গতকালের পর
এই সামগ্রিক বিষয়টি অন্য মাত্রা পেয়ে যায় হিটলার-মুক্ত বর্তমান পৃথিবীতে – আমেরিকার গণতান্ত্রিক সমাজে। ১৯৬৪ সালে আমেরিকার ব্রুকলিনে Jewish Chronic Disease Hospital-এ ২২ জন রোগীর দেহে ক্যান্সার কোষের ইঞ্জেকশন দেওয়া হয়েছিলো – “Sins of Omission – Cancer Research Without Informed Consent”। বিষটি নিয়ে হইচই শুরু হওয়ার পরে বিচার শুরু হয়।
প্রবন্ধের শুরুতে উল্লেখিত আইজি ফারবেন কোম্পানির ম্যানেজার অটো অ্যামব্রোস “কঠোর” সাজা ভোগ করে ১৯৫২ সালে মুক্তির পরে এক ডজন কোম্পানির ম্যানেজার হয়েছিলেন। তার মধ্যে একটি কোম্পানি সজ্ঞানে বর্তমানে নিষিদ্ধ ওষুধ থ্যালিডোমাইড তৈরি করতো। থ্যালিডোমাইডের ব্যবহারে গর্ভবতী মায়ের ৪০% ক্ষেত্রে বিকলাঙ্গ শিশু জন্ম নিতো। আইজি ফারবেনগোষ্ঠীর একটি কোম্পানি বায়ারের সাথে (Bayer) আরেক কুখ্যাত মারণান্তক বহুজাতিক কোম্পানি মনসান্টো-র সংযুক্তি হয়। এরা ডেমোক্র্যাটিক রিপাব্লিক অব কঙ্গোয় সামরিক অভিযানের সাথী হয়ে বিভিন্ন খনিজ সম্পদ লুন্ঠন করছে। তার মধ্যে সবচেয়ে মূল্যবান হল কোল্ট্রান – একটি খনিজ পদার্থ যা থেকে নায়োবিয়াম এবং ট্যান্টালাম এই দুটি মহামূল্য ধাতু পাওয়া যায়। মিলিটারি-মেডিক্যাল-ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্সের বৃত্তটি সম্পূর্ণ হল।
আউশভিৎসের নতুন ঠিকানা – আবু ঘ্রাইব কিংবা গুয়ান্তানামো বে
পৃথিবীব্যাপী প্রভুত্বের জন্য আমেরিকার যুদ্ধোন্মত্ততা আজ বিশ্ববাসীর কাছে সুবিদিত। তেলের বাজারের দখল রাখার জন্য মধ্যপ্রাচ্যকে একটি সামরিক পরীক্ষাগার বানিয়ে তুলেছে। অন্যত্র খনিজ সম্পদ বা প্রাকৃতিক গ্যাসের জন্য একই ঘটনা ঘটাচ্ছে। আবার অন্যত্র সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে স্ট্র্যাটেজিক পয়েন্ট হিসেবে সামরিক ঘাঁটি রাখছে। একইসাথে সংখ্যায় নাৎসি জমানার মতো না হলেও মাত্রার দিক থেকে একইরকমের অত্যাচার চলছে কুখ্যাত গুয়ান্তানামো বে, আবু ঘ্রাইব, বাগ্রাম বা কিংবা CIA-র “ব্ল্যাক সাইটস”গুলোতে। অসংখ্য প্রামাণ্য দলিল এবং প্রবন্ধ লেখা হয়েছে এসব জায়গায় অত্যাচারের পূর্ণ বিবরণ দিয়ে। আমি একটুখানি উল্লেখ করছি। ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে “আমেরিকান জার্নাল অব পাব্লিক হেলথ”-এর প্রথম সংখ্যায় প্রকাশিত একটি প্রবন্ধের শিরোনাম – “From Nuremberg to Guatanamo Bay: Uses of Physicians in the War on Terror”। হিটলারের সময়ে “শুদ্ধ রক্ত”কে বর্তমান সময়ে “সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ” বলে লেখা হচ্ছে আর কি! এ প্রবন্ধে লেখকেরা বুঝতে চাইছেন কিভাবে এবং কেন মেডিক্যাল পেশার সাথে যুক্ত ডাক্তার, নার্স সহ সবধরনের মানুষ তাদের নিরাময় করার এবং সারিয়ে তোলার দক্ষতাকে একদিকে বন্দীদের ওপরে ক্ষত/ক্ষতি সৃষ্টির জন্য আর অন্যদিকে, রাষ্ট্রের তরফে এরকম ভয়াবহ বর্বরসুলভ অত্যাচারকে ধুয়েমুছে নির্বিষ প্রমাণ করার জন্য কাজ করে। শুধু তাই নয়, অত্যাচারকে লক্ষ্যভেদী করার জন্য ফিজিসিয়ান, সাইকিয়াট্রিস্ট সহ অ্যানথ্রপোলজিস্টরাও অংশগ্রহণ করে।
এই কুখ্যাত বন্দী শিবিরগুলোতে ঘটা বীভৎসতম অত্যাচারের কয়েকটি নাম ধরে বলা যায়।
(১) ওয়াটারবোর্ডিং – অত্যাচারের এই পদ্ধতিতে বন্দীর (অনেক সময়েই উলঙ্গ) মুখ কাপড় দিয়ে ঢেকে দিয়ে ক্রমাগত জলে চোবানো হয় যতক্ষণ না জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। জ্ঞান হারিয়ে ফেললে ডাক্তাররা শুশ্রূষা করে আবার অত্যাচার করার উপযুক্ত করে তোলে।
(২) ক্রমাগত দেওয়ালের গায়ে ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলা। এক্ষেত্রে বন্দীর মৃত্যু প্রায় অবধারিত।
