“অকালবোধনের আলোয় আলোয় ভেসে যাচ্ছে গ্রাম নগর মাঠ প্রান্তর । রাতের অন্ধকার কবে যেন ঘুচে গেছে, …আকাশে আলোর সুর …তিলোত্তমা তোমার জন্য গণবিস্ফোরণ…পাড়ায় পাড়ায় মহল্লায়… দুশ্চিন্তার রাত দখল করে নেয় ঘর সংসারের এলোপাথাড়ি মেয়েরা … we want justice- …ঘরে বাইরে কর্মক্ষেত্রে, রাস্তায়, সম্পর্কে, ভাবনায় আর কতদিন চলবে এই অবিচারের স্রোত … ভেতরের গর্জন রাতের অন্ধকার কে ছিঁড়ে ফালা ফালা করে দিল। কোন মাইক লাগল না, কোন পার্টির ব্যানার লাগল না, শুধু অজস্র নির্যাতিতার কণ্ঠস্বর সম্বল করে এগিয়ে চলল আলোকযাত্রা । শিলিগুড়ি থেকে শ্যামবাজার , হায়দ্রাবাদ থেকে পুনে, নিউ জার্সি থেকে কিংস্টন টাউনশিপ।“–সুতপা ভট্টাচার্য চক্রবর্তী, নিৰ্বাচিত গল্পগুচ্ছ, দ্বিতীয় খন্ড (দ্রোহকাল পর্ব)
১৪ অগাস্ট ঐতিহাসিক রাতদখল। পথে নামে প্রায় গোটা দেশ । রোম, ফ্রাঙ্কফুর্ট, লিডস বা আমেরিকার ফিলাডেলফিয়ার আন্দোলনের অনুপ্রেরণায় বাংলায় বহমান আন্দোলনে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে ‘Reclaim the Night, Reclaim the Right’। রাত দখলের রাত থেকে শুরু করে অগাস্ট, সেপ্টেম্বর, অক্টোবর এই তিন মাস এবং পরবর্তী সময়েও এমন বহু মহিলা স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন যাঁরা আগে কখনো রাস্তায় নামেন নি,কোনদিন কোনও মিছিলে যোগ দেন নি । নারী এবং প্রান্তিক লিঙ্গযৌনতার মানুষদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশ গ্রহণ বিশেষ মাত্রা নিয়ে এসেছে এই আন্দোলনে । প্রান্তিক লিঙ্গ যৌনতার মানুষের যোগদান এই আন্দোলনের এক গুরুত্বপূর্ণ সম্প্রসারণ । বাংলা তথা পৃথিবীর ইতিহাসে ধর্ষণের প্রতিবাদে এত দিন ধরে বার বার এত মানুষের পথে নামার নিদর্শন বিরল। ২০২৪ এর আগে ২০০৪ এ মণিপুর এবং ২০১২ র দিল্লি তে ধর্ষণ বিরোধী আন্দোলন বৃহৎ গণ জাগরণের চেহারা নিয়েছিল। কিন্তু ২০২৪ এর আন্দোলন পূর্ববর্তী গণজাগরণের তুলনায় ব্যাপকতর এবং অনেক বেশি শক্তিশালী।
ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস বলেছেন পিতৃতন্ত্রের সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে ঘটে গিয়েছিল নারীর মহান ঐতিহাসিক পরাজয় (Origins of the family, private property and The State) । কেট মিলেট তাঁর ধ্রুপদী গ্রন্থ Sexual Politics এ লিখেছেন অমিত শক্তিশালী, আপাত-অমোঘ পিতৃতন্ত্রের শোষণ থেকে মুক্তি শুধু নারীরই অভীষ্ট নয়, মানবতার মুক্তির জন্যেই পিতৃতান্ত্রিক শোষণের অবসানের প্রয়োজন। আর্থ সামাজিক অবস্থান, বয়স, পোশাক, চেহারা কোন কিছহুই ধর্ষণের বিরুদ্ধে নিরাপত্তা দিতে পারেনা। নারী দেহের উপর পুরুষের এই বলপ্রয়োগ সর্বত্র নারীর অধিকার কে বিপন্ন করে রাখে।
ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে জেহাদ তাই অভয়া আন্দোলনের অন্যতম লক্ষ্য । ২০২৪ এর ৯ ই অগাস্ট আর জি কর হাসপাতালে পাশবিক যৌন অত্যাচারের শিকার হয়ে দুর্নীতির যূপ কাষ্ঠে, শহীদ তরুণী চিকিৎসকের মৃত্যুর ২ মাস ১৯ দিন পর, ২৮ শে অক্টোবর গড়ে ওঠা অভয়া মঞ্চের দশ দফা দাবীর প্রথম দাবী অভয়ার ধর্ষণ ও খুনের ন্যায় বিচার এবং দ্বিতীয় দাবী টিই হল নারী ও প্রান্তিক যৌনতার মানুষের সুরক্ষা ।
শুলুঙ গুড়ি অঞ্চলে নাবালিকা ধর্ষণ ও খুনের প্রতিবাদে, যাত্রাগাছি, গৌরাঙ্গ নগর, শুলুঙ গুড়ি, জগৎপুর এবং সংলগ্ন এলাকা জুড়ে নারী সুরক্ষা বৃদ্ধি এবং অসামাজিক কার্যকলাপ বন্ধের দাবিতে অভয়া মঞ্চ বৃহত্তর বিধান নগর বিগত কয়েক মাস ধরে কাজ করে আসছে। এলাকার মানুষের সঙ্গে আলাপ আলোচনা এবং প্রচারের মাধ্যমে জনমত গড়ে তোলার চেষ্টা করছে এই মঞ্চ। একাধিক বার স্থানীয় থানা এবং বিধান নগর কমিশনারেট অভিযান করে ডেপুটেশন দিয়েছেন এই মঞ্চের সদস্যরা। গত ৬ ই জুন শুক্রবার শুলুঙ গুড়ি কলোনি মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হল অভয়া মঞ্চ বৃহত্তর বিধান নগর আয়োজিত গণ কনভেনশন ।
অভয়া মঞ্চ জ্যাংড়া-হাতিয়ারা পঞ্চায়েত এলাকার শুলংগুড়ি, ঘুনী, জ্যোতিনগর, গৌরাঙ্গনগর, জগৎপুর ইত্যাদি অঞ্চলে নারী, বিশেষতঃ কিশোরীদের ক্রমবর্ধমান নিরাপত্তার অভাব এবং অসামাজিক কার্যকলাপের বৃদ্ধি প্রতিহত করতে কয়েক টি নির্দিষ্ট দাবী করে-
১) বাগুইহাটি থানার জগৎপুর আউটপোষ্টের মত ইকো পার্ক এবং নিউটাউন থানার একটি করে পুলিশ আউটপোষ্ট এই অঞ্চলে গঠন করতে হবে।
২) তিনটি থানা বা তিনটি ফাঁড়ির সমন্বয় সাধনের দায়িত্ব নির্দিষ্ট পুলিস আধিকারীককে দিতে হবে।
৩) এই অঞ্চলের জন্য একটি কার্যকরী পুলিশ হেল্পলাইন ব্যবস্থার প্রবর্তন করতে হবে
৪) অঞ্চলে আরো বেশী পুলিশ পেট্রলিং, সিসি টিভি এবং আলোর ব্যবস্থা করতে হবে। এই ব্যাপারে পঞ্চায়েতকেও যথোপযুক্ত দায়িত্ব পালন করতে হবে।
৫) সব ক্ষেত্রে অপরাধীদের চিহ্নিত এবং গ্রেপ্তার করতে হবে। অঞ্চলে নিখোঁজ বালিকাদের অবিলম্বে খুঁজে বের করে মা, বাবা, পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দিতে হবে।
