প্রাতঃস্মরণীয় মানুষের বক্তব্য – বা বাণী – তার গুণ এমনই, যে, সে বাণীর তাৎপর্য, আপনি যদি বাণীটি মনে রাখতে পারেন, তাহলে সুদূর কোনও মুহূর্তেও তাৎপর্যটি অনুভব করতে পারবেন।
যেমন ধরুন – জয়প্রকাশ মজুমদার।
আশা করি আপনি ভুলে যাননি যে, তিনি একদা ভাজপা দলের মাঝারি মাপের নেতা ছিলেন। এবং সেই কালে, কোনও এক কর্মসূচীতে যোগদানের পথে, জয়প্রকাশবাবু, তৃণমূলের কোনও তরুণ তাজা কর্মযোগী নেতার লাথিতে, আক্ষরিক অর্থেই কচুবনে ছিটকে পড়েছিলেন।
কালের নিয়মে ঝরে যাওয়া পুরাতন পাতার স্থানে গজিয়ে ওঠে নতুন কচি পাতা। তেমনই, বঙ্গদেশে ভাজপা নেতাদের কেউ কেউ তৃণমূলে যোগদান করেন, তৃণমূলেরও কেউ কেউ, দলে থেকে কাজ না করতে পেরে, অধিকতর কর্মাকাঙ্ক্ষায়, ভাজপা দলে যান।
জয়প্রকাশবাবু প্রথম শ্রেণীভুক্ত – অর্থাৎ তিনি তৃণমূলে এসেছেন।
তো এক ণত্বষত্ব-বোধহীন সাংবাদিক তাঁকে আচমকা জিজ্ঞেস করে বসেছিলেন – যাঁদের কাছে আক্ষরিক অর্থেই লাথি খেয়েছিলেন, এখন সেই দলের হয়ে প্রচার করতে কেমন লাগছে?
এতটুকু বিচলিত না হয়ে জয়প্রকাশবাবু উত্তর দিয়েছিলেন – ঠিকই, লাথিটা আমার পেছনেই পড়েছিল। কিন্তু অনেক ভেবে আমি বুঝেছি, সেদিন যিনি লাথি কষিয়েছিলেন, তিনি আমাকে লাথি মারেননি – লাথিটা মেরেছিলেন, আমি তখন যে দল করতাম, সেই দলের মতাদর্শের পেছনে। সেক্ষেত্রে…
তো এই কথাটুকু মনে রাখার মতো।
তৃণমূল আমলে অনেক কিছু দেখলাম।
নেতাদের স্বহস্তে তোয়ালে মুড়ে ঘুষ খাওয়া।
পুলিশি হেফাজতে থানায় নিয়ে যাবার পথে ছাত্রনেতার মৃত্যু।
ছাত্রকে তাড়া করে খুন, পুলিশের।
ধর্ষণের পর ধর্ষিতার অভিযোগ মিথ্যে বলে উড়িয়ে দেওয়া।
হাসপাতাল চত্ত্বরে ধর্ষণ-খুনের পর সেই মৃত্যুকে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেওয়া।
দায়িত্ব নিয়ে পুলিশের তরফে খুন-ধর্ষণের প্রমাণ লোপ।
আরও অজস্র ও অসংখ্য উদাহরণ দেওয়া যায়, কিন্তু অবান্তর বাহুল্য নিষ্প্রয়োজন।
এই সব কিছু দেখতে দেখতে ক্লান্ত অভ্যস্ত আর বিরক্ত হয়ে গেছি। তারপরও বলি, সদ্য চাকরি-হারানো দিশেহারা শিক্ষকের পেটে লাথি কষাচ্ছে উর্দিপরিহিত পুলিশ – পুলিশ না বলে তৃণমূলকর্মীও বলতে পারেন, কেননা এই রাজ্যে পুলিশ বলতে তা-ই – এই দৃশ্যের অভিঘাত, অন্তত আমার চোখে, অকল্পনীয়।
কিন্তু, যদি সান্ত্বনা পেতেই চান – এবং এটুকু নিশ্চিত যে বিরল কিছু মানুষ বাদে বাকি সবাই, এর পরও, নিরুত্তাপ থাকবেন – তাহলে বলি :
মনখারাপ করবেন না।
লাথিটা কোনও ব্যক্তি-শিক্ষক খাননি।
লাথিটা, চোরকে চোর বলতে না পারার সৎসাহসের অভাবের উদ্দেশে কষানো হয়েছে।
লাথিটা, চিটিংবাজের কাছে চিটিংবাজির বিচার চাইতে যাবার ‘সারল্য’-এর পেটে পড়েছে।
লাথিটা আদতে, এক রাজনৈতিক দলের দুর্নীতিতে ঘটিবাটি হারানোর পরেও প্রতিবাদকে যেনতেনপ্রকারেণ ‘অরাজনৈতিক’ রাখতে চাওয়ার মতো গা-বাঁচানো মানসিকতাকে লক্ষ করে চালানো।
লাথিটা পড়েছে, ইন ফ্যাক্ট, নিজের গায়ে আঁচ না আসা অব্দি গা-বাঁচানোর মনোবৃত্তি এবং নিজের গায়ে আঁচ এলেও তীব্র প্রতিবাদে যেতে গিয়েও পাছে-আরও-কিছু-হয় ভয়ে আবারও গুটিয়ে যাবার ক্লীবতার তলপেটে।
লাথিটা, সাবধানী হতে হতে উত্তরোত্তর অতি-সাবধানী কেঁচো হয়ে গিয়েছে যে শ্রেণী, সেই ক্ষমতাহীন ক্লীব প্রাণীর প্রতি ক্ষমতাবানের স্বাভাবিক ঔদ্ধত্যের প্রকাশ।
মনখারাপ করবেন না। এত কিছু মেনে নিয়েছেন, এতেও ঠিকই অভ্যেস হয়ে যাবে।
আর হ্যাঁ, এমনও বলতে পারতাম, যে, লাথিটা পড়েছে কোনও ব্যক্তিশিক্ষকের পেছনে নয়, পড়েছে এই রাজ্যের সরকারি শিক্ষাব্যবস্থার পশ্চাদ্দেশে – কিন্তু, আপনারা জানেন, আমার চাইতে অনেক ভালো করে জানেন, যে, এই রাজ্যে সরকারি শিক্ষাব্যবস্থার মৃত্যু, এমনকি পারলৌকিক ক্রিয়াকর্ম অব্দি সমাধা হয়ে গিয়েছে অনেক আগেই। বিদেহী আত্মার প্রতি, আর যা-ই হোক, লাথি কষানো যায় না।