোনো সম্প্রদায়ের নাম নয়। ওটা একটা অমানবিক, যুক্তিহীন, নির্বোধ, গা-জোয়ারী মানসিকতার নাম।
বাইরে থেকে সমাজতন্ত্র বা গণতন্ত্র আমদানি করে এই মানসিকতা বদলের অনেক চেষ্টাতো হল। লাভের লাভ কিছু হয় নি। আমি, আপনি এখানে বসে ওদের গালমন্দ করলে, শাপ-শাপান্ত করলে কিছুই হবে না। তাই বলে হতাশায় ভুগবেন না। দেশটা ওদের। পারলে ওদের দেশের মানুষই পারবেন পরিবর্তন আনতে।
আশার আলো দেখতে চাইলে ওই শহীদ হয়ে যাওয়া নেহাৎই সাধারণ জনস্বাস্থ্যের কর্মীদের দিকে তাকান একবার, যাঁরা সব জেনেশুনেও বিপদের ভয় তুচ্ছ করে, তালিবানি ফতোয়া অগ্রাহ্য করে, ওই টিকাকরণ কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছিলেন। এবং নেবেন। আবারও নেবেন। তাঁরা কেউ প্লেন ধরে পালিয়ে আসেন নি, প্লেনের টিকিট কেনার মতো সামর্থ্য নেই তাঁদের। মনে রাখবেন যে, ওই দেশটা শুধু তালিবানদের নয়, ওঁদেরও।
নাম না-জানা ওই সাতজন শহীদকে আমার প্রণাম, সেলাম, স্যালুট।