এ পিক আপ গাড়ির নয়। বরং বলা যায় গাড়ি বাড়ির।এটা হচ্ছে নেশাড়ুদেরকে গাড়ি করে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে অ্যান্টি অ্যাডিকশান সেন্টারে ভর্তি করার পিক আপ।
প্রত্যেক অ্যান্টি অ্যাডিকশান সেন্টার গুলোর খুব সুন্দর সুন্দর নাম আছে। তবে এই গুলোকে ইউনিভার্সালি শুধুই ‘সেন্টার’ বলা হয়।এখানে আমিও তাই বলব।
এই সেন্টারগুলোতে নেশাড়ুদের সাথে সাথে মানসিক রোগীও ভর্তি রাখা হয়।এই জগৎটার সঙ্গে যাদের কোনো প্রত্যক্ষ সংযোগ নেই তাদের কাছে এক আজব জায়গা লাগবে।যাইহোক এর অন্দর বাহির নিয়ে আলোচনার জন্যে এই লেখা নয়।এখানে শুধু অনিচ্ছুক নেশাড়ু এবং মানসিক রোগীদের ধরে নিয়ে যাওয়ার পদ্ধতি নিয়ে কিছু ঘটনা বলব।
আগেই বলে নিচ্ছি রোগীর ব্যক্তিস্বাধীনতা বা মানব অধিকার আইনের নিরিখে এগুলো সব বেআইনী পদ্ধতি।কিন্তু যাদের বাড়ি কোনো মদ, গাঁজা, হেরইনের নেশাড়ু বা দীর্ঘদিনের আন ম্যানেজেবল মানসিক রোগী আছেন তারা বড় দুঃখ বড় যন্ত্রনায় সেন্টার গুলোতে তাদের পরিজনকে পাঠান।আইন কানুন তাদের কাছে এখানে অবান্তর।
১
কলকাতা থেকে অনেক দূর এক গ্রামে এক জনকে পিক আপ করতে গেছে এক সেন্টার থেকে।বাড়ির লোক বলে দিয়েছে শেষ তাকে দেখা গেছে এক বাঁশ বাগানের দিকে যেতে।মে মাসের চাঁদিফাটা গরম।তো সেন্টারের লোকজন গুটি গুটি পায়ে নিঃশব্দে সেখানে হাজির।
বাঁশ বাগানের মধ্যে ঝোপঝাড় ভেঙ্গে গভীরে গিয়ে দেখে হালকা ধোঁয়া আর অভিজ্ঞ নাকে বিশেষ গন্ধ।বাঁশ আর ঝোপের আড়াল পেরতেই দেখা মূর্তিমান বসে কল্কেতে সুখটান মারছে।কিন্তু একি পোশাক, এই গরমে পায়ে কেডস গায়ে ওভার কোট মাথায় মাঙ্কি ক্যাপ।ওরা জিজ্ঞাসা করল এই পোশাক কেন।তার জবাব, ‘গ্যাঁজা’ টানার সময় মশার কামড় ভালো লাগে না!!
২
বাড়ির লোক বলে দিয়েছে সারাদিন এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ায় রাত দুটোর আসপাশে ফিরে চাঁদনির এক গুদোম ঘরে ঘুমোতে আসে।ধরতে এলে ওই সময় আসতে হবে।তো সেন্টারের ছেলেরা তক্কে তক্কে ছিল। যেই শুয়েছে।গিয়ে হাজির।
—চল।
—কোথায়?
—লালবাজারে।আমরা পুলিশ।
—আমার অপরাধ।
—কি করছিস?
—ঘুমোচ্ছি।
—এখন ঘুমোচ্ছিস কেন?
—রাত দুটোয় তো লোকে ঘুমোয়।
—ঘুমোচ্ছিস তো পুলিশের পার্মিশান নিয়েছিস।চল!
