রাত আড়াইটার সময় মোবাইল বেজে উঠল তীব্র রিং টোনে। -“স্যার , একটা কাট থ্রোট ইনজুরি এসেছে।”
– “সে কী ? এই তো ঘন্টাখানেক আগে কথা হল তোর সঙ্গে!”
– না স্যার, আপনি এলে ভাল হয়। ঠিক ভরসা পাচ্ছি না। বাইশ বছরের ইয়ং ছেলে , প্রচুর ব্লিড করছে…”
ই এন টি র প্রফেসর ডাক্তার বোস তড়িঘড়ি মোবাইল রেখে মাস্ক, ক্যাপ নিয়ে দৌড়লেন। আর এম ও রাজু মুখার্জি ফোন করেছে মানে কেস জটিল। যেতেই হবে। রাজুর হাত খাসা। দারুণ সেলাই করে। তাড়াহুড়োয় ফেস শিল্ড নিতেই ভুলে গেছিলেন ডক্টর বোস। কোভিডের ধাক্বায় লিফট ব্যবহার বন্ধ করেছেন। বোতাম টেপাটেপি থেকে সংক্রমণ ছড়ানোর সম্ভাবনা। তাঁরা ফ্রন্টলাইন যোদ্ধা। নিজেদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে সমাজের জন্য । অগত্যা সাততলা কোয়ার্টার থেকে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আবার উপরে উঠতে হল জিনিসটা আনতে।
অন্য সময় রাতেও মেডিক্যাল কলেজের চত্বর গমগম করে। দূর দূর থেকে আসা রোগীদের আত্মীয়স্বজন,অ্যাম্বুল্যান্স ড্রাইভার, ওয়ার্ডমাস্টার , ইন্টার্ণ, হাউসস্টাফ, কেটলিতে করে চা নিয়ে ঘোরা হকার। করোনার জন্য ছবিটাই গিয়েছে বদলে। শুনশান হাসপাতাল চত্বর।গা ছমছমে । দূরে একটা রাতচরা পাখি টি টি করে ডাকছে।
পিপিই পরে অপারেশন থিয়েটারে ঢোকার সময়েই কানে এল আর্তনাদ। “আর বাঁচতে চাই না , ওফ , এবার মরতে দিন আমায়।”
আর এম ও রাজু প্রফেসরের চোখের দিকে তাকাল। “সুইসাইড অ্যাটেম্পট স্যার। পুলিশ কেস।”
রক্তে ভেসে যাচ্ছে গলা, বুক। ডক্টর বোস বুঝলেন এ সামান্য ইনজুরি নয়। বড় কোনও শিরা , ধমনী কেটেছে।
“পাড়ার লোক বলল, কাটারির কোপ। ইন্টারনাল জুগুলার গেছে বোধহয় স্যার।”
ওটি নার্স কল্পনা মিত্র উল্কার বেগে সেলাইয়ের সরঞ্জাম এগিয়ে দিচ্ছিলেন। প্রফেসর বললেন, “ট্র্যাকিওস্টোমি সেট দিন সিস্টার। ছোকরা গভীর ক্ষত করেছে শ্বাসনালীর।”
ছিন্নভিন্ন শিরা জোড়া দিতে দিতেই এক ঘন্টা। প্রচুর রক্তপাত হলে ক্ষতস্থানের কিচ্ছু দেখা যায় না। রোগীর পাড়ার লোকজন বেপাত্তা। অগত্যা ওয়ার্ড বয় দিলীপ নিজেই ছুটল রক্ত আনতে। ব্লাড ব্যাঙ্ক থেকে দু ইউনিট রক্ত না আনলে টগবগে ছেলেটা মরেই যাবে। ব্লিডিং নিয়ন্ত্রণে আসার পর আহত শ্বাসনালী মেরামত হল। বসল ট্র্যাকিয়োস্টমি টিউব । সেলাইয়ের শেষ ফোঁড় দিয়ে যখন ওঁরা বেরোচ্ছেন, পুবের আকাশ লাল। সাড়ে চারটে। ক্লান্ত দিলীপ ঘুমিয়ে পড়েছে ট্রলির উপর।
ডক্টর বোস তৃপ্ত। যাক একটা প্রাণ বাঁচল।এবার কোয়ার্টারে ফিরে স্নান টান করে একটা ঘুম দিতে হবে।
বেলার দিকে রাউন্ডে এসে দেখতে পেলেন ফ্যালফ্যাল করে ওয়ার্ডের ছাদে তাকিয়ে আছে রোগী। রাজু হাসল। “স্টেবল আছে স্যার। আশা করছি চব্বিশ ঘন্টা পর ট্র্যাকিয়োস্টমি টিউব খুলে দিতে পারব।”
কিন্তু রোগী বোধহয় কিছু বলতে চায়। ডক্টর বোস এমন বহু ঘটনার সাক্ষী। শ্বাসনালীর সার্জারি হলে কথা বলার ক্ষমতা চলে যায়। স্বভাবতই মানুষ অবসাদে ভেঙে পড়েন। দ্রুত টিউবের মুখ চেপে ধরলেন তিনি।
“এবার বলো, কী বলতে চাও।”
“বলছি, বাঁচালেন কেন আমায়, হ্যাঁ? ঘরে মায়ের সুগার, বাবার হাঁপানি। একটা বড় শপিং মলে সিকিউরিটির কাজ করতাম, জানেন?” রোগী হাঁফিয়ে উঠেছে। উত্তেজিত হলে খারাপ। রাজু শান্ত করার চেষ্টা করল।
“চাকরিটা নেই!” ছেলেটা কঁকিয়ে উঠল ফ্যাঁসফেসে গলায়, “আওয়াজ ফিরে পেয়ে লাভ কী! আমাদের কথা কেউ শুনবে?”
ড্রিপ দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত ঢুকছে। সেদিকে তাকিয়ে ছেলেটা হাহাকার করে উঠল, “একমাস মা বাবার ওষুধ কিনতে পারিনি। ঘরে খাবার নেই।”
“ঠিক আছে। এখন শান্ত হও। সেলাই খুলে গেলে ফের ব্লিডিং হবে।”
“খুলুক। তার থেকে পেটে কিছু দিন আমাদের। এইভাবে জোড়াতালি দিয়ে বেঁচে কী লাভ!”
ইলেকট্রিক শক খাওয়ার মতো হাত ছিটকে এল ডক্টর বোসের। নিজের গলাটাই কেমন চোকড হয়ে যাচ্ছে। কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলছেন।
কে যেন শক্তহাতে গলা চেপে ধরেছে। কে?
এ হাহাকার ও মহামারীর মতো ছড়িয়ে পড়ছে…….
বাঁচা আর মরা, মাঝখানে জীবন। জীবনের জন্য নানা জৈবিক চাহিদার অন্যতম ক্ষিদে।
খুব স্পর্শ করা একটা লেখা। এটা গল্প আবার কবিতাও বটে, অনেকটা hungry generation type. অনেক অভিনন্দন ডক্টর দোলনচাঁপাকে আর অপেক্ষা থাকলো ওনার পরবর্তী লেখার।