লোকজন এতরকমের খাদ্যবস্তু নিয়ে এত এত কথা লেখে – বিরিয়ানি কাবাব কষা-মাংস থেকে শুরু করে পান্তাভাত খিচুড়ি অবধি – আর ফুড-ভ্লগারদের দাপটে তো ফেসবুক-জীবন বিষময় হয়ে ওঠার জোগাড় – কিন্তু আমার মতো পাব্লিকের জীবনে খাদ্যবস্তু হিসেবে যেটি প্রায় অপরিহার্য, তা নিয়ে কাউকে কখনোই লিখতে দেখি না। সে যেন খাদ্যসাহিত্যে উপেক্ষিতা হয়েই রয়ে গিয়েছে।
হ্যাঁ, বিস্কুটের কথা বলছি।
যা নিয়ে আমার বউ বন্ধুদের সামনে প্রায়শই আমায় অপদস্থ করার চেষ্টা করে। বিষাণ তো চায়ের সঙ্গে বিস্কুট খায় না, বিস্কুটের সঙ্গে চা খায়। অথবা, শুধু বিস্কুট খেয়েই যে ফিগারের মোটাভাব ধরে রাখা যায়, তা বিষাণকে না দেখলে জানতে পারতাম না। ইত্যাদি প্রভৃতি। অবশ্য পরম কল্যাণময় সৃষ্টিকর্তা অনুভূমিক সরলরেখা বরাবর দুটি কান দিয়েছেন – এসব কথা এক কান দিয়ে ঢুকলেও আরেক কান দিয়ে বেরিয়ে যেতে সময় লাগে না।
তো যেকথা বলছিলাম, বিস্কুট আমার জীবনের অপরিহার্য অঙ্গ। এবং চায়ের দোকানের বেকারির বিস্কুট থেকে শুরু করে মহার্ঘ্য কুকিজ – কাউকেই আমি তুচ্ছ জ্ঞান করি না। যদিও (আমার মনে হয়, অধিকাংশ বিস্কুট-প্রেমীই এব্যাপারে আমার সঙ্গে সহমত হবেন) আমার পক্ষপাত মিষ্টি বিস্কুটের প্রতি। চিনি-ছড়ানো নাইস থেকে কাজু-মেশানো গুড ডে – আর ক্রিম-বিস্কুটের বিপুল সম্ভার তো আছেই – কিংবা করাচি বেকারির ক্যাশিউ কুকিজ থেকে অ্যামন্ড বিসকটি – লিখতে গিয়েই মনটা আর্দ্র হয়ে উঠছে।
আজকাল আর আগের মতো করে বিস্কুট খাওয়া হয় না। যেমন ধরুন, হাউসস্টাফশিপ করার সময়, হস্টেল-জীবনে, অনেকসময় লাঞ্চ সারতাম স্রেফ বিস্কুট খেয়ে। আপনাদের মনে আছে কিনা জানি না, সেসময় ক্যালকাটা নাস্তা নামে একরকম বিস্কুট পাওয়া যেত। মুনমুন সেন তাঁর অননুকরণীয় বাচনভঙ্গির মাধ্যমে (অননুকরণীয় বলছি বটে, কিন্তু ‘গিলি গিলি গে’ ছবিতে শ্রীলা মজুমদার প্রায় একই স্টাইলে সংলাপ বলেছিলেন) সেই বিস্কুটের বিজ্ঞাপন করতেন। তো ক্যালকাটা নাস্তা বিক্রি হতো চারশ গ্রামের বড় প্যাকেটে। প্রায়শই এমন হত, যে দুপুরবেলা হস্টেল ফেরার পথে সেই প্যাকেট কিনে সন্ধের মধ্যে ফুরিয়ে গিয়েছে। ক্যান্টিনের অশোকদা অবাক হয়ে মনে করাতেন, মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগেই আমি বিস্কুট কিনেছি – বাধ্য হয়ে মিথ্যে বলতে হতো, যে, প্যাকেটটা সম্ভবত কোথাও একটা ফেলে এসেছি। এছাড়া, ওইসময়, প্রিয়া কোম্পানির বাটার বাইট (নাকি বাটার গোল্ড?) নামে একরকম বিস্কুটের দিকেও আমার নজর ছিল। এক গ্লাস চা, সঙ্গে বাটার বাইট নিয়ে বসলে পনের-কুড়িখানা বিস্কুট, চায়ে ডুবিয়ে, কোনও ব্যাপারই নয়। সেরকম স্কেলে আর বিস্কুট খেয়ে উঠতে পারি না।
