চিত্রাকে অসুখের পর থেকে খুব বোঝায় নিখিলেশ। নিখিলেশ ছাড়া আর কেই বা তেমন আছে চিত্রার। মা বাবা চলে গেছেন। সন্তান জয়। দূরে থাকে।
চিত্রা খুব যত্নে মানুষ করেছে জয়কে। নাওয়া খাওয়া এক করে। প্রাণপণ খেটে। এই কোচিং থেকে সেই কোচিং। আজ গাইডেন্সএর ক্লাস তো কাল পাথ্ ফাইন্ডারের মক টেস্ট। তবে না ছেলে মানুষ হয়েছে। আর একবিংশে মানুষ হওয়া মানেই তো দূরে চলে যাওয়া।
প্রথম ঢেউয়ে বাড়ির সবাই ভুগেছিল। কিন্তু চিত্রার অসুখটাই বাড়াবাড়ি হল। রক্তের অক্সিজেন কমে ষাট। পনেরো দিন পরে হাসপাতাল থেকে ফিরল বটে। কিন্তু ফিরে এল এক পালটে যাওয়া চিত্রা।
বাড়ি এসে অবধি তার কিছু ভালো লাগে না। কিচ্ছু না।দিন রাত্তির মন খারাপ। রাঁধতে অত ভালোবাসত। বলতে গেলে সংসারটা ছিল তার প্যাশন। আর রান্নাঘর ছিল সেই প্যাশনের মস্ত প্রকাশ। সেই রান্না করা, সে নাকি ভুলে গেছে। আর সদা সর্বদা কেন্নোর মত পাক খেয়ে বিছানায় পড়ে আছে। ঝিমোচ্ছে।
ডাক্তার বলেছে চিত্রার এই নতুন অসুখটা ডিপ্রেশন। ডিপ্রেশন খুব খারাপ অসুখ। প্রায় মারণ ব্যাধি নাকি। হ্যাঁ, রাস্তার বিজ্ঞাপনে, খবরের কাগজে, ফেসবুকে এই রকমের কথা দেখেছে নিখিলেশ।
এ ছাড়া চিত্রার আগের থেকে অন্য অসুখ তো আছেই। ব্লাড প্রেশার ডায়াবেটিস মাইগ্রেন। চিত্রার পারিবারিক ইতিহাস বিপজ্জনক। ওর মায়ের এই আনকনট্রোলড ডায়াবেটিস আর হাইপারটেনশন ছিল। মা মাত্র চুয়ান্নয় চলে গেছেন হার্ট অ্যাটাকে। বাবা অবশ্য আশি পার করে গেছেন। বৃদ্ধাশ্রমের অনাদরটুকু না থাকলে হয় তো আরও কিছুদিন থাকতেন!
কাজেই চিত্রার ব্যাপারে নিখিলেশ সতর্ক। নিয়মিত ডাক্তার দেখায়। ইনভেস্টিগেশন করায় ডাক্তারের কথা মত। ওষুধ কেনে। কিন্তু অসুখ যা তাতে ডাক্তারবাবু বলেছেন ওষুধই সব না। ওষুধের সঙ্গে দরকার, ওই যাকে ইংরেজিতে বলে লাইফস্টাইল মডিফিকেশন, মানে নিয়মিত ব্যায়াম, হাঁটা, আর কম খাওয়া। করতেই হবে।
ডিপ্রেশন হয়ে অবধি এই শেষটির মানে এই লাইফস্টাইল মডিফিকেশনের বারোটা বেজে গেছে। আগে সকালে কোনও কোনও দিন পাঁচ ছ কিলোমিটারও রাস্তাও টেনে দিত দু জনে মিলে। এখন চিত্রা বেরোতেই চায় না। রোজ বেরোবার সময় কান্নাকাটি আর ঝামেলা।
চেনা সাইকিয়াট্রিস্ট। ডাঃ জিত ঘোষ। চিত্রার বাপের বাড়ির দিকের আত্মীয়। তিনি এই ডিপ্রেশনের জন্য যা ওষুধ দিয়েছেন চিত্রা তাও খাবে না।
— দূর দূর, জিত সেদিনের ছেলে। ও আবার ওষুধ দেবে কী?
সাইকিয়াট্রিস্টএর সঙ্গে আলাদা দেখা করেছে নিখিলেশ।
— শোনো দাদা, ওষুধ খাওয়াতেই হবে। বোঝাও। কাউন্সেলিং দরকার। তুমিই কাউন্সেলিং করো না হয়।
অগত্যা তাইই করে নিখিলেশ।
চিত্রাকে বোঝায়। জোর করে হাঁটতে নিয়ে বেরোয়। চিত্রা তেমন সাজুনি কোনও দিনই ছিল না। এখন আরও অগোছালো।
নিখিলেশ তাকে বলে,
– শোনো, একটু সাজগোজ কোরো। বেশি না। এই ধরো একটু হাল্কা করে লিপস্টিক, চোখে কাজলের ছোঁয়া। ঝলমলে নয়, কিন্তু তোমাকে মানায় এমন পোষাক। ভালো করে চুলটা আঁচড়ে… সিঁথিটা ইয়ে মতন। তোমার শরীরটা একটু
ঠিক হলেই বেড়াতে যাব।
বেড়াতে যাবার প্রায় মিছে কথাটা বলে বিরানব্বই বছরের বিছানায় শোয়া মায়ের কথা মনে পড়ে যায় একমাত্র সন্তান… নিরুপায় নিখিলেশের। মনে মনে জিভ কাটে।
যাবে। ঠিকই যাবে। কিন্তু কবে?
ওদের সারা জীবনে বেড়াতে যাওয়া হয়নি তেমন।
সমুদ্র অরণ্য হিমালয়… লোকে কতবার করে যায়!
