আমাদের আধবুড়ো হাতুড়ে ফাঁকা খুপরিতে বসে স্বপ্নচয়ন করছিলেন। এমন সময় গাব্লুস গুব্লুস আহ্লাদী ধরণের একটি মেয়ে এসে ধপাস করে চেয়ারও্যম্যান হলো। হাতুড়ে চশমার ফাঁক দিয়ে ভুরু নাচালেন।
“হাতুড়ে কাকু, এই নাও জিতুর রিপোর্ট।”
ও হ্যাঁ, জিতু চাকরি করে একটা ট্র্যাভেল এজেন্সির ফ্রন্ট ডেস্কে। ওর দিন কয়েক ধরে জ্বর গলা ব্যথা কাশি শ্বাসকষ্ট। সময় বড়ই খারাপ। আহ্লাদী কাজ করে একটা শেয়ার ট্রেডিং আপিসের ডিসপোজাল টেবিলে। ওদের প্রেমপর্বের আগে থেকেই এই বুড়ো ওদের পরিচিত। ওদিকে প্রিয় হাতুড়েকাকু মন দিয়ে রক্ত পরীক্ষার রিপোর্ট দেখেন। সদাহাসাহাসি বুড়ো কিঞ্চিৎ কিঞ্চিৎ গম্ভীর।
“হাতুড়েকাকু তুমি গম্ভীর ক্যানো? রিপোর্ট কী বলছে?”
হাতুড়ে সকল নিয়ম চুলোয় দিয়ে ড্রয়ার থেকে একটা দোমড়ানো মোচড়ানো ফ্লেক সিগারেট বার করে ধরালেন। অন্য সময় হলে আহ্লাদী ওনার অবশিষ্ট দুগাছি চুল ধরে টানাটানি করতো। ও নীরবে বসে রৈলো। হাতুড়ে বললেন “দ্যাখ রে বুড়ি, তোর বয়ফ্রেন্ডের সিআরপি বেশী, ইএসআর বেশী আর লিম্ফোসাইট কম”
“তাতে কী হয়, কাকু?”
“কিছুই প্রমাণিত হয় না রে! কিছুই না। হাজার হাজার রোগেই এটা হয়। তবে বলা হচ্ছে যে, এগুলো হলে করোনা ভাবতে হবে। বুঝলি?”
“কাকু, আমি তাহলে কী করবো?”
হাতুড়ে বলেন “আমি ঠিক জানি না রে। সেল্ফ কোয়ারেন্টাইনে থাকা ছাড়া আর তো কোনও উপায় দেখি না রে …”
আহ্লাদী এবার অস্থির হয়ে পড়ে। “হাতুড়েকাকু, আমাদের ছোট্ট একটা সংসার, তার থেকেও ছোট্ট একটা ফ্ল্যাট। আমি থাক্ জিতু থাকে আর আমাদের সাতবছরের মেয়ে। কাকু মেয়েটার তো ছুটি। আমাকে অফিস যেতেই হবে। মেয়েটা কোথায় থাকবে?”
আহ্লাদী একটু চুপ করে থাকে। আমাদের মুখফোঁড় হাতুড়েও বাক্যহীন।
“কাকু আমি তো জিতু’কে খাবার দিচ্ছি, বাজারে যাচ্ছি, আমারও তো হতে পারে? আমি মেয়েকে নিয়ে কোথায় যাবো? আর আমারও তো গলায় ব্যথা জ্বর…” আহ্লাদী ওর ওড়না দিয়ে দুচোখ থেকে গড়িয়ে পড়া জল মোছার চেষ্টা করে। ওর ক্লান্ত মুখে কাজল ধেবড়ে যায়।
“তাহলে যে গতকাল বললো পাঁচশো জনের পরীক্ষা করা হয়েছে, কিন্তু একজনেরও করোনা পাওয়া যায় নি?” আহ্লাদীর চোখ আশায় চকচকে হয়ে ওঠে।
হাতুড়ে গেলাসে চায়ের অবশিষ্টাংশে ছাই ঝাড়েন–“শোন ওটা কেবলমাত্র আইসিইউতে ভর্তি অন্য রোগীদের ওপরে করা হয় – করোনার উপসর্গ যাদের আছে তাদের ওপরে নয় ..”–হাতুড়ের মুখ বিষণ্ণ হয়। “আমাদের দেশের এয়ারপোর্টে চীন ফেরত মানুষের ওপর নয়’ই জানুয়ারি থেকে স্ক্রিনিং শুরু করা হয়…. কেবলমাত্র থার্মাল গান দিয়ে ….. অর্থাৎ জ্বর মাপা হয়। ইতিমধ্যে গোটা পৃথিবীতে আড়াই লক্ষের বেশী লোক আক্রান্ত – দশ হাজারের বেশী মৃত …”
আহ্লাদী বাধা দেয় “কাকু, তাহলে তো এতো দিনে হাজার হাজার লোক মরে যেতো?”
হাতুড়ে ম্লান হাসেন “ তথ্য বলছে, ভারতবর্ষে প্রতিটি দিন সাতাশ হাজার ছ’শো মানুষ মারা যায় … এমনি এমনি … এখন আরও বেড়েছে কিনা হিসেব কে রাখছে রে?”
“আমাদের দেশে তো রোগ ধরা পড়েছে, তারপর কিছু করা হয় নি?”
“আমাদের দেশে প্রথম রোগী মারা যায় এ বছর তিরিশে জানুয়ারিতে। যখন এয়ারপোর্টে স্ক্রিনিং আরম্ভ হয় তখন ইতিমধ্যে ঊনিশটা রোগী মারা গেছে। আর সেই স্ক্রিনিং কেবলমাত্র বিশেষ কয়েকটি দেশ থেকে আসা লোকেদের জন্যে ..”
“তাহলে যে সবাই বলছে আমাদের দেশে রোগ ছড়ায় নি?”
আধা পাগল হাতুড়ে উঠে দাঁড়ান “চ বুড়ি, চা খেতে যাই … শোন পরীক্ষা না করলে কার এইডস হয়েছে – কজন আক্রান্ত সেটা যেমন জানা যাবে না – ঠিক তেমনই পরীক্ষা না করে তুই বুঝবি কী করে যে কজন করোনা আক্রান্ত?”
হাতুড়ে আহ্লাদীর হাত ধরে তোলেন “চল মনে শক্তি রাখ্ আর প্রার্থনা কর যাতে ভবিষ্যতের নাগরিক বিজ্ঞানমনস্ক হয়। যেন অতিপ্রাকৃতের যাদুকরী মোহ ছেড়ে বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়ে যুক্তি দিয়ে ভাবতে শেখে।”