খবরটা আপাতদৃষ্টিতে এতই তুচ্ছ যে কোনো কাগজে কোনোদিন প্রকাশিত হবে না। তাই লেখার শেষ লাইনেই দিলাম। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে গেল যে একযুগ আগে স্বাস্থ্য দপ্তর রাজ্যের সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবার হাল হকিকত জানতে একটি পেশাদারি বেসরকারি সংস্থাকে দিয়ে একটি পেশেন্ট স্যাটিসফ্যাকশন সার্ভে বা রুগীর সন্তুষ্টিবিধান নিয়ে একটি সমীক্ষা করায়। সেই সমীক্ষার ফলাফল নিয়ে উচ্চ পর্যায়ের আধিকারিক ও আমলাদের একটি আলোচনা সভার সময়ে ওই সমীক্ষাটি তাদের সামনে সংক্ষিপ্তভাবে রাখার দায়িত্বে ছিলাম। সেই সময়ে ওই সমীক্ষার ফলাফলের একটি অংশ দেখে অবাক হয়ে যাই। ওই সংস্থার একজন কর্মচারীকে ডেকে পাঠিয়ে নিজের অসন্তোষ প্রকাশ করি। এও বলি যে, “আমার সন্দেহ সমীক্ষাটা হাসপাতালে না গিয়ে বাড়িতে বসে হয়েছে।”
সেই পেশাদারি সংস্থার তরুণ কর্মীটি আমার কথায় রীতিমত আহত ও অপমানিত বোধ করে এবং তর্কাতর্কির মাঝে আমাকে চ্যালেঞ্জ করে বলে যে সমীক্ষাটি বৈজ্ঞানিক সমস্ত নিয়ম মেনে পেশাদারি নিষ্ঠা আর সততার সাথে করা হয়েছে, প্রয়োজন হলে সে আবার আমার সামনে করতে প্রস্তুত। ফলাফলটা এমনই অবিশ্বাস্য ছিল যে আমার বস আবার একটা ছোট মাপের সমীক্ষা করাতে রাজি হয়ে যান। শর্ত একটাই, একই পদ্ধতিতে করতে হবে এবং আমাকে নিজেই করতে হবে।
অগত্যা ট্রেনে চেপে পাঁচ ঘন্টার যাত্রা শেষে পৌঁছে গেলাম বাংলার পশ্চিম প্রান্তের সেই দরিদ্র জেলাটির জেলা সদরে, সদর হাসপাতালে। শুরু করলাম সমীক্ষা।
যে ধরণের ডাটা বা তথ্যকে সংখ্যায় প্রকাশ করা মুশকিল সেই ধরণের তথ্য নিয়ে গবেষণা বা কোয়ালিটটিভ স্টাডির সময় লাইকার্ট সাহেবের তৈরি করা স্কেল কাজে লাগানো হয়। একটা উদাহরণ দিলাম। ধরুন আপনি একটা এড ফিল্ম বানিয়েছেন ওটা লোক কে দেখানোর আগে এড এজেন্সির মালিক জানতে চাইলো যে ফিল্মটা কেমন হয়েছে। ধরুন একশ জন মানুষ কে বেছে নেওয়া হল। এই একশ হল স্যাম্পেল সাইজ। এই একশ জনকে বেছে নেবার পদ্ধতি বা স্যাম্পলিং মেথড কিন্তু এমন হতে হবে যাতে তাতে সমাজের সকল শ্রেণী, লিঙ্গের ইত্যাদিএর একটা প্রতিনিধিত্বমূলক ব্যাপার থাকে। নইলে ওটা একপেশে বা বায়াসড হয়ে যাবে। ওই একশ জনই যদি কফি হাউস বা খালাসিটলার থেকে বেছে নেওয়া হয় তাহলে ওটা বায়াসড। এতো সব না করে অবশ্য আপনি আপনার বন্ধু বান্ধব আত্মীয় স্বজন মানে আপনার কাছের লোক এরকম একশ জনকে বাড়িতে নেমন্তন্ন করে ডেকে ওই ছবিটা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করতে পারেন কেমন লাগলো।
এবার লাইকার্ট স্কেল। ছবিটা কেমন লেগেছে এটা পাঁচটা মাত্রা (বা ফাইভ পয়েন্ট স্কেল) এ এরকম হতে পারে: খুব ভাল, ভালো, চলনসই, খারাপ, খুব খারাপ। অর্থাৎ মাঝারিটা স্কেলের মধ্যি খানে আর দুই পাশে দু পয়েন্ট করে খারাপ/ ভাল। একশ জন কে জিজ্ঞেস করলে কেউ খারাপ কেউ চলনসই আবার কেউ ভালো বলবে। এইভাবে সংগৃহীত ডাটা থেকে আপনি এক বা একাধিক সিদ্ধান্তে আসতে পারবেন। যেমন মোটের ওপর বেশিরভাগ মানুষ ভালো বললো না খারাপ। করা বেশি ভালো বললো মেয়েরা না ছেলেরা, ধনী রা না গরিব রা, শিক্ষিত না মূর্খ রা ইত্যাদি। ঠিক এই লাইকার্ট স্কেল ধরে সমীক্ষা করে ফিরে এলাম সার্কিট হাউসে। ঐটা করার সময়েই টের পেয়েছিলাম। রাতে ল্যাপটপে ডাটা ভরে এনালাইসিস করতে গিয়ে ঝটকাটা আবার নতুন করে খেলাম। সেই অবিশ্বাস্য ফলাফলের পুনরাবৃত্তি। অনেক রাত হয়ে যাওয়া স্বত্তেও সেই বেসরকারি সংস্থার তরুণ কর্মীটিকে ফোনে ধরলাম। অকপটে ক্ষমা চাইলাম।
