নতুন বাড়িটা পান্তুর মোটেই পছন্দ হলো না। শুধু বাড়ি কেন, শহরটাই না। কেমন ভালো ছিল উজানগড়ে! চারিদিক ফাঁকা-ফাঁকা, উঁচু-নিচু পাহাড়-টিলা, তার নিচে ওদের টাউনশিপের বাড়ি। চারিদিকে বাগান। অবশ্য ওদের বাড়িতে বাগান ছিল না, জঙ্গল ছিল — সেটা ওর আরও ভালো লাগত। মা বাবার লাগত না। দু’জনের কেউই বাগান-টাগান করত না। ওদের আগে যারা ছিল, তাদের বাগান ছিল। ওদের মালি এসেছিল শুরুতে। জানতে চেয়েছিল বাগান করতে চায় কি না। হাত দিয়ে দেখিয়েছিল, আশেপাশের বাড়িগুলোর কোনগুলোতে ও বাগান করে দেয়। মা বলেছিল, “চাই না।” বলেছিল, “আমরা চলা যায়েগা, বেশিদিন থাকেগা নেহি। তাই বাগান-টাগান চাই না।”
পান্তুর খুব ভালো লাগত বাগানটা। চারিদিকে জঙ্গুলে গাছপালা, ঘাস আর ঝোপ — বাড়ি থেকে দু’পা যেতে-না-যেতেই কেমন নিরুদ্দেশের পাড়া। মা চেঁচাত, “পান্তু, যাস না দূরে। চারিপাশে জঙ্গল, কী না কী আছে — সাপ-খোপ, বিছে-নেউল, কে জানে, লেপার্ডও থাকতে পারে।” তা পারে, কিন্তু পান্তু ভয় পায় না। ও চিড়িয়াখানায় লেপার্ড দেখেছে। বেড়াল-বেড়াল দেখতে। ভয়ের কিচ্ছু নেই। তবে মার কাছে শুনে শুনে কাজের মাসি বুদবুদিয়াকে জিজ্ঞেস করেছিল। বুদবুদিয়া তো হেসে অস্থির। বলেছিল, “লেপার্ড-উপার্ড কুছ নেহি… সব সাহাব লোগ কব মার দিয়া।”
তবে বলেছিল, সাপ আছে। সাবধানে চলাফেরা করতে। “ডঁস লেগা,” বলে ভয় দেখিয়েছিল। সাপ দেখেনি পান্তু। খুঁজেছিল, কিন্তু পায়নি। বেজি দেখেছিল একবার। আর অনেক গিরগিটি। ওরা ডেবডেবিয়ে পান্তুকে দেখত দূর থেকে। কাছে গেলেই পালাত।
তবু, সব মিলিয়ে ওখানটাই ভালো ছিল। একতলা লম্বা বাড়িওয়ালা স্কুলটা ভালো ছিল, নিজে নিজে স্কুলে যাওয়া-আসা ভালো ছিল, পাড়ার প্রায় সব বন্ধুই স্কুলের বন্ধু ছিল — তাই খেলা থামত না কখনওই — সেটাও ভালো ছিল। বন্ধুদের মা-বাবারা কাজের পরে একসঙ্গে আড্ডা দিত, গল্প করত — সেটা ভালো ছিল, কারণ তাহলে ওরাও আবার একসঙ্গে খেলতে পারত। ছুটির দিনে দুপুর বেলা একা একা পাহাড়ে ঘোরা ভালো ছিল, রাত্তিরে পাহাড়ি ঠাণ্ডায় লেপের নিচে ওমের মধ্যে শুয়ে রুম হিটারের লাল তারটা দেখা ভালো ছিল। সব ভালো ছিল, সব ভালো ছিল, সব, সব সব।
মা’র ভালো লাগত না, বাজার হাট নেই, শপিং মল নেই, একটা মাত্র সিনেমা হল, তাতে কী সব সিনেমা হয়… বাবার কাছে গজগজ করত, “বাবা গো বাবা! একটু কথা বলারও কেউ নেই…” পান্তুর অবাক লাগত। এই তো সারা সন্ধে পুতুল মাসি, নিভা মাসি, অলকা মাসিদের সঙ্গে গল্প করে এল। তখন তো কেমন হাসছিল। এখন কেন এরকম বলছে?
