সালটা ২০১৮। এন আর এসের নেফ্রোলজি বিভাগের হাউসস্টাফ আমি। ওপিডি র থেকে ফিরে স্যারের সাথে ওয়ার্ড-এ রাউন্ড দিচ্ছি। শ্বাসকষ্ট নিয়ে ভর্তি হওয়া বছর ৩৫-এর এক যুবকের বেডের পাশে দাঁড়ালাম। ক্রনিক কিডনি ডিসিজ; গত ২ বছর ধরে নিয়মিত ডায়ালিসিস পায়। বেডের পায়ের কাছে কাঁচুমাচু মুখ করে রোগীর মা ও স্ত্রী দাঁড়িয়ে। ৩৫ বছরের রোগীর ক্ষেত্রে কিডনি ট্রান্সপ্লান্টই শ্রেষ্ঠ পথ। দীর্ঘদিন ডায়ালিসিস দিতে থাকলে ধীরে ধীরে অন্য শারীরিক সমস্যাও মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। স্যার আমাকে রোগীর বাড়ির লোককে কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট-এর ব্যাপারে কাউন্সেলিং করতে বলে গেলেন। বাড়ির লোককে একপাশে ডেকে ট্রান্সপ্লান্ট-এর ব্যাপারে বোঝাতে শুরু করেছি, বাড়ির লোক মাঝপথে আমাকে থামিয়ে বললেন, “আমরা ট্রান্সপ্লান্ট করতে রাজি নই”। তারপর তাঁদের থেকে জানলাম যে, ট্রান্সপ্লান্ট-এর ব্যাপারে আগেও অন্য হাসপাতালে অন্য ডাক্তারবাবুরা তাঁদের বুঝিয়েছেন। কিন্তু তাঁরা রাজি নন। ট্রান্সপ্লান্ট-এর পর রোগীর জন্য আলাদা বাথরুম লাগে, সেটা নিয়মিত ভালো ভাবে পরিষ্কার রাখতে হয়। এইখানেই এনাদের অসুবিধা। দিন আনি দিন খাই এই পরিবারটির পক্ষে ট্রান্সপ্লান্ট-এর রোগীর এরকম বিশেষ পরিচর্যা সম্ভব না। একটা ঝটকা লাগলো, শুধুমাত্র একটা বাথরুম বানাতে পারবেন না বলে এনারা বছর ৩৫-এর এই তরতাজা যুবকের অকালমৃত্যু মেনে নিতেও রাজি। সেদিন বুঝেছিলাম শুধু চিকিৎসায় হয় না, রোগীর সুস্থ হওয়ার পিছনে পরিচর্যার গুরুত্ব ও অপরিসীম যেটার বিষয়ে জনসচেতনতা তলানিতে।
এম বি বি এস পাঠক্রমের তৃতীয় বর্ষে কমিউনিটি মেডিসিন নামক একটি বিষয়ের বিষম বোঝা ঘাড়ে চাপে। Public health বা জন স্বাস্থ্য এটির মূল আলোচ্য। জন স্বাস্থ্যর পরিধি নেহাত ছোট নয়। রোগবিবরণী থেকে শুরু করে পয়ঃপ্রণালি ব্যবস্থার খুঁটিনাটি সমস্তই এর মধ্যে পড়ে। তথাকথিত নীরস বিষয়টি নিয়ে ছাত্রছাত্রী মহলে অসন্তোষও স্বভাবতই মাত্রাছাড়া। ছাত্রজীবন থেকে ব্যবহারিক জীবনে প্রবেশের সাথে সাথে এই অবহেলিত বিষয়টি নিয়ে ভুল ভাঙতে শুরু করে। রোগ হয়ত ওষুধ, অপারেশন দিয়ে ঠিক করা যাবে, কিন্তু রোগ হওয়ার আগে পরের পরিস্থিতিকেও না পাল্টাতে পারলে রোগমুক্তি সম্ভব না। তাই মদ খেয়ে খেয়ে লিভার পচিয়ে জলে পেট ফুলিয়ে আসা হাঁসফাঁস করতে থাকা রোগীও পেটের জল বের করে দেওয়ার পর মদের তত্ত্ব তালাশে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এক ডেঙ্গুর রোগীকে মশারী ব্যবহার করেন না কেন জিজ্ঞাসা করে উত্তর পেয়েছিলাম, “বাড়িতে কারুর কখনো ডেঙ্গু হয়নি,মশারী কেন টাঙাবো?”
আজ এই করোনা মহামারীর প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে হোম কোয়ারান্টাইন, হোম isolation জাতীয় কথা শুনে বারবার এটাই মনে হচ্ছে, সাধারণ মানুষ এইগুলির গুরুত্ব ঠিক কতটা বুঝতে পারছেন! ম্যাজিক ওষুধ, চটজলদি ভ্যাকসিন, আজগুবি টোটকার মাঝে জনস্বাস্থ্য সচেতনতা কি আদৌ তৈরি হচ্ছে? রাস্তায় সবাই মাস্ক পরে ঘুরছেন বটে, কিন্তু ঘুরতে ফিরতে হাত দিয়ে মাস্ক এডজাস্ট করছেন। এতে যে কারণে মাস্কটা পরা, সেই উদ্দেশ্যটাই যে মাঠে মারা গেলো সে বিষয়ে কারুর হেলদোল নেই। আত্মীয় বন্ধুরা ফোন করে শ্রেষ্ঠ ভিটামিন ট্যাবলেটের নাম জানতে চাইছেন; সুষম খাদ্যই ভালো ইমিউনিটির জন্য পর্যাপ্ত, অতিরিক্ত ভিটামিন ট্যাবলেটের দরকার নেই এটা জানার পর মনমরা হয়ে ফোন নামিয়ে রাখছেন। বাজারে হান্ডওয়াশের অপ্রতুলতা দেখে মানুষের খাবার আগে সাবান দিয়ে হাত ধোওয়ার অভ্যাস তৈরি হয়েছে বলে মনে হচ্ছে; প্রশ্ন হচ্ছে এই সুঅভ্যাসটি পরেও অভ্যাসে থাকবে কি? মহামারী আসে, যায়, রোগের নাম বদলায়, রোগের চরিত্র বদলায়, জনস্বাস্থ্য সচেতনতার গুরুত্ব বদলায় না; ইতিহাস মনে রাখে।