সারা রাত্তির ঘুম এলো না। এ কেমন করে হতে পারে। আমি নিজে খেয়ে দেখেছি সেই হাসপাতালের রুগীর ডায়েট বা পথ্য। ট্যালটেলে ডাল, মোটা চালের ভাত, আলু কুমড়োর ছোলার প্রায় তেল বিহীন একটা ঘাঁটা, সবচেয়ে ছোট মাপের একটুকরো ডিম আর তার ঝোল। ওই খাবার এর দু মুঠোর বেশি খেতে পারিনি। বিস্বাদ, পানসে, তেতো। সেই খাবারকে ৩০% রুগী বলছে খুব ভালো, ৪০% বলছে ভালো, ২০ শতাংশ বলছে মন্দ নই, আর মাত্র ১০% বলছে খারাপ। খুব খারাপ বলার মতো কেউ নেই। অবিশ্বাস্য।
লাইকার্ট স্কেলের সমীক্ষায় সব কিছু ধরা পরে না। তাই পরের দিন সকালে ফিরে গেলাম। এই ধাঁধার উত্তর আমাকে পেতেই হবে। অধিত বিদ্যা যা জানতাম প্রয়োগ করে এবার এফজিডি। ফোকাসড গ্রূপ ডিসকাশন। সেদিন সন্ধ্যায় এক্সপ্রেস ট্রেনে কলকাতা ফেরার সময় ভাবছিলাম। ট্রেনের দরজায় দাঁড়িয়ে দেখছিলাম দূরের জমাট বাঁধা অন্ধকারের মধ্যে ছোট ছোট টিলা পাহাড়গুলো কেমন করে একের পর এক অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছিল। স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র ধারী এক আধাসামরিক বাহিনীর জওয়ানের বকুনিতে দরজা ছেড়ে নিজের সিটে গিয়ে বসলাম। “স্যার ইয়ে বহুত খতরনাক ইলাকা হ্যায়, টেরোরিস্ট লোগো কা ইলাকা। যারা বাঁচকে”। একটি সিগারেট বিনিময়ের বদলে জুটলো একটি “থ্যাংক ইউ স্যার।”
স্বাধীনতার এত বছর বাদে যারা দুবেলা পেট ভরে খেতে পায় না, অখাদ্য কুখাদ্য খেয়ে পেট ভরাতে হয়, সেই সব মানুষরা যখন রুগী হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়, তাদের কাছে সেই খাবারই অমৃত মনে হয়। যে খাবারে আমার পরিমার্জিত, পরিশীলিত রসনা ঘৃনাভরে পরিত্যাগ করে, সেটাই তারা তৃপ্তি সহকারে খাচ্ছে। তাই ওই অবিশ্বাস্য ফলাফল। ট্রেনের গতি বাড়তে থাকে, অন্ধকার কমতে থাকে। এগিয়ে আসতে থাকে আলো ঝলমল মহানগরী। এসে দাঁড়ায় প্ল্যাটফর্ম এ। আরপিএফ এর সেই তরুন জওয়ানটি, আমার সিগারেট বিনিময়ের ঘন্টা কয়েক এর সঙ্গী, একটি ছদ্ম স্যালুট শেষে মিলিয়ে গেল। আমি প্রি পেড ট্যাক্সির লাইনে।
কানে খালি বেজে রইল ওই কথা গুলি। “বহুত খতরনাক” । আধপেটা, নিরন্ন কিছু মানুষ যারা আমার যাবতীয় বিদ্যাবুদ্ধি কে ঘোল খাইয়ে, লাইকার্ট স্কেল এর সত্যনাশ করে দিয়েছিল সেই “খতরনাক” লোকগুলোর কথা ভাবতে ভাবতে পেরিয়ে যাচ্ছি আলো দিয়ে সাজানো দ্বিতীয় হুগলি সেতু, ভিকটোরিয়া, রবীন্দ্রসদন, নন্দন …….
মিশিগান শহরের রেনসিস লাইকার্ট সাহেব, এবারের মতো ক্ষমা করে দেবেন স্যার। আবার আপনার কথা মনে পড়ে গেল। আমাদের জেলার একটি গ্রামীণ হাসপাতালে নব নিযুক্ত ব্লক মেডিক্যাল অফিসার অফ হেলথ এর উদ্যোগে চালু হল রোগীদের জন্য ডায়েট। সেই পথ্য পেয়ে রুগীর মুখে হাসি। আমার দেশের মানুষ এখনো কি অল্প চাওয়া পাওয়াতে খুশি হয়! তরুণ সহকর্মী বিএমওএইচ ডা: পাপিয়া রায় চৌধুরী এমডি কে অনেক আশীর্বাদ এই হাসি ফোটানোর জন্য।
♥️♥️🙏🙏💐👍
কিছু বলার নেই। Excellent লেখা।
পুরো রুদ্ধ শ্বাস ছবি লেখা।বুঝলে ডক্টর সাব।