বাবা বলত, “আরে ক’টা দিনের ব্যাপার। দেখোই না। এর মধ্যে তো চলে যাব।”
তবে মজা হয়েছিল। এর মধ্যে চলে যায়নি বাবা। রেগে রেগে মা’কে বলেছিল, “চার মাসের লিয়েনে গিয়ে ফট্ করে রেজিগনেশন দিয়ে দিল। এখন আমাকেই চালাতে হবে।”
মা-ও রেগে গেছিল। বলেছিল, “আমি পান্তুকে নিয়ে চলে যাব তবে।” বাবাও বলে দিয়েছিল। “যাও গে…” তবে মা শেষ অবধি যায়নি। রয়ে গেছিল। পান্তুও।
তাই শেষ পর্যন্ত শহরে ফিরতে পেরে মা-বাবা খুব আনন্দ পেয়েছিল। আর পান্তুর দুঃখ হয়েছিল। এক সপ্তাহ মাত্র সময় পেয়েছিল টা-টা বলার। তাই প্রথম দিনই দুপুরবেলা মা যখন ঘুমিয়েছিল তখন উঠেছিল বাড়ির পেছনের টিলায়। একেবারে মাথায় একটা পাথরের মাঝখানে বোরাম গাছটা তখন একা একা দাঁড়িয়েছিল দুপুরের রোদে। বুদবুদিয়ার ছেলে ছৈনা ওকে দেখিয়েছিল। বলেছিল, এটা গাছ নয়। “দেখেছিস, কেমন পাথর ফাটিয়ে বেরিয়েছে? এ বোরামবুরু। আমাদের দেওতা। একে পুজো করি।” এখানে জুতো পরে আসা বারণ। গাছের নিচে, চারিপাশের পাথরে লাল লাল সিঁদুরের দাগ। ছৈনা বলেছিল ওখানে আগে বলি হত। ছাগল, ভেড়া, মোষ। এখন শুধু সিঁদুর লাগানো হয় বোরামবুরুর পুজোর দিনে। অন্য সময়ে ওখানে কেউ যায় না।
পান্তু যেত। ওখানে গিয়ে ও একা একা বোরামবুরুর সঙ্গে কথা বলত। গাছটাও ডালপালা নেড়ে পাতা ঝাঁকিয়ে উত্তর দিত। পান্তুর ওর সব দুঃখের কথা, আনন্দের কথা, স্কুলের কথা, বাড়ির কথা… মা-বাবার ঝগড়ার কথা — সব বলত বোরামবুরুর কাছে। বোরামবুরু ডালপালা নেড়ে ওকে বুঝিয়ে দিত, এ সব কোনও ব্যাপারই নয়। এমন সবার হয়ে থাকে, কিন্তু তাতে দুঃখ পাবার কিছু নেই। বিকেল পড়ে এলে পান্তু আবার নেমে আসত, তখন ওর আর দুঃখ থাকত না।
সেদিন যখন গিয়ে বোরামবুরুকে বলল, “আমি এবারে চলে যাব, আর আসব না…” তখন বোরামবুরু চুপ করে ছিল। ডালপালাও নাড়েনি, পাতাও ঝাঁকায়নি। পান্তু বলেছিল, “এবারে আমাকে শহরের স্কুলে ভর্তি হতে হবে। মা বলেছে ওখানে নতুন কোয়ার্টার পাবে বাবা। ফ্ল্যাটবাড়ি। তুমি ফ্ল্যাটবাড়ি দেখেছ?” তখনও বোরামবুরু উত্তর দেয়নি। নিস্তেজ হাওয়ায় ওর ডালপালা নড়েনি। পাতাগুলোও চুপ করে ছিল। কিন্তু পান্তু যখন আবার ফিরবে, ঠিক তখনই একটা পাতা খসে পড়েছিল ঠিক পান্তুর মাথায়, সেখান থেকে ওর কাঁধে। পান্তু পাতাটা হাতে নিয়ে ওপরে তাকিয়েছিল। কেউ কোত্থাও নেই। একটা পাখিও না। পান্তু পাতাটা পকেটে রাখার আগে গাছতলার লাল সিঁদুর ঘষে লাগিয়ে নিয়েছিল একটু। বোরামবুরু দিয়েছে। পাতাটা এখন পান্তুর খাতার মধ্যে রাখে। সাবধানে। মা দেখতে পেলে, “এ আবার কী…” বলে ফেলে দেবে।
শহরের ফ্ল্যাটটা মার খুব পছন্দ। বলে, “কেমন কম্প্যাক্ট। ডাইনিং-কাম-কিচেন। রান্না করে ও-ও-ও-ই দূর থেকে খাবার টেবিলে আনতে হয় না। দুটো ব্যালকনি। কাপড় মেলতে সুবিধে।” কিন্তু পান্তু ভাবে, ভালো না। ওপরে নিচে লোক, দরজা খুললে ওপাশে আর একটা ফ্ল্যাট, তাতেও কারা থাকে। পচা পচা পচা।
মা খুব খুশি। এখানে শপিং মল, মাল্টিপ্লেক্স, ক্যাফে, টি-হাউস। বন্ধু-বান্ধব। পান্তুর বড়ো স্কুল। বাবাও খুশি। প্রোমোশন হয়েছে। এখানে দুর্গাপুজোয় বেশি মজা। উজানগড়ের মতো গেঁয়ো গেঁয়ো পুজো নয়।
পান্তুর ঘরের জানলার বাইরে একটা বড়ো গাছ। শিমূল। মা বলেছে, শীতের শেষে লাল লাল ফুল হবে। তারপরে যখন কালবৈশাখী আসবে, তখন ফল ফেটে সাদা সাদা তুলো উড়বে চারিদিকে। কিন্তু পান্তু ওটাকে শিমূল গাছ ভাবতে পারে না। ওটা বোরাম গাছ। ও যখন রাতে শুতে যায়, তখন খাতা থেকে পাতাটা বের করে বোরামবুরুর সঙ্গে কথা বলে। তারপরে, রাতে যখন ও ঘুমোয়, তখন জানলার বাইরের গাছটা বোরাম গাছ হয়ে যায়। ওর পায়ের কাছে একটা ফাটা পাথর। ওর মাথার ওপরে নীল আকাশ। ডালপালা নেড়ে, পাতা ঝাঁকিয়ে পান্তুর সব কথার উত্তর দেয় বরামবুরু। পান্তু স্বপ্নে শোনে বোরামবুরুর কথা।
পান্তু বড়ো হয়ে বোরামবুরুর কাছে চলে যাবে। এই পচা শহরে ও থাকবেই না।