২২ জুন, ১৮৯৭। চল্লিশ বছর আগে মহাবিদ্রোহের পরে ভারত-সম্রাজ্ঞীর পালক মাথায় পরেছেন মহারাণী ভিক্টোরিয়া, তাঁর ইংল্যান্ড-সিংহাসন আরোহণের হীরক জয়ন্তী বছর। ভারত জুড়ে চলছে উৎসব। পুনের গভর্নমেন্ট হাউসে সন্ধ্যেবেলা লাটবেলাটদের মহা সমারোহ। উৎসব শেষে ফিরছেন ওয়াল্টার চার্লস র্যান্ড, আইসিএস, প্লেগ নিয়ন্ত্রণের সর্বময় কর্তা। অন্ধকারের মধ্যে থেকে বেরিয়ে এল তিন ছায়ামূর্তি, গাড়ির পাদানিতে উঠে একজন চালাল গুলি। গুরুতর আহত হলেন র্যান্ড, পরে হাসপাতালে মারা গেলেন।
আততায়ীদের মধ্যে একজন দামোদর হরি চাপেকর।(১) ধরা পড়ার পরে বিবৃতি দিলেন তিনি, প্লেগ মহামারী নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে অত্যাচার করছে র্যান্ড-এর সরকারি বাহিনী। গোরা সৈন্য বাড়ি সার্চ করার নামে গৃহের পবিত্রতা নষ্ট করছে, ভাঙ্গছে বিগ্রহ। এর প্রতিশোধ নিতেই র্যান্ড-হত্যা। দামোদরের ফাঁসি হল। তাঁর সঙ্গে ছিলেন তাঁরই দু-ভাই, বালকৃষ্ণ হরি আর বাসুদেব হরি। তাঁরা ধরা পড়লেন কিছুদিন পরে, তাঁদেরও ফাঁসি।
কেন চাপেকর ভ্রাতৃত্রয় র্যান্ড সাহেবকে মেরেছিলেন? প্লেগের হাত থেকে মানুষকে বাঁচানোর জন্যই তো র্যান্ড সাহেব এত কড়াকড়ি করেছিলেন! আজও আরেক মহামারীর সামনে দাঁড়িয়ে অনেক অপ্রিয় সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন প্রশাসকরা। বাড়ির দরজায় কড়া নাড়ছে প্রশাসনিক প্রতিনিধি, যেতে হবে বাড়ি থেকে দূরে। কোয়ারেন্টিন—নীরোগ মানুষের বাধ্যতামূলক আলাদা থাকা। রোগ তেমন হলে হাসপাতালে যেতেই হবে। এসবই সরকারি গাইডলাইন। না মানলে প্রশাসনিক রক্তচক্ষু।
কিন্তু আজ গল্প ২০২০ সালের নয়। আজ ইতিহাসের কথা—ব্রিটিশ ভারত ১৮৯৬-১৯২০। কোভিড ১৯ নয়। প্লেগ—তৃতীয় প্যানডেমিক।
xxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxx
প্রথম প্লেগ প্যানডেমিক ইতিহাসের ধূসর পাতায় বিস্মৃতিমাত্র। সাধারণাব্দ ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শতক জুড়ে বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের আনাচেকানাচে প্লেগের দুঃসহ জ্বরে কেঁপেছিল ইউরোপ আর মধ্য এশিয়ার লক্ষ লক্ষ মানুষ, ফুলে উঠেছিল তাদের বগল আর কুঁচকির গ্রন্থিগুলো, দুর্বল হতে হতে একদিন মানুষগুলো চলে যাচ্ছিল যমের দক্ষিণ দুয়ারে। চিকিৎসকরা ধারনাই করতে পারছিলেন না কী চিকিৎসা করবেন, তাই রোগীর সঙ্গে তাঁরাও পালাচ্ছিলেন প্রাণভয়ে। দেশ উজাড় হয়ে আসছিল। দুশ’ বছর তাণ্ডব চালিয়ে একদিন সে মারী বিদায় নিল। কিন্তু তার প্রায় সাত-আটশ’ বছর পরে এল ইউরোপের ব্ল্যাক ডেথ—একই রোগ, একই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি। তবে এবারে অন্তত মৃতের সংখ্যার একটা আন্দাজ পাওয়া যায়। ইউরোপের এক-তৃতীয়াংশ মানুষ ধরাধাম থেকে বিদায় নিয়েছিল। তারপরে কয়েকশ’ বছর পরে আমাদের আলোচ্য তৃতীয় প্লেগ প্যানডেমিক।
উনবিংশ শতকের মাঝামাঝি এই রোগ প্রথম দেখা দেয় চীনে। চীনদেশ থেকে প্লেগ সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। ভারতেই প্রকোপ ছিল সবথেকে বেশি—এক কোটি লোক মারা যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরবর্তীকালে করা হিসেব বলছে, ১৮৫৫ থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত এক শতাব্দী ধরে চলেছিল এই প্যানডেমিক। আমরা এখন তারই একটা ছোট অংশ দেখব। স্থান বোম্বাই, কলকাতা আর পুনে, কাল ১৮৯৬-১৮৯৭।