দেশভাগের যন্ত্রণা নিয়ে ওপার বাংলার ছিন্নমূল মানুষ এবং বাস্তুহারা ভূমিপুত্রদের ঐক্যবদ্ধ, কঠিন সংগ্রামের মধ্য দিয়েই এই অঞ্চলে বসতি গড়ে উঠেছিল। গণ কনভেনশন সেই গৌরবময় সংগ্রামের উত্তরসূরীদের এবং অভয়া মঞ্চের যোদ্ধাদের উন্নততর সমাজ গঠনের লড়াইতে শামিল হবার আহ্বান জানায়।
৫ জুন ২০২৫ কোন্নগরে প্রতিবন্ধী নাবালিকার খুনের প্রতিবাদে রাজ্য প্রতিবন্ধী সম্মিলনী ও ‘প্রচেষ্টা’ র আহ্বানে এবং অভয়া মঞ্চের সহযোগিতায় বিক্ষোভ সভা অনুষ্ঠিত হয় বৃহস্পতিবার কোন্নগর বারোয়ারিতলায়। ১৩ বছরের একটি নিঃসহায় প্রতিবন্ধী মেয়ের বাঁচার অধিকার কে স্বীকার করেনি নির্মম সমাজ, প্রশাসনের উদ্যোগের অভাবে মেয়েটি হারিয়ে গেছে চিরতরের জন্যে হিংস্র জান্তব লালসার স্বীকার হয়ে। প্রতিবন্ধী বালিকা, কিশোরী এবং নারীর অসহায়তার কারণেই প্রতিবন্ধী নারীর ধর্ষণ ও খুন এর সংখ্যা তুলনামুলক ভাবে অনেক বেশি। এর প্রতিকারের জন্য যৌথ আন্দোলন এবং সামাজিক সংবেদনশীলতা গড়ে তোলার কথা বলে অভয়া মঞ্চ ।
কলকাতা, ব্যারাকপুর, চন্দননগর অঞ্চলেও নারী নির্যাতন বিরোধী কার্যকলাপে উল্লেখযোগ্য ভুমিকা নিয়েছে অভয়া মঞ্চ।
অভয়ার ধর্ষণ ও খুনের বিচার ছিনিয়ে আনা অভয়া মঞ্চের শপথ। শুধু একজন অভয়া নয়, ভবিষ্যতে ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের অবসান অভয়া মঞ্চের লক্ষ্য । এই লক্ষ্যপূরণে সন্ত্রাস সংস্কৃতির অবসান আবশ্যিক শর্ত । কিন্তু শুধু সামাজিক কাঠামোর পরিবর্তন হলেই ধর্ষণ বা নারীনিগ্রহ বন্ধ হয়ে যাবে এমন নয়। ক্ষমতাতন্ত্রের আমূল পরিবর্তন ছাড়া নারী সুরক্ষা সুনিশ্চিত করা সম্ভব নয়। যে সংস্কৃতি নারী কে ভোগ্য পণ্য ভাবতে শেখায় তার উৎপাটন ছাড়া ধর্ষণ রোধ করা সম্ভব নয়। সামাজিক দুর্নীতি আর লিঙ্গ বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম, সংঘর্ষের পাশাপাশি নতুন চিন্তা ও সংস্কৃতির জন্ম – এই ভাবেই নির্মাণের পথে এগিয়ে চলেছে অভয়া মঞ্চ।
“চাঁদের পাণ্ডুর গালে আশার কমলা আভা,
শিথিল শয়ান ছেড়ে সময় গা ঝাড়া দেয়
উন্মুখ সৃষ্টির বেদনায় কাঁপে মাটির রোমকূপ
ভয়ের চাঁদোয়া ছিঁড়ে ভুইফোড় বর্শার মতন
মাথা তোলে কৃষ্ণচূড়া, লালে লাল আবীর গুলাল
কাফির তীব্র তানে অকাল বসন্ত আসে, মুক্তির বোধন।“–নীল নগরীর বুকে কৃষ্ণচূড়া, দেবাশিস গোস্বামী