বছরকয়েক আগে, চাকরিজীবনে বাঁকুড়ায় থাকাকালীন, বিস্কুট খাওয়ার একটা অন্যরকম অভ্যেস তৈরি করেছিলাম। বন্ধুরা মিলে মেস করে থাকতাম। রাত্তিরের মেনু, ব্যতিক্রমী দিন বাদে, পরোটা মাংস। দশটা-সাড়ে দশটা নাগাদ খাওয়া শেষ। বারোটা-সাড়ে বারোটা নাগাদ কফি। আড়াইটে-তিনটে নাগাদ শুতে যাওয়া। এরই মধ্যে দেড়টা নাগাদ বিস্কুট। জিমজ্যাম। বড় প্যাকেট কেনা হতো সন্ধেবেলা। আমি আর তন্ময় – দুটো দুটো করে খেতে শুরু করতাম। দুজনেই স্থূলকায়। অতএব, বিস্কুট, বিশেষত ক্রিমবিস্কুট খাওয়াটা যে স্বাস্থ্যের পক্ষে ভালো নয়, সেটুকু জানতাম। মাঝপথে বলতাম – বুঝলি তো, এরকম করে বিস্কুট খাওয়াটা ভালো ব্যাপার নয়। তন্ময়ও সহমত হতো – হ্যাঁ, দাদা, ঠিকই। তখন – তাহলে কিন্তু মনে রাখিস, শত্রুর শেষ রাখতে নেই। অতএব, প্যাকেট চটজলদি শেষ হয়ে যেত। আবারও আশ্বস্ত করি, এখন আর অত বিস্কুট খাওয়া হয় না।
তো যেকথা বলতে গিয়ে আটভাট বকে বেলাইনে চলে গেলাম, সেকথায় ফিরি। বিস্কুট নিয়ে কেউই বেশি কথা বলেন না। কুকিজ ইত্যাদি গুরুগম্ভীর মহার্ঘ্য বস্তু নিয়ে দু’চারকথা বললেও, পাড়ার দোকানে পাওয়া যায় এমন প্যাকেটের বিস্কুটের কথা কারও লেখায় দেখি না। অবশ্য লিখবেই বা কী! সত্যি বলতে, সেই ছেলেবেলা থেকে বিস্কুট খেয়ে আসছি, নতুন ভেরিয়েশন আর কতটুকু! তিন-চারদশক জুড়ে নতুন নতুন কোম্পানি এলেও প্যাকেটের ভেতরের মাল প্রায় একই। থিন অ্যারারুট মেরি (মারী) নাইস গুড-ডে-র প্রকারভেদ। ক্রিম বিস্কুট বলতে চকোলেট ক্রিমই মূলত – দুটো বিস্কুটের মাঝখানেই হোক (বার্বান ইত্যাদি) বা বিস্কুটের মধ্যে (ডার্ক ফ্যান্টাসি চকোফিলস)! অরেঞ্জ-ক্রিম, একদা যা অতি-সুলভ ছিল, এখন হারিয়েই গিয়েছে। এছাড়া ক্রিম-ক্র্যাকারে জিরে মেশানো, নোনতা বিস্কুটে চিনি ছড়ানো – ভেরিয়েশন বলতে এই। আরও কিছু অখাদ্য-কুখাদ্য প্রয়াসও ঘটেছে – যেমন নোনতা বিস্কুটের মাঝে মিষ্টি ক্রিম ঢুকিয়ে পাইন্যাপল/লেমন ক্রিম – সেসবের কথা আর বলছি না।
এসব হাজারো হাবিজাবির মধ্যে গত কয়েক দশকে মনে রাখার মতো অভিনবত্ব বলতে একটিই। জিমজ্যাম। ক্রিম বিস্কুটের ঠিক বাইরে একটুখানি চিটচিটে জেলি লাগিয়ে দেওয়া – সত্যিই সৃষ্টিশীল ভাবনা। অসাধারণ!! এর কাছাকাছি আসার মতো উদ্ভাবন বিস্কুটের জগতে গত কয়েক দশকে ঘটেনি। সুদূর দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে থাকার দাবিদার – সে দুটিই বিস্ক ফার্মের – ইংলিশ ক্র্যাকার এবং চিজ ক্রিম। বিশেষত এই শেষেরটি। নোনতা বিস্কুটের মধ্যে ক্রিম ভরতে গেলে মিষ্টির পরিমাপ ঠিক কতখানি (বা কতটুকু) হওয়া উচিত, তা চিজ ক্রিম দেখে শেখা যায়।
তো অনেকদিন বাদে ব্রিটানিয়া নতুন একধরনের ক্রিম বিস্কুট – নতুন বলতে সত্যিই নতুন – নিয়ে এলো, যেটা খেয়ে চমকে উঠলাম। চমকে উঠলাম শব্দবন্ধটি অবিমিশ্র প্রশংসা হিসেবে না-ও নিতে পারেন – তবে, প্রচেষ্টা হিসেবে বিস্কুটটা সত্যিই অভিনব। চিলি গুয়াভা ক্রিম। শুনলেই কেমন ইয়ে লাগছে তো?? মনে হচ্ছে, রোক্কে করো রগুবীর!! খেয়ে দেখুন। পাকা পেয়ারার স্বাদ চমৎকারভাবে এসেছে। সে স্বাদ বিস্কুটে মানায় কি মানায় না, তা একবারেই বলা সম্ভব নয় – তবে খেয়ে অবাক হবেন নিশ্চিত। মিষ্টির পরিমাপ এক্কেবারে যথাযথ। এই বিস্কুট বাজারে চলবে কিনা – পাব্লিক খাবে কিনা – সেসব এখনই বলা মুশকিল, কিন্তু আপনি চট করে অন্তত একবার খেয়ে দেখতে পারেন। খেয়ে বিরক্ত হবেন, এমন না হওয়ারই কথা।
পুনঃ- বিস্কুট-কে যে ‘শিক্ষিত’-রা বিস্কিট বলে, এটুকু আমিও শুনেছি।