১৮৯৬-এ হংকং থেকে জাহাজে করে প্লেগ ঢুকল বোম্বাই। এতদিন উত্তর ভারতে নানা জায়গায় প্লেগ দেখা যেত মাঝে মধ্যে, তা নিয়ে বৃটিশ প্রশাসন কিছুই করেনি। ম্যালেরিয়া আর কলেরা দেশ উজাড় করে দিচ্ছিল, রাণীর কৃপাদৃষ্টি মেলেনি। কিন্তু এইবার সমস্যা হল। অন্য নানা ইউরোপীয় দেশ বলল, ভারত থেকে প্লেগ ছড়াবে তাদের উপনিবেশগুলোতে, এমনকি খোদ ইউরোপে। ঐতিহাসিক কারণে প্লেগ নিয়ে ইউরোপীয়দের আতঙ্ক ছিল চরম—ভারত থেকে প্লেগ ছড়ানো আটকাতেই হবে। ১৮৫০ সালে ভারত থেকে কলেরা ছড়িয়ে পড়া আটকানোর জন্য তৈরি হয়েছিল ইন্টারন্যাশনাল স্যানিটারি কনফারেন্স। ভেনিসে তার মিটিং-এ বৃটিশ সরকারের ওপর চাপ এল, অন্য দেশের প্রতিনিধিরাই বলে দিলেন প্লেগ রুখতে ভারতে কী কী ব্যবস্থা নিতে হবে! নইলে ভারতের পোর্ট বয়কট করা হবে, বৃটিশের লাভের ব্যবসা ডুববে।
বোম্বে হয়ে এদেশে প্লেগ ঢুকে ছড়াতে শুরু করবে, এই ভয় ইংল্যান্ডেশ্বরী থেকে লাটসাহেবদের সবার ছিল। আর সেটা আটকাতে হতভাগা নেটিভদের আচরণ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, এটা সাহেবদের ‘জানা’ ছিল। অতি দ্রুত বড়লাট লর্ড এলগিনের কাউন্সিল তৈরি করল এপিডেমিক ডিজিজ অ্যাক্ট, ১৮৯৭।(২) তাড়াহুড়ো করে সেই আইন সারা বৃটিশ ভারতে লাগু হল। এই আইনের নানা ধারাতে সরকার যে কোনো জাহাজ ও ট্রেন ও তার যাত্রীদের পরীক্ষা করতে পারত, কারো প্লেগ সন্দেহ হলে তাঁকে তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে আটকে রাখতে পারত, কোনো বাড়ি গুদাম কারখানা সার্চ করে সেখানকার লোকদের বের করে দেওয়া, জায়গাটি ডিসইনফেক্ট করা, এমনকি বিল্ডিং ভেঙ্গে ফেলা—এসবই করতে পারত। সমস্ত ধর্মীয় সমাবেশ, মেলা, জমায়েত বন্ধ করা হল। বোম্বে, কলকাতা, পুনে, করাচি এসব শহরে দেশীয়দের কাউন্সিলকে মিউনিসপ্যাল কাজকর্মের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। সেগুলো অকেজো ঘোষণা করে সেই দায়িত্ব সাহেব ডাক্তার আর সাহেব আইসিএস-দের দেওয়া হল। ওয়াল্টার চার্লস র্যান্ড এভাবেই পুনের দায়িত্ব পেলেন।
হংকং-এ নাকি দমনমূলক ব্যবস্থা নিয়ে প্লেগ আটকানো গেছে, তাই ভারতেও শুরু হল জোর করে রোগী ধরা, রোগ সন্দেহে পুরো এলাকাকে আলাদা করে দেওয়া, দল-কে-দল মানুষের কোয়ারান্টাইন। বোম্বেতে হংকং থেকে প্লেগ এসেছে, বোম্বেতেই তাকে আটকে দেবার জন্য ধরপাকড় আর বাড়ি বাড়ি গোরা সৈন্যের সার্চ আরম্ভ হল। প্রতিক্রিয়া হল দ্রুত—শুরু হল শ্রমিকবিক্ষোভ, দাঙ্গাহাঙ্গামা, হাসপাতাল আক্রমণ, কলকারখানা হল বন্ধ। একবছরের মধ্যে বোম্বাইয়ের সাড়ে আটলাখ মানুষের মধ্যে তিন লাখ আশি হাজার মানুষ পালিয়ে গেল—প্লেগের ভয়ে ততটা নয় যতটা সরকারের পুলিশ মিলিটারি জোরজবরদস্তির ভয়ে। পালানো মানুষের সঙ্গে প্লেগ ছড়িয়ে পড়তে লাগল। পুনেতে প্লেগ এভাবেই এসে পৌঁছল, আর সেখানে প্লেগ কমিশনার নিযুক্ত হলেন ওয়াল্টার চার্লস র্যান্ড।
ভারতীয় জাতীয়তাবাদীরা প্লেগ মহামারীর প্রথমদিকে অকর্মণ্যতার জন্য বৃটিশ সরকারকে দায়ী করছিলেন। পুনেতে বাল গঙ্গাধর তিলক তাঁর কাগজ মারাঠা-তে বলেন, প্লেগ নিয়ে সরকার কিছুই করছে না, এ হল সরকারের ক্রিমিনাল নেগলেক্ট। কিন্তু সরকারের দমনমূলক পদক্ষেপ শুরু হতে এঁরা তার বিরোধিতা করলেন। কলকাতার বঙ্গবাসী লিখল, প্লেগের আইনের মতো মতো বিপজ্জনক অত্যাচারী আইন এদেশে দুটি নেই। তিলকের মারাঠা প্রথমেএপিডেমিক ডিজিজ অ্যাক্ট, ১৮৯৭ এর প্রশংসা করলেও পরে পুনেতে সেই আইনের ভয়াবহ প্রয়োগ দেখে বলল, বৃটিশ ভারতে আর কোনো ব্যবস্থা ভারতীয়দের গার্হস্থ্য, সামাজিক ও ধর্মীয় জীবনের ওপর এত বড় আঘাত হানে নি। অন্যদিকে, বৃটিশ সরকারি মতে, প্লেগ নিয়ে বড় সমস্যা হল ভারতীয়দের কুসংস্কার, তাদের জোর করে কোয়ারান্টিন করতে হবে, জোর করে হাসপাতালে দিতে হবে, গোরা সৈন্য দিয়ে বাড়ি সার্চ করে দেখতে হবে। তিলকের পুনেতে প্লেগ কমিশনার র্যান্ড জোরকদমে কাজ শুরু করলেন।
এর আগে থেকেই পুনের পাশের গ্রামের যুবক দামোদর হরি চাপেকর বৃটিশ শাসনের বিরুদ্ধে গোপনে ছোট একটি দল গড়েন। সঙ্গে ছিলেন তাঁর দুভাই, বালকৃষ্ণ হরি আর বাসুদেব হরি, এবং আরও কিছু যুবক। প্লেগ নিয়ে সরকারি অত্যাচারের কথা জেনে আর তিলকের লেখা পড়ে তাঁরা স্থির করেন, বৃটিশ আবেদন-নিবেদন শুনবে না। তাদের ওপর আঘাত হানতে হবে, আর প্লেগ কমিশনার র্যান্ডের বাড়াবাড়ির জন্য তার প্রাপ্য শাস্তি হল মৃত্যুদণ্ড।
ওয়াল্টার চার্লস র্যান্ড-কে মেরেছিলেন বটে চাপেকর ভ্রাতারা, কিন্তু র্যান্ড হয়ত নাটবল্টু মাত্র। শেষে যখন সরকার বুঝতে পারে, মানুষকে চটিয়ে, তাকে ভয় পাইয়ে, কোনো মহামারী দূরীকরণ কর্মসূচি সফল হতে পারেনা, তখন প্লেগ নিয়ে সরকারি জবরদস্তি ও অত্যাচার কমে। সে নিয়ে লিখব আবার কোনো দিন।
পাদটিকা
(১) ২০১৮ সালে ভারতীয় ডাক বিভাগ দামোদর হরি চাপেকর-এর স্মরণে স্ট্যাম্প বের করেছে।
(২) প্রসঙ্গত, কোভিড ১৯ নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় সরকার ২০০৫ সালের ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যাক্ট চালু করে। এদেশের বিভিন্ন রাজ্য সরকার লকডাউন পালন আবশ্যিক করার জন্য সেই এপিডেমিক ডিজিজ অ্যাক্ট ১৮৯৭-এর দ্বিতীয় অধ্যায় আজ ২০২০ সালেও লাগু করেন।
চিত্র পরিচিতি
দামোদর হরি চাপেকর স্মরণে ভারতীয় ডাকবিভাগ কর্তৃক প্রকাশিত স্ট্যাম্প।
তথ্যসূত্র
(১) Plague: Assault on the Body. in Colonizing the Body – State Medicine and Epidemic disease in Nineteenth-Century India, David Arnold. University of California Press, 1993, page 200-239
(২) India needs to enact a Covid-19 law. The Hindu, 8 May, 2020. https://www.thehindu.com/opinion/lead/india-needs-to-enact-a-covid-19-law/article31529036.ece accessed on 18 June 2020
(৩) Can the Indian legal framework deal with the COVID-19 pandemic? A review of the Epidemic Diseases Act. Bar And Bench, 27 March, 2020.
১৮৯৬ সালের প্লেগ মহামারী, রাষ্ট্রর ভূমিকা ও ভারতীয় সামাজে তার প্রতিক্রিয়ার সাথে কোভিড১৯এর জাজ্বল্যমান অভিজ্ঞতার সাদৃশ্য ফুটিয়ে তুলতে সফল হয়েছেন লেখক। সমৃদ্ধ হলাম।