(৩) শেকল দিয়ে বেঁধে সিলিং থেকে ঝুলিয়ে দেওয়া।
(৪) জোর করে নাক দিয়ে খাওয়ানো।
(৫) ছোট বাক্সের মধ্যে জোর করে একজন বন্দীকে ঢুকিয়ে বন্ধ করে রাখা।
(৬) নগ্ন বন্দীদের একের পরে এক শুইয়ে বা দাঁড় করিয়ে মানব পিরামিড তৈরি করা। এটা একধরনের মজার খেলা ছিলো। মহিলা মিলিটারিরাও অংশগ্রহণ করে।
(৭) দিনের পর দিন তীব্র উজ্জ্বল আলোতে ঘুম না পাড়িয়ে রাখা।
(৮) পাশের ঘরে বন্দীর বোন বা আত্মীয়ের ওপরে ধর্ষণ বা অন্য অত্যাচারের অসহ্য চিৎকার শোনানো। এসবের পরে বন্দী মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়লে সাইকিয়াট্রিস্ট এবং সাইকোলজিস্টরা আবার অত্যাচারের উপযোগী করে তুলতো। নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিনে-এ প্রকাশিত “ডক্টরস অ্যান্ড টরচার” প্রবন্ধে বলা হচ্ছে – “A nurse, when called to attend to a prisoner who was having a panic attack, saw naked Iraqis in a human pyramid with sandbags over their heads”।
এরপরেও আমরা আমেরিকাকে কিন্তু ফ্যাসিস্ট বলিনি। ইরাকি প্রতিরোধকারীদের জেলের মধ্যে অত্যাচার করে ঠাণ্ডা মাথায় খুন করার পরে বারাক ওবামা বলেছিলেন – “উই হ্যাভ কিলড আ ফিউ ফোকস (আমরা কিছু অবাঞ্ছিত মানুষকে হত্যা করেছি)”। আমরা কিন্তু এরকম বলদর্পী, আগ্রাসী, শীতল হিংস্রতায় মোড়া কথাকেও হিটলারের কথা বলে দেগে দিইনি। আমেরিকা পুরোমাত্রায় গণতান্ত্রিক থেকেছে! যেমনটা দিল্লিতে শান্তিপূর্ণ মিছিলে বড়ো লাঠি দিয়ে মেয়েদের গোপনাঙ্গে এবং পেছনে মেরে রক্তারক্তি করে দেবার পরে হাসপাতালে ভর্তি করাতে হলেও আমরা বিশ্বাস করছি গণতন্ত্রের মাঝে বাস করছি।
এরকম অ্যানাক্রনিজম তথা বিপরীতমুখিতার মাঝে বাস করে আমাদের মেডিক্যাল পেশা সম্পর্কে নৈতিকতার বোধ। ডাক্তাররা ওষুধ কোম্পানির কাছ থেকে উপঢৌকন নেয় কিনা কিংবা ডাক্তারের “নেগলিজেন্স” বা অবহেলা / অসাবধানতার-র কারণে রোগীর মৃত্যু হল কিনা এগুলো যেমন রয়েছে নৈতিকতার একটা দিক হিসেবে, অন্যদিকে তেমনি রয়েছে রাষ্ট্রের তরফে চালানো অত্যাচারের সাথী হিসেবে ডাক্তারের অবস্থান কি হবে। ২০২০-র পৃথিবীতে সে ইতিহাস খুব উজ্জ্বল নয়। এমনকি একটি রাষ্ট্রের সহনাগরিকের ওপরে ছিন্নভিন্ন করে দেওয়া অত্যাচার চললেও ডাক্তাররা কোন অবস্থান নেবেন সে কথাও বোধহয় আজ গভীরে ভেবে দেখার সময় এসেছে।
রাষ্ট্র এবং মানুষ – এ দুয়ের মাঝে আমাদের স্থিতি, আমাদের দোলাচলতা, আমাদের অবস্থান বদল। মেডিক্যাল নৈতিকতার কেবলমাত্র একটি কোন পাঠ নেই, বহু স্তরে স্তরায়িত।
শেষ ।
Share korlam sob bandhu der ke.
আর নয় । আমি আর সহ্য করতে পারছি না । এ এক অসহ্য অধ্যায় । আমি বারবার বলেছি চিকিৎসক একজন পেশাদার মানুষ মাত্র । একজন সৈন্যের সঙ্গে তার খুব তফাৎ নেই । সে লোভ ভীতি বা হিংস্রতার ওপরে নয় । কাজেই যে পেশাদার খুনী সে যতটা দোষী – নিয়োগকর্তা তার থেকে ঢের বেশী দোষী । তাই হিটলার – অথবা অন্য কোনও সাম্রাজ্যবাদী যতটা দায়ী ততটা কোনও বেতনভুক সৈনিক নয় । প্রতিবাদের তীর দিগভ্রষ্ট যেন না হয় ।
ভীষণ মানবিক ও এ সময়ে প্রাসঙ্গিক। ভালো লাগল
Story is old and we’ll known to many of us; but interpretation in respect to present national & world politics is commendable. Art of writing is also excellent.
মানব সভ্যতার ইতিহাস সম্পূর্ণ হয় নি। অগ্রগতি চলছে। আগে কাল মানুষ এবং রেড ইন্ডিয়ান সহ আদি বাসিন্দাদের ওপর ‘সভ্য’ নরখাদকদের যে অত্যাচার শুরু হয়েছিল, তা ‘বৈজ্ঞানিক’ চেহারায় রূপ পায় ইহুদীদের ওপর অত্যাচারে। এখন আমরা সবাই এদের শিকার।
সভ্যতা এগিয়ে চলেছে।
ধন্যবাদ আপনাকে, ডঃ জয়ন্ত ভট্টাচার্য।