৩
একজনকে ধরতে গেছে।সেও বিপদ বুঝে ঘর থেকে বেরিয়ে ছুটতে শুরু করেছে।এরাও পেছনে ছুটছে।উপায় না দেখে লোকটা এক বড় আমগাছে উঠে পড়েছে।এদেরও একজন উঠে পড়েছে।সে ক্রমশ সরু মগ ডালের দিকে উঠছে।যে তাড়া করে উঠছিল তার তাগড়াই চেহারা।
সে কিছুটা উঠে বলল, কিরে নেমে আসবি নাহলে তোর ডালের গোড়ায় লাথি মেরে নীচে ফেলে দেব।
বেচারা একবার চেহারাটা দেখে নিয়ে সুড়সুড় করে নেমে এল।
৪
মাঝে মাঝে ভ্রান্তিবিলাসও হয়।যেহেতু নেশাড়ুরা মূল অত্যাচারটা বাবা মার উপর করে।তাই তারা খুব ভয়ে ভয়ে থাকে।ভালোবাসা আর স্নেহের জন্যে সন্তানকে কিছু বলতে পারেনা।সেই সুযোগ নিয়ে সে মানসিক শারীরিক দুটো অত্যাচারই বাবা মায়ের উপর করে।
তো এরকম এক মা ফোন করে সেন্টারে বলেছে তার ছেলে ভয়ঙ্কর মারকুটে। বেশ অনেক লোকজন নিয়ে যেন আসে তাকে পিক আপ করতে, কারন দু তিনজনও নাকি তাকে সামলাতে পারেনা।
এরা এসব শুনে সেন্টার থেকে তাদের ‘বেস্ট’ পিক আপ স্পেশালিষ্ট জনা চার নিয়ে গেছে।আর স্ট্রাটেজি হচ্ছে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বাইরে দাঁড় করান থাকবে।কিছু বোঝার আগেই ঝটিকা আক্রমন করে ছেলেটাকে পাকড়াও করে গাড়িতে তুলে ফেলবে।
ছোট্ট খাট্ট চেহারার মা দরজা খুলে দিয়ে একদিকে চোখের ঈশারায় দেখাতেই দেখতে পেল একজন লম্বা চওড়া মানুষ দাঁড়িয়ে।পরিকল্পনা মত ঝাঁপিয়ে পড়ে একজন ঘাড়, দুজন দুহাত, আর একজন কোমর ধরে ফেলেছে।সে তো পরিত্রাহি চিৎকার করছে,
— আমি না আমি না।
— ওরকম সবাই বলে।চল।বলে পেল্লাই ধমক দিল পিক আপ ম্যানদের লিডার।
— আরে আমি বাবা, ছেলে ওদিকে দাঁড়িয়ে।ভদ্রলোক কাঁদো কাঁদো ভাবে বললেন।
তখন ওরা দেখল ঘরের অন্যদিকে রোগাসোগা ছোটখাটো এক বছর আঠারর ছেলে দাঁড়িয়ে। এই তাহলে সেই মাস্তান! তার দিকে এগনর আগেই সে, গাড়ি কোথায়?বলে বাড়ির বাইরে চলে এল।
৫
এটা কলকাতার এক বড় মেডিক্যাল কলেজের ঘটনা।সেখানের একটি পড়ুয়া ছেলের বাইপোলার ওয়ান বা উল্লাস রোগ হয়েছে।সেতো তখন খুব বড় বড় কথা বলছে।সব কিছুর প্রতিবাদ করছে।যাকে তাকে চমকাচ্ছে।
একসময় তার মাথায় এল হাসপাতালে দুরবস্থার জন্যে আসল কালপ্রিট হচ্ছে সুপার।তো গেল সুপারের ঘরে।ইমারজেন্সির সামনে নোংরা কেন থেকে ভেঙ্গে পড়া স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিয়ে সুপারকে তীব্র ভর্ৎসনা ও গালিগালাজ।
সুপারও ঘাগু লোক। বললেন পরের দিন সকাল এগারোটায় সুপারের ঘরে আসতে, দেখবে সব ঠিক হয়ে গেছে।ওই হাসপাতালে তখন সাইকিয়াট্রি ইন্ডোর ছিল না।তাই ছেলেটিকে পিজিতে পাঠান হবে ঠিক হল।সুপার জনা চারেক সন্ডা গুন্ডা স্টাফ আর একটা অ্যাম্বুলেন্স রেডি করে রাখলেন।
ছেলেটা তো পুরো অমিতাভ স্টাইলে এগারোটার আগেই এসে হাজির।
—হ্যাঁ সুপার কি হোলো, বলে যেই ঘরে ঢুকেছে।ছেলেটি কিছু বোঝার আগেই তাকে ধরে ফেলেছে স্টাফেরা।তারপর টানা হ্যাঁচড়া।সেও যাবেনা।সুপারকে গালি গালাজ।তারপর যখন তাকে অ্যাম্বুলেনেসে তোলা হচ্ছে সে তখন ‘জয়’থেকে একেবারে ‘গব্বর সিং’। সিধে রাষ্ট্র ভাষা।
—সুপার এ তুনে ঠিক নেহি কিয়া সুপার। তুঝে ইয়াদ রাখুঙ্গা।যব ম্যায় ওয়াপস আউঙ্গা তুঝে বহোৎ ম্যাহেংগা পড়েগা সুপার….।
অ্যাম্বুলেন্স ছেড়ে দিয়েছে তখন!
এরকম অসংখ্য ঘটনা আছে।যারা পিক আপ করে তারাও ছেড়ে দেওয়া নেশাড়ু।তাই নেশাড়ুদের মনস্তত্ত্ব এরা সবথেকে ভালো বোঝে।সেরকম ভাবেই এক এক জনের ক্ষেত্রে এক এক রকম ভাবে পিক আপ করে।