এমনিতে কথায় বার্তায় খুব ভদ্র আর পরিশীলিত নিখিলেশ। শুধু কাঞ্চনজঙ্ঘার কথা উঠলেই বুকখোলা শব্দটা নিখিলেশ বলবেই বলবে এই রকমের একটা ব্যাপার ছিল এক সময়। বলত সব কাজ মিটলে কাঞ্চনজঙ্ঘার খোলা বুক দেখতে যাবে।
নিম্নচাপ থেকে মাথা তুলে চিত্রা ঝাঁঝিয়ে ওঠে,
— সখের শেষ নেই! তোমাদের সংসারে এসে অবধি সেজেছি কখনও ওরকম? সাজতে দিয়েছ? সেই বয়সেই সাজগোজ করিনি, আর এখন?
তার পরে গতযুগের গ্রাম্য মেয়ের মত বলে,
— তুমি বরং বিয়ে করো আর একটা। সখ মেটাও। নতুন কারও রূপ দেখ। আর তুমিও কন্দর্প রূপের পেখম মেলো।
এই শুনে নিখিলেশের গুম মেরে যাবার কথা। সে নিজে কন্দর্প না। আজ বয়স হয়েছে বলে নয়। চেহারায় সে সুদর্শন কোনওদিনই না। টল ডার্ক হ্যান্ডসামের মধ্যে সে শুধু ডার্কটুকু। বাকি কোনওটাই নয় সে। নিখিলেশের রাগ হতেই পারে চিত্রার বলা এই বাঁকা কথায়।
কিন্তু না, মনের ডাক্তার বলে দিয়েছেন, এই বলাটলাগুলোই রোগলক্ষণ। ওকে বোঝাতে হবে। বুঝিয়েই চলতে হবে। টেনে বার করতে হবে ডিপ্রেশন থেকে।
কাজেই নিখিলেশ বোঝায়।
সেই প্রথম যৌবনে বিয়ের পর নিখিলেশ তার বউকে তুই তোকারি করত খুব আবেগ হলে। চিত্রার গাল নেড়ে দিয়ে সেই রকম পুরোনো সোহাগের গলায় সে বলে,
– শোন্ রে চিত্রলেখা, দুজনেরই বয়স হল। পরিষ্কার বুঝছি, তোর শরীরের যা অসুখবিসুখ, তুই আমার আগে যাবি শিয়োর। আর আমার ফ্যামিলি হিস্ট্রি তো জানিস। বাবা চুরানব্বইয়ে গেছেন। মা স্টিল ব্যাটিং… বিরানব্বই। তুই যাবার পর আমি কোন না আরও বিশ পঁচিশ বছর বাঁচব।
— তো? বাঁচো না। কে বারণ করেছে?
— কী নিয়ে বাঁচব বলো তো? তুমি একটু যদি সেজেগুজে থাকো, সেই ছবির স্মৃতিটাই বুকে নিয়ে বাকি জীবন বাঁচাতে চাইছি। সেটা কি অন্যায়? এইটুকু দয়াই চাইছি তো!
খুব অভিমান মিশিয়ে বলে নিখিলেশ।
★
এই মুহূর্তে চিত্রা দাঁড়িয়ে আছে পেলিং হেলিপ্যাডে। ওদের রিসর্ট থেকে মোটে তিন চার মিনিট। সপরিবারে ছুটি কাটাতে এসেছে পুত্র জয়। সঙ্গে নিয়ে এসেছে মাকে। ওর শ্বশুর শাশুড়িও এসেছেন।
বৌমা মিমি, নাতি আর জয় এখনও কম্বলের তলায়। মিমির মা বাবাও শীতে জবুথবু। ওরা ব্রেকফাস্ট খেয়ে বেরোবে। আহা, সারা বছর খেটেছে ছেলে আর বউমা। একটু বিশ্রাম নিক।
সাজগোজ করে ওদেরকে ছাড়াই বেরিয়েছে চিত্রা। রিসর্টের গণেশ রাই বলে ছেলেটা রাস্তা বলে দিয়েছে। সোজা রাস্তা। আকাশ পরিষ্কার। হেলিপ্যাড থেকে বুকখোলা কাঞ্চনজঙ্ঘাকে দেখা যায়। আকাশ পরিষ্কার।
চিত্রাকে দেখাচ্ছে ভারি চমৎকার। যেমনটি নিখিলেশ বলেছিল। কপালে বড় লাল টিপ। লিপস্টিক, কাজল। আরও কী কী রূপটান।
অফ হোয়াইট শাড়ির আঁচল উড়িয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘার মুখোমুখি অপরূপা চিত্রা।
কাঞ্চনজঙ্ঘাকে চিত্রা বলল লজ্জা লজ্জা গলায়,
– তোমাকে খুব হিংসে করি আমি, জানো?
– কেন?
– ও কেন তোমার খোলা বুক দেখতে চায়?
কাঞ্চনজঙ্ঘা তার হিমেল ভালোবাসার কণ্ঠে শুধোল,
– তা হ্যাঁ রে মেয়ে, খুব সেজেছিস দেখছি!
– হ্যাঁ গো, ওই তো সাজতে বলেছে। সব সময় সেজে থাকি তাই। ওর কথা মত।
– তোর বর বলেছে বলেই সাজবি, এমন পড়ন্ত বেলায়? সবাই কী ভাববে? তোর বেয়াই বেয়ান?
– বাঃ, কী যে বলো! সাজব না? ও যে অপেক্ষা করে আছে। হঠাৎ করে চলে গেল। আমি যখন যাব ওর কাছে, ওর সঙ্গে দেখা হবে যখন, ওর কথা মত সেজে না থাকলে অভিমানী মানুষটা যে দুঃখ পাবে খুব!