বিধিসম্মত সতর্কীকরণ—
১) ইহা ভূতের গল্প।
২) এই গল্পের নায়ক স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
৩) খলনায়ক আমি। এর পরে আমার উল্লেখ গল্পে বিশেষ পাওয়া যাবে না। সে সব ধরে নিতে হবে।
মেডিক্যাল কলেজে পড়ার সময় একদিন সবাই মিলে কী কারণে আড্ডা দিতে বেরিয়েছিলাম। কলেজে আড্ডা দেবার জায়গার অপ্রতুলতা ছিল বলতে পারি না, কিন্তু সেদিন মনে হয়েছিল কলেজে তো আড্ডা দিয়েই থাকি… আজ একটা নতুন কোথাও আড্ডা দিই। যখন কলেজ থেকে বেরিয়েছি, তখন কার মনে কী ছিল জানি না, কেউ হয়ত ভেবেছিল গঙ্গার ধার, কেউ গড়ের মাঠ, আবার কেউ বা হয়ত চেয়েছিল অন্য কোথাও… আদতে হলো কী, সিদ্ধান্ত না নিয়ে বেরোনোর ফলে উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরতে ঘুরতে ক্রমশ আমরা দেখলাম সবাই কেমন দক্ষিণ কলকাতার দিকেই চলেছি — তার কারণ হয়ত এই, যে কুশীলব সবাই তখন দক্ষিণ কলকাতাবাসী। এবার আড্ডার জন্য পড়ে রয়েছে কেবল লেক… (আমরা ঢাকুরিয়া লেক বা রবীন্দ্র সরোবর নামদুটো বিশেষ ব্যবহার করতাম না)… সেটা কারও মনঃপুত হলো না, তখন আমাদেরই মধ্যে একজন বলল, চল আমার বাড়ি। কাছেই, এখন কেউ নেই, জমিয়ে আড্ডা দেওয়া যাবে, আর একটু পরেই পাড়ার দোকানে জিলিপি ভাজবে, গরম গরম জিলিপি খাওয়া যাবে।
চমৎকার আইডিয়া, আমরা সকলে গিয়ে হাজির হলাম গড়িয়াহাট মোড় থেকে ঢিল-ছোঁড়া-দূরত্বে চমৎকার এক দোতলা বাড়িতে। তার বসার ঘরে বসে আজেবাজে বকা হচ্ছে, এমন সময়, সব আড্ডাতেই যেমন হয়, হঠাৎ কথাবার্তায় একটা lull period এল। কেউ বোধহয় এমন একটা নিস্তব্ধতার সুযোগ নেবার জন্য ওঁৎ পেতে ছিল, চট করে বলল, প্ল্যানচেট করবি? খুব এক্সাইটিং হবে!
দেখা গেল কথাটা অনেকেরই মনে ধরেছে। খুব চট করেই প্রস্তাব অনুমোদিত হয়ে তোড়জোড় শুরু হয়ে গেল।
মিডিয়াম কে হবে? এক বন্ধু বলল, আমি মিডিয়াম হতে পারি। আগে হয়েছি। আমি বেশ ভালো মিডিয়াম।
তাহলে এবার শুরু করো! কাকে ডাকা হবে?
কে যেন ফট করে বলল, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর!
সবাই খুব উৎসাহভরে রাজি হয়ে গেল। মিডিয়াম কাগজ পেন্সিল নিয়ে বসল। আমাদের নিয়ম বুঝিয়ে দেওয়া হলো — মিডিয়াম কাগজে পেন্সিল ঠেকিয়ে বসে থাকবে। আমাদের রবীন্দ্রভাবনা/চিন্তা খুব জোরদার হলে তিনি আসবেন। আত্মা মিডিয়ামকে আচ্ছন্ন করলে পেন্সিল গোল-গোল ঘুরবে কাগজে। আমরা তখন প্রশ্ন করতে পারব। প্রশ্ন সবই এমন হতে হবে যার উত্তর ‘হ্যাঁ’, বা ‘না’-য়ে হয়। পেন্সিল যদি ওপর-নিচে নড়ে তাহলে উত্তর ‘হ্যাঁ’। যদি ডাইনে-বাঁয়ে নড়ে, তবে ‘না’। শুরু হয়ে গেল।
সবাই রবীন্দ্রনাথকে ধ্যান করছি, মিনিট কয়েক পরেই মিডিয়ামের হাতে পেন্সিল কাঁপতে শুরু করল। তারপরে একটা প্যাঁচ খাওয়ার মত গোল গোল করে ঘুরতে শুরু করুন। আত্মা এসে গেছে!
প্রশ্নোত্তর শুরু হল। কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে ডাকার আগে তো কেউ ভাবেনি ওঁকে কী জিজ্ঞেস করা হবে! আর সে প্রশ্ন যে-সে প্রশ্ন হলে চলবে না! মাল্টিপ্ল্ চয়েস কোশ্চেনের মতো true-ফলস ঢঙে করতে হবে! ফলে — কেউ এসেছেন কি? — হ্যাঁ। — আপনি কি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর? — হ্যাঁ। — আপনি কি স্বর্গে থাকেন? — হ্যাঁ। ইত্যাকার দু’চারটে প্রশ্নের পরে সওয়াল ফুরিয়ে গেল। তখন একজন মহা বদ প্রশ্নকর্তা প্রশ্নের দায়ভার নিজ-স্কন্ধে তুলে নিল। জানতে চাইল, আপনি যখন বিশ্বভারতী তৈরি করেছিলেন, তখন কি ভাবতে পেরেছিলেন, সেখান থেকে পাশ করা ছেলেরা এমন ন্যাকা হবে?
পেন্সিল দৃশ্যত থমকালো। যে প্রশ্ন করেছিল, সে আরও একটু প্রাঞ্জল করে বলল, এই যে শান্তিনিকেতনী ছেলেরা গরু তাড়া করলে পালায়ও না, লাঠি নিয়ে তেড়েও যায় না, খালি (সুর করে) বলে, এই গরু, গুঁতাস না… এরকম হবে আপনি আন্দাজ করতে পেরেছিলেন?
তখনও উত্তর নেই… বোঝা-ই যাচ্ছে কবিগুরু ফাঁপরে পড়েছেন, এ প্রশ্ন অনেকটা ‘আপনি কি এখনও ঘুষ খান?’ এর মতো। হ্যাঁ-না দিয়ে উত্তর দেওয়া খুব কঠিন। টেবিলের চারপাশে বসা প্ল্যাটকারীদের মধ্যে একজন বলল, রেগে গিয়ে চলে যাবার আগে আর কিছু জানতে চা… তখন পরের প্রশ্ন এল…
— কোনও কোনও এক্সপার্ট বলে “শেষের কবিতা” আপনার শেষ কবিতার বই নয়। এটা কি সত্যি নয়? “শেষের কবিতা”-ই কি শেষ কবিতার বই?
আবার পেনসিলটা বেশ অনেকক্ষণ ঘুরছে, কে যেন অস্ফুটে বলল, জানে না, শালা। শেষে উত্তর এল — হ্যাঁ।
তখন জিজ্ঞেস করা হলো — শেষের কবিতার পরে আর কোনও কবিতাই লেখেননি?
উত্তর এলো — না!
তখন সবাই মিলে হইহই করে উঠল — শালা ইয়ার্কি হচ্ছে?
ভর ভেঙে গেল। মিডিয়াম চমকে বলল, কী হলো? কী হলো?
আমাদের খেয়াল ছিল না, বেচারা মিডিয়াম তো ভর হয়ে ছিল, সে তো আর জানে না কী কথোপকথন হয়েছে!
তাকে বলা হলো, ব্যাটা! শেষের কবিতা শেষ কবিতার বই?
সে বলল, আমি কী করে জানব? উনি কী বললেন?
কে একটা প্রশ্নকর্তাকে বলল, মিডিয়াম শেষের কবিতা পড়েনি তুই জানলি কী করে?
প্রশ্নকর্তা খুক-খুক করে হাসল।
বাড়ির মালিক বলল, দাঁড়া দেখি, পাশের দোকানে জিলিপি ভাজা হলো কি না…
সে-ই আমার প্রথম আর সেই শেষ ভৌতিক অভিজ